সাজ্জাদুর রহমানের প্রবন্ধ ‘মূসার পুত্রত্রয়’
প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২২
বিজ্ঞান নাকি ম্যাজিক
আচ্ছা, নবম শতকে কি রোবট ছিল? প্রশ্নই আসে না, তাদের জন্মই তো হলো বছরকতক আগে। অল্পদিনে যদিও তারা ফুলেফেঁপে পিঁয়াজুর মতো মুচমুচে হয়ে গেছে, মানে তারা সবখানেই যেন কাজে লাগছে, যেমন পিঁয়াজ লাগে! যাই হোক, হঠাৎ মাথায় প্রশ্ন খেলে গেল, মূসার তিন পুত্র যদি আজকে জীবিত থাকত তবে তারা রোবট নিয়ে কি কি করত? তারাই বা কে, কিই-বা তারা করেছিল, কেনই-বা এইরকম ভাবনা মাথায় কিলবিল করবে? সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চলুন সামনে এগুতে থাকি।
তবে এর আগে আবেগী এক জগের গল্প শুনি। এটি এমনতর একটি জগ যেটায় তখনি পানি বের হতো যখন কেউ তার কাছে পানি চাইত! এটির নকশায় পদার্থবিদ্যার কিছু মৌলিক তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়েছিল। আবার আসি পরিবেশ উপযোগী জারের কথায়। যখন জারের কলটি ছাড়া হতো তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি বের হয়ে আপনাআপনি সেটি বন্ধও হয়ে যেত। এটিই ছিল মূল কারিশমা। এতে করে অপচয় কমত এবং সাশ্রয়ও হতো। এভাবেই চক্রটি চলতে থাকত যতক্ষণ না জার সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। আধুনিক কালের জনপরিষ্কারালয়ে আমরা একই ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করি।
এবার চলুন দ্বিমুখী এক কুশলী বোতলের গল্পে। বোতলটাতে যদি পানি এবং ফলের রস মেশানো হয় তবে তারা একত্র হয় না! কী আশ্চর্য! আরোও তো বাকি। এরপর যদি কেউ বোতল থেকে পানি খেতে চায় তবে পানিটা বের হয় বিপরীত মুখ দিয়ে, অর্থাৎ যেখান দিয়ে ফলের রস দেওয়া হয়েছিল। একই কথা কেউ ফলের রস খেতে চাইলেও, তা বের হয় বিপরীত মুখ দিয়ে!
শুনে কি জাদু মনে হচ্ছে? কিংবা আধুনিক বিজ্ঞান প্রশস্ততার সুযোগে বলাই যাবে এসব তো সম্ভবই, মেশিন দিয়ে কত কীই না করা যায়! তবে এইবার বলি, আমাদের আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপট নবম শতাব্দী।
স্বর্ণনগরীর স্বর্ণসন্তান
বাগদাদের মসনদে জ্ঞানপ্রতাপ খলিফা আল-মামুন উপবিষ্ট। তার বিশ্বস্ত বন্ধু ও জ্যোতির্বিদ মূসা বিন শাকির কিছুক্ষণ আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তবে রেখে গেছেন তিনটি খাঁটি স্বর্ণের টুকরা। সিংহাসনে উপবেশিত মানুষটি ছিলেন পাকা জহুরি। খাঁটি জিনিস বুঝতে পেরেই একদম ছো মেরে নিয়ে এলেন বাগদাদে, স্থান দিলেন নিজ স্বপ্নস্থান বায়তুল হিকমাহতে। বাবা হারানো এই তিন ছেলে ছিল প্রচণ্ড মেধাবী এবং কাজের স্পৃহা সম্পন্ন। তাই অল্প দিনেই নিজেদের প্রতিভার ছাপ রাখলেন।
তখন ছিল বায়তুল হিকমাহর বসন্তকাল, দলে দলে স্কলার, শিক্ষক ও ছাত্ররা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে নানাজাতীয় জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে আসত। প্রাচীন গ্রীকের জীবনদর্শন থেকে ভারতীয়দের গণিত কিংবা পারস্যের সাহিত্য থেকে চীনের প্রযুক্তি সবই একে একে অনুবাদ এবং সংস্কার হতে থাকল। এদের ওপরে চলল আরোও বিশদ গবেষণা এবং উন্নয়নের কাজ। সেই তিন ছেলে এখানেও যোগ্যতার পরিচয় দিল, কাজের পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য দিয়েও এই অনুবাদ আন্দোলনকে তারা জিইয়ে রাখল। এছাড়া তাদের সম্পদ বায়তুল হিকমাহর শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হতো। বিশেষ করে তারা সবসময় প্রাচীন কিংবা অধুনালিখিত পাণ্ডুলিপিগুলো খুঁজে বেড়াতেন, লোক পাঠাতেন সেসব বাগদাদে নিয়ে আসার জন্য, এমনকি কখনো তারা নিজেরাও যেতেন। আচ্ছা, তাদের নামই তো জানা হলো না। একে একে বলেই ফেলি তাহলে, মুহাম্মদ, আহমাদ ও হাসান।
