সাগর পাড়ের দূরের দেশ

শামীমা জামান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০১৮

দূরে। হাইওয়ে ফিফটি থেকে দৃষ্টির শেষ সীমায়। ভ্যালেহোর বুনো নেশা ধরানো পাহাড়ের বিশালতায় হারিয়ে যেতে যেতে কখন যে বে ব্রীজ ধরে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে গেছি, টেরই পাইনি। আহা সানফ্রান্সিসকো ! হিপ্পি ফ্যাশনের জন্মদাত্রী মা। বে ব্রীজে পা রাখতেই তার আধুনিক স্থাপত্যে নজর কাড়ে। ওকল্যান্ডের গোছানো ছোট ছোট ঘরবাড়ির বসতি পেরিয়ে আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলো যেন গ্রীবা উচিয়ে তার আধিপত্যের কথা জানান দিচ্ছে। আগেরবার এসে গোল্ডেন গেট ব্রীজে যাওয়া হয়নি, তাই এবার শহরে ঢুকে সোজা সেখানে। বিশ্ব বিখ্যাত গোল্ডেন গেট ব্রিজ। আধুনিক বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি। তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত লোকে বিশ্বাস করতো না, এমন একটি জিনিস তৈরি হওয়া সম্ভব। পৃথিবীর দীর্ঘতম এ ঝুলন্ত সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৭ মাইল। সানফ্রান্সিস্কোয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বুঝানো হয় এ ব্রীজকে। ১৯১৬ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে দীর্ঘ ২২ বছর লেগে যায় এটি তৈরি হতে। অবশেষে ১৯৩৭ সালে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় পৃথিবীর সর্বাধিক তোলা স্থাপনা আলোকচিত্রের অন্যতম এই ঝুলন্ত সেতু। যার নির্মাণ ব্যয় ২৭-৩৫ মিলিয়ন ডলার। যদিও বিশ্বে আত্মহত্যার স্থান হিসেবে ১ নম্বর স্থানটি দখল করে আছে মোহময় এ সেতু। পরেরবার সে চেষ্টা করে দেখব খন। এবার থাক। নামেই গোল্ডেন। এটা সোনা দিয়ে তৈরি ব্রীজ বা সোনালি রঙের ব্রীজও নয়। আগে অন্য রং ছিল। এখন কমলা রঙে চুবানো হয়েছে।

নিচে নীল সাগর। দূরে সানফ্রান্সিসকোর  আকাশছোঁয়া দালানগুলো যেন সাগর পাড়ের দূরের দেশ। গাড়ি পার্ক করে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সরু রাস্তা ধরে এদিকটায় পর্যটকদের বসার জন্য বেশ ক’টি বেঞ্চ রাখা আছে। ওখানে বসে স্যান্ডুইচ, পানীয় খাওয়া হলো। আশপাশে রেস্ট্রুম আছে কিনা আমার রুমমেটকে বলতেই বোরিংটা বলল কি,  না মনে হয়! এখানে বাথ্রুম কই পাবা?
আজব কথা বল তো! পর্যটকদের জন্য ব্রীজ দেখার ব্যবস্থা করছে, আর রেস্ট্রুম থাকবে না... বলে গট গট করে পাহাড়ের গা ঘেষে চলতে লাগলাম। খানিক বাদেই একটা মোবাইল রেস্ট্রুম মিলে গেল। আমেরিকার যেখানেই গেছি রেস্ট্রুমে নো পানি। বিষয়টি ছাড়া কোনও অপরিচ্ছন্নতাজনিত বিরক্তিতে পড়তে হয়নি। জাতির পশ্চাৎদেশ দিয়ে তো গুয়ের গন্ধ বেরুনোর কথা। কিন্তু এইখানের রেস্ট্রুমটি সেই রকম। ঢুকেই মনে হবে আরিচা ফেরিতে এসে পড়িনি তো! তোরা যেমন পানি রাখিস না আমিও তেমনি আচ্ছামতো ট্রাম্পের টয়লেট টিস্যুর শ্রাদ্ধ করবো, হুম। প্রথমে কমোডে বসার জন্য দু’পাশে চার লেয়ার করে লম্বা টিস্যু বিছিয়ে কে না কে এসে ইয়ে করে গেছে জনিত শুচিবায়ু দূর করা গেল।

প্রচণ্ড বাতাস এখানে। ঝড়ে উড়িয়ে নেয়া বাতাস। অথচ কী প্রশান্ত। চারপাশে সাগরের নীল পানি আছড়ে পড়ছে ছোট্র দ্বীপটির গায়ে। ওই তো আলকাট্রাজ! বিখ্যাত সেই বন্দিপুরী। ভয়ংকর সব দাগী আসামিদের পুরে রাখা হতো ওই দ্বীপে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত অত্যধিক নিরাপদ বন্দিশালা হিসেবে চলমান ছিল দ্বীপটি। ১৯৬৩ সালের দিকে কয়েকজন বন্দি মিলে এখান থেকে পালিয়ে যায়। বর্তমানে এটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। গোল্ডেন গেট থেকে বোটে করে মিনিট বিশেকের যাত্রাপথ। এরই একটি কক্ষে বন্দি ছিলেন আমেরিকান ইতিহাসের কুখ্যাত অপরাধী মাফিয়া সম্রাট আল কাপোনে। ক্রাইম লর্ড আল কাপোনে ১৯২০ এর দশকে শিকাগো আউটফিট নামক গ্যাংয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ও পরবর্তী সময়ে সর্বেসর্বা গ্যাংস্টার। শিকাগো বসেই গোটা আমেরিকায় অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। খুন, জখম, ড্রাগ বা পতিতাবৃত্তির ব্যবসা সবটাতেই সমান পারদর্শী আল কাপোনে ছিলেন সংগীতপ্রেমী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শান্ত সৌম্য ভদ্র চেহারার আল কাপোনে লোকেদের কাছে ছিলেন প্রচণ্ড জনপ্রিয়। সমাজ সেবায় প্রচুর অর্থ খরচ করে রবিনহুড ইমেজও গড়ে উঠেছিল তার। আল কাপোনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় শিকাগোতে, এক ভয়ংকর সংঘর্ষে সাতজন নিহত হলে। পরে ১৯৩৪ সালের দিকে তাকে বন্দি করে আলকাট্রাজে রাখা হয়।

বিকেলে ফিশারম্যান ওয়ারফ এ হাঁটাহাঁটি চললো। ওয়েদারটা দারুণ ছিল। শীতল বাতাসের মাঝে মিস্টি একটা রোদে মাখামাখি শহর। এখানে স্ট্রিট খাবার, সুভ্যেনির শপ, কাপড় আর নানা দ্রব্যাদির পসরা বসেছে। স্ট্রিট সিংগাররা খানিক বাদে বাদেই সুরের ঝংকার তুলছে সাউন্ড সিস্টেমের সাথে হেলেদুলে। বাতাসে গান ভাসে সারাবেলা। আকাশে নেশাধরা রোদ। সারাক্ষণ পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা এ জায়গা প্রতিদিনই পুরোদস্তুর উৎসবমুখর। মন খারাপের কোনও অবকাশ এখানে নেই। কালো জটায়ু নাম না জানা গায়ক গলা ছেড়ে বব মারলে শুরু করলে সেদিকেই ছুটে চলি। রেডি অয়ি অয়ি অউ... বাফেলো সোলজার...। কিছুক্ষণ মন আনন্দে নেচে উঠতেই স্ট্রিট গায়ককে দেখলাম, সে গানের ফাঁকে ফাঁকে বেকার দাড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের হাত দিয়ে মৃদু ধমকের সাথে তাদের দানবক্সটি দেখিয়ে দিচ্ছে। তার দেখানোর ধমকানো ভঙ্গিটি খুব বিচ্ছিরি লাগলো। গান শুনে ভালো লাগলে সহৃদয় ব্যক্তি তো এমনিই ডলার বের করবে। এভাবে ধমকে নেয়া তো চাঁদাবাজির পর্যায়ে পড়ে। ওকে কিছু না দিয়ে চলে এলাম। আমাদের সাথের বাচ্চারা ঢুকলো বিলিভ ইট অর নট এ। পাশেই মাদাম তুশো। আমি আর খালিদ সেখানেই ঢুকে পড়লাম। মায়াময় আলো আঁধারির মাঝে উজ্জ্বল তারকাদের সাথে নানা ভঙ্গিমায় ফটো খিচতে লাগলাম। বেচারা খালিদ তখন পুরোদস্তর ফটোগ্রাফার হয়ে উঠতে বাধ্য হলো। মাঝে মধ্যে মিনমিন স্বরে ও বলছে, আমারও একটা তুলে দাও জ্যাকি চ্যানের সাথে। যেন শুনতে পাইনি এমন ভাব করে ক্লিন্ট ইস্টউড ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ধুর তোলো তো। তাকে ফেলে আরেক কক্ষে ঢুকেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। ওখানে এক ভদ্রলোক বসে মেন্ডুলিন বাজাচ্ছেন। আমি মূর্তি ভেবে ঢুকেছি। ভদ্রলোক অবশ্য অন্য লোকদের মতো কুশল বিনিময় করলেন না। তবে মৃদু হাসি ছিল ঠোঁটে। কক্ষটি খুব ছোট। পুরনো পলেস্তারা খসে পড়া। প্রিজন! দেয়ালে সাঁটা নাম দেখে চমকে গেলাম। আল কাপোনে! মানে ভদ্রলোক আসলে...। এত জীবন্ত আর কাউকে দেখলাম না। তাকে মোমের মূর্তি ভাবার কোনোই কারণ নেই। আল কাপোনের পাশে বসে থাকলাম কতক্ষণ। খারাপ মানুষও কত বড় মাপের মানুষ হতে পারে, এ নিয়ে ভাবতে হবে তো।

কাছেই রেস্ট্রুম পেয়ে চুল ঠিক করতে গেছি। ফিরে এসে দেখি আরেক কাণ্ড। আব্রাহাম লিংকন চাচাজানের পাশেই একটি বেঞ্চে খালিদ বসে ছিল আমার অপেক্ষায়। চোখে সানগ্লাস। এই আধো আলো ঘরের মধ্যেও। আর সে তো চুপচাপ বসে থাকে, হাত পায়ের নড়নচড়ন নেই। এক চাইনিজ মহিলা খালিদের কোলে এসে বসতে বসতে হাতের ফোনটি সেলফি মুডে তাক করছে। খালিদ সরে বসতেই মহিলার বিকট চিৎকার, ও মাই গড! সরি সরি... আই থট ইউ আর আ সেলিব্রেটি টু...। চাইনিজ মহিলা জানলো না, সেও সত্যিই একজন সেলিব্রেটি। তবে তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট একটি গরিব দেশের।