সাঈফ ইবনে রফিকের ছয়টি খুদে গল্প
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯
একদলা মাটি
বিজ্ঞানীদের একটা দল ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে গেল। ঈশ্বরকে বলল, ‘হে মহান ঈশ্বর, আপনার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এবার আপনি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলুন।’
হাসতে হাসতে ঈশ্বর বললেন, ‘কেন, তোমরা কি এমন করতে পেরেছো?’
বিজ্ঞানীদের একজন একদলা কাদা নিলো। মানুষের আকার দিলো। আরেক বিজ্ঞানী ফুঁ দিলো। কাদার দলাটা মুহূর্তে একটা মানুষে রূপান্তরিত হলো। অবাক হলেন ঈশ্বর!
এবার বিজ্ঞানীদের দলনেতা বললেন, আপনার দিন শেষ। আমরাই এখন মাটি থেকে আদম তৈরি করতে পারি। আপনি বিলুপ্ত হন!
‘বেশ! আগে হে মানুষ, একদলা মাটি বানিয়ে দেখাও। পারলে এমন মৌলিক পদার্থের দুনিয়া বানাও, যেখানে আমার সৃষ্ট কোনও কাঁচামাল থাকবে না।’ মুচকি হেসে বললেন ঈশ্বর।
হিব্রু উপকথা অবলম্বনে
ঈর্ষা
এক ফিলিস্তিনি আর এক ইজরায়েলি জেরুসালেমের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। পথে ডাস্টবিনের পাশে একটা চেরাগ পড়ে থাকতে দেথে দুজনই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঘষাঘষিতে আলাদিনের চেরাগ থেকে জিন বেরিয়ে এলো। দুজনকে কুর্নিশ করে জিন বলল, যেহেতু দুজনই আমার মালিক, আমি প্রত্যেকের একটা করে ইচ্ছাপূরণ করতে পারবো। বলুন, আপনাদের কার কি ইচ্ছা।
প্রথমে ফিলিস্তিনি ভদ্রলোক বলল, প্যালেস্টাইনের চারপাশে এমন শক্ত আর উচু প্রাচীর বানিয়ে দাও, যাতে ইজরায়েলিরা আর আক্রমণ না করতে পারে। আমি একটা নিরাপদ মাতৃভূমি চাই।
ইচ্ছাপূরণ করে ফিলিস্তিনিকে তার দেশে পাঠানো হলো। এবার ইজরায়েলি জিনকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা প্যালেস্টাইনের দেয়ালটা কেমন বানিয়েছো? জিন বলল, দেড়শো ফিট উঁচু, ৫০ ফিট প্রশস্ত। এই দেয়াল ভেদ করে কেউ ঢুকতে পারবে না, বেরুতেও পারবে না।
বেশ তবে এবার আমার ইচ্ছাপূরণ করো।প্যালেস্টাইন পানিতে ভরে দাও। শালারা সব ডুবে মরুক!
গরু ও ষাঁড়
পোল্যান্ডের ইহুদি অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামের একমাত্র গরুটা দুধ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিপাকে জনগণ। দীর্ঘ আলোচনার পর গ্রামবাসী আরেকটা গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিলো। মস্কো থেকে গরু কিনতে দু’হাজার রুবল লাগবে আর মিনস্ক শহর থেকে কিনলে এক হাজার। গ্রামবাসীকে জানানো হলো, মস্কোর গরু কেনা হবে। কিন্তু মিনস্ক থেকে কম পয়সায় গরু কিনে গ্রামে ফিরল পঞ্চায়েত। সদস্যরা বাকি এক হাজার রুবল ভাগ করে নিলো।
নতুন গরু। নতুন দুধ পাচ্ছে গ্রামবাসী। হঠাৎ একজন আইডিয়া দিল, দুশো রুবলে একটা ষাঁড় কিনলে এই গরুটা নতুন বাচ্চা দেবে। মানে নতুন গরু। আরো দুধ!
পঞ্চায়েতে প্রস্তাব পাশ হলো। গ্রামে ষাঁড় এলো। কিন্তু নতুন এক বিপাকে পড়লো গ্রামবাসী। ষাঁড়টা যতই গরুটার কাছে যায়, গরুটা ততই এড়িয়ে যায়! দৌড়ে পালায়। বছরের পর বছর দুধ দিয়ে যাচ্ছে সতী গরু, কিন্তু ষাঁড়ের সাথে মিলছেই না।
প্ল্যান ভেস্তে যাওয়া মানে পঞ্চায়েতের ইজ্জত যাওয়া। গোটা গ্রামের প্রেস্টিজ পাংচার। এলাকায় জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত শীর্ষ রাব্বির কাছে গেল গ্রামবাসী। কোনও একটা উপায়তো বের করতেই হবে। গরুর অনাগ্রহের কথা শুনে রাব্বি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, মিনস্ক থেকে গরু কিনলেতো এমন হবেই!
সবাইতো অবাক! পঞ্চায়েতের সদস্যরা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে! রাব্বি এটা জানলো কিভাবে? সবার মনে একটাই প্রশ্ন। রাব্বি আরও গভীর কণ্ঠে বললেন, আমার বউও মিনস্ক শহরের!
ইহুদি চুটকি
দোররা
প্রচলিত ইজরায়েলি অনুগল্প। এর সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। সম্ভবত ইজরায়েলিরা সৌদি আরব যেতে পারে না।
সৌদি আরবে মদ খেতে গিয়ে ধরা পড়ল তিন বিদেশি। একজন ফেঞ্চ, একজন জার্মান, আরেকজন ইজরায়েলি। মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ করলেও ভালো উকিল ধরে কারাদণ্ড পেল তিনজন।
জাতীয় দিবসের দিনে বিশেষ ক্ষমায় ছাড়া পেল তারা। তবে ছাড়া পাওয়ার আগে ২০ দোররা মারার বিধান আছে। রাজা বললেন