সাদত হাসান মান্টোর আজ মৃত্যুদিন
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
উর্দু ভাষার কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৯১২ সালের ১১ মে, পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামে।
মান্টোর পিতা ছিলেন আদালতের বিচারক। কঠোর শাসনেও মান্টো ছোটবেলা থেকে বোহেমিয়ান হয়ে ওঠেন। লেখাপড়ার হাতেখড়ি অমৃতসরের মুসলিম হাই স্কুলে। কিন্তু স্কুলের গণ্ডিতে তার মনপ্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো। পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে দু’বার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন।
কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবহির্ভূত গল্প-উপন্যাসের বই পড়ার প্রবল আগ্রহ তাঁকে তরুণ বয়সেই অমৃতসর রেল স্টেশনের হুইলার বুকস্টল থেকে বই চুরিতে প্রলুব্ধ করেছিল। ১৯৩১ সালে কলেজে পাঠকালীন অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অশান্ত পরিবেশে মান্টোর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে।
১৯৩২ সালে পিতার মৃত্যুর পর মান্টো আরো অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের অর্থ কষ্ট লাঘবের জন্যে তখন থেকেই তিনি আয়-উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। সে সময় তার্কিক লেখক আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে মান্টোর সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎ সাদত হাসান মান্টোর জীবনে একটি মাইলফলক।
আবদুল বারি আলিগ সে সময়ের তরুণ লেখক মান্টোকে রাশিয়ান এবং ফরাসি ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই মান্টো, ভিক্টর হুগোর The last Day of a Condemned Man এর উর্দু অনুবাদ করেন। যা পরবর্তীকালে সারগুজাস্ত-ই-আসির( এক বন্দির গল্প) নামে উর্দুতে প্রকাশিত হয়।
এভাবে মান্টোর হাতে রাশিয়ান গল্পের উর্দু অনুবাদ রাশি আফ্সানে প্রকাশিত হয় এরপরেই। বিদেশি সাহিত্য উর্দু ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মান্টো অন্য জগতের সন্ধান পান। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে, এখানে তার আলাপ হয় লেখক আলি সর্দার জাফরির সাথে।
ক্রমশ তিনি হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় ছোটগল্পকার। তার বিখ্যাত গল্পের মধ্যে আছে বু, টোবা টেক সিং, তামাশা, ঠাণ্ডা গোশত, কালি সালোয়ার, খালি বোতল, ধুঁয়া ইত্যাদি। তার রচনায় দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, দাংগা, মানব চরিত্রের বীভৎসতা বারবার ঘুরেফিরে আসে। প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই উর্দু ছোটগল্পকারকে তার মুক্তচিন্তার কারণে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয় ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে তিনি লাহোর চলে যান। পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহি প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাহিত্যচর্চায় তার বিশেষ খ্যাতি হয়। তিনি একজন বেতার লিপি লেখক ও সাংবাদিকও ছিলেন। তার ছোট গল্পের সংকলন Kingdom`s end and other stories, একটি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্কেচের দুটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়।
বোম্বাই চলচ্চিত্র জগত অর্থাৎ বলিউডে মান্টোর অজস্র কাজ রয়েছে। বহু সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির চিত্রাভিনেতা ও পরিচালকদের কাছে মান্টোর কদর ছিল। আট দিন, চল চলরে নওজোয়ান, মির্জা গালিব ইত্যাদি সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং তার কৃতিত্ব।
মান্টো বিরুদ্ধে ছয়বার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়। ভারতে ও পাকিস্তান দুই দেশেই তার গল্পকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় অশ্লীলতার অভিযোগে। তার বিটার ফ্রুট গল্পের জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে লাহোর আদালতে অভিযুক্ত হয়ে আসতে হয় ১৯৫০ সালের ২৯ আগস্ট। সাদাত হাসান মান্টো আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আহমেদ (পরে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হন) ও আরো তিনজন তরুণ উকিল মান্টোর পক্ষে সওয়াল করেন।
তার গল্পে বোহেমিয়ান জীবন, সমাজের অন্ধকার জীবনের জটিলতা, মাতাল, পাগল, ভবঘুরে, পতিতারা ঘুরে ফিরে এসেছে। দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। তার অধিকাংশ কাজ পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। সালমান রুশদি মান্টো সম্পর্কে বলেন, Undisputed master of modern Indian short story। মান্টো নিজে বলতেন, তাকে উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক বলা হলেও ক্লাসের পরীক্ষায় তিনি উর্দুতে কখনো পাশ করতে পারেননি।
ক্রমাগত নিম্ন মানের সুরা পানে মান্টো লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। তার জীবনযাত্রাও ছিল চূড়ান্ত বাউণ্ডুলে এবং বেপরোয়া। শরীরের প্রতি অযত্ন, অপ্রতুল চিকিৎসা, আর্থিক অনটন ইত্যাদিতে জর্জরিত মান্টোর বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহ ব্যাধির কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার অকাল প্রয়াণ ঘটে তার দ্বিতীয় আবাস ভূমি লাহোরে।