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শুধু পাণ্ডুলিপিই নয়, যোগ্য মানুষদেরও তারা বাগদাদে নিয়ে আসতেন। তেমনি একজন ছিলেন ছাবিত ইবনে কুররা। বড়ভাই মুহাম্মদ একটি সফরে হারান এলাকায় এই গণিতজ্ঞ ও মাহির অনুবাদকের সাক্ষাৎ পান এবং যোগ্যতার সমাদরের জন্য বায়তুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। একইভাবে অন্যতম প্রখ্যাত এবং প্রসিদ্ধ অনুবাদক হুনায়ন ইবনে ইসহাককেও তারা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক হিসেবেও পেয়েছিলেন ইয়াহিয়া ইবনে আবু মানসূরের মতো ব্যক্তিকে। তাদের সাহায্যপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীরা মাসে পাঁচশো দিনারের মতো ভাতা পেত! বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি টাকায় এটি প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি। তো বুঝাই যাচ্ছে, এই ভ্রাতৃত্রয় আরবীয় বিজ্ঞানের বিস্তৃতিতে প্রাথমিক যুগে দূর্দান্ত অবদান রেখেছেন। তবে এসব পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা আর্থিক সহায়তার বাইরে তারা নিজেরা তৎকালীন বিজ্ঞান জগতে কি অবদান রেখেছিলেন? এখন তবে সেটিই জানা যাক।
বনু মূসার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাজ হচ্ছে, যন্ত্রকৌশলের ওপর লেখা ‘কিতাব আল হিয়াল’। বইটিতে ওপরে বর্ণিত জিনিসগুলোসহ আরো একশোটি যন্ত্রের কৌশলের বিস্তারিত বর্ণনা ও পরীক্ষণ ছিল। ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ম্লান ও উজ্জ্বল হওয়া বাতি, রূপ পরিবর্তনকারী ঝর্ণাসহ অনেক কিছুরই বিশদ পরীক্ষিত বিবরণ। তন্মধ্যে আশিটিকে যান্ত্রিক কৌশলের যথার্থ প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। লোকে এসবকে জাদু ভেবেও বিভ্রান্ত হতো। যদিও কিছু যন্ত্র ছিল গ্রীকদের প্রতিলিপি তবে বাকিগুলো অন্যদের তুলনায় আরো অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল।
তারা সবমিলে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও যন্ত্রকৌশলের ওপর বিশটির মতো বই রচনা করেছিলেন। তন্মধ্যে শুধুমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপরেই আছে বারোটির মতো। মুহাম্মদ জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান, আহমাদ যন্ত্রকৌশল এবং হাসান জ্যামিতি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করেছেন। জ্যামিতির ওপর তাদের বিখ্যাত বইটি হচ্ছে, কিতাব মারিফাত মাশাহাত আল আশকাল অর্থাৎ সমতল ও গোলাকার চিত্র পরিমাপের বই। তারা পরিমাপের ক্ষেত্রে আয়তন এবং ক্ষেত্রফলকে গুরুত্ব দিয়েছিল। এই বইটি তাদের পূর্ণতা দিয়েছিল। গ্রীক ধারণার বাইরে গিয়ে মৌলিক জ্ঞান যে তারা রচনা করছিলেন, এটিই তার প্রমাণ বহন করে।
তাদের লিখিত বেশকিছু বইয়ের নাম পাওয়া যায়। বড়ভাই মুহাম্মদ অর্ধচাঁদের দৃশ্যমানতা, পৃথিবীর শুরু এবং মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর (নভস্থিত গোলক) গতিবিধি নিয়ে লেখা ‘কিতাব হারাকাত আল-আফলাক, কিতাব আল-হায়া বা অ্যাস্ট্রোনমির বই এবং কিতাব হারাকাত আল-ফালাক আল-উলা বা নভস্থিত গোলকের প্রথম গতি নিয়ে বই লিখেছেন। শেষোক্ত বইটিতে টলেমির দেওয়া মহাবিশ্বব্যবস্থার সমালোচনাও ছিল। আহমাদ জ্যামিতির গাণিতিক প্রমাণ নিয়ে বই রচনা করেছেন। অ্যাস্ট্রোল্যাবের গঠন সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা এবং সৌরবর্ষ নিয়েও তাদের রচনা ছিল। তারা বছরকে ৩৬৫ দিন ছয় ঘণ্টায় ভাগ করেছিলেন। খলিফা আল মামুনের আদেশে ভৌগোলিক পরিমাপ এবং মানচিত্র সংক্রান্ত কাজের জন্য মেসোপটেমিয়ার মরুভূমিতে গিয়ে ডিগ্রি নিয়েও কাজ করেছেন। যদিও এসবের অধিকাংশই আজ হারিয়ে গিয়েছে তবুও বইগুলোর বিষয়বস্তু এবং পরিধি দেখে বুঝা যায় তারা তৎকালীন জ্ঞানজগতে কতটা প্রভাব ফেলেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এতসব কাজ বায়তুল হিকমাহতে তাদেরকে এই সম্পর্কিত বিষয়ে নেতৃত্বের আসন দিয়েছিল।
এবার আসা যাক যন্ত্রকৌশল ও গণিতে। নবম শতকে গ্রীক বিজ্ঞান মুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে পরিচিত হচ্ছিল। বিশেষ করে ফিলো অব বাইজেন্টিয়াম (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং হিরো অব আলেকজান্দ্রিয়া (প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি) এর কাজ সবার কাছেই প্রসিদ্ধ ছিল। বনু মূসা গণিত এবং জ্যামিতির উপর বেশকিছু কাজ করেছেন। তাদের বিখ্যাত বইটির কথা আবারো আসবে। এই বইটি ১২ শতকে জেরার্ড অব ক্রেমোনা দ্বারা ল্যাটিনে এবং তের শতকে নাসিরুদ্দীন আল-তুসীর দ্বারা প্রচার পেয়েছিল। জ্যামিতির জগতে এটি একটি মৌলিক বই। ছাবিত ইবনে কুররা, ইবনে আল-হাইছাম, লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি, জর্দানাস নেমোর এবং রজার বেকনের লেখায় বইটির উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এছাড়াও খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এপোলোনিয়াস অব প্রেগার কোণ বিভাজন সংক্রান্ত তত্ত্বের উপরে লেখা তিনটি বইতে তাদের অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, জ্যামিতিক প্রমাণের লেখা গ্যালনের একটি বই, আহমাদ ইবনে মূসা লিখিত কোণ ত্রি-বিভাজনের কারণ এবং আয়তাকার, বৃত্তাকার চিত্রের বিবরণ নিয়ে আরেকটি বই। শেষোক্তটিতে উপবৃত্ত নিয়ে আলোচনা আছে। বাগান নির্মাণ সম্পর্কিত একটি অধ্যায়ও রয়েছে।
পরিবারের এই বৈজ্ঞানিক ক্রমধারা তাদের ছেলেদের মাঝেও গিয়েছিল। মুহাম্মদের ছেলে নুয়াইম জ্যামিতিক উপপাদ্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং বই লিখেছিলেন। আল-দাব্বাঘ লিখেছেন, আরবীয় বিজ্ঞানীদের মাঝে বনু মূসারাই প্রাথমিক ভাবে গ্রীক গাণিতিক কাজ ও তত্ত্বগুলো পর্যালোচনা করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে তারা আরবীয় গাণিতিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাদেরকে হয়ত গ্রীকদের শিষ্য বলা যাবে তবে মৌলিক কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রীক ধারণা থেকে তারা সরেছিলেন এবং এতে করে তাদের কৃত গাণিতিক কাজগুলো আরো বেশী গুরুত্ববহ হয়েছিল।
আমাদের করণীয়
এগুলোই শেষ নয়, তাদের বিভিন্ন গবেষণা কাজ ও আবিষ্কারের শুরু মাত্র। আমাদের জানতে হবে কিভাবে তারা ভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে বৃত্তের ক্ষেত্রফল বের করেছিলেন, যেখানে নবম শতক পর্যন্ত ক্ষেত্রফল এবং আয়তন পরিমাপ নিয়ে কোনো কাজ বা গবেষণার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আরোও জানতে হবে কিভাবেই বা তারা টলেমির মহাবিশ্বব্যবস্থাকে সমালোচনায় ফেলেছিল। উপপাদ্যের চিত্রাঙ্কনে কি পদ্ধতি তারা ব্যবহার করেছিল সে সম্পর্কেও জানার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
বনু মূসার পুত্রত্রয়কে জানলে আমরা জানব ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোর কথা, খুঁজে পাব আগামীর পথচলার নির্দেশ, অণুপ্রেরণা ও শক্তি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে রাজত্ব করতে হলে তাদের অবদানগুলোকে বর্তমানের সামনে পরিচিত করাতে হবে, একইসাথে আমাদেরও অভিন্ন পথ বেছে নিয়ে হাঁটতে হবে সীমান্ত পর্যন্ত। জ্ঞানান্বেষণকারীদের জন্য চিরন্তন শুভকামনা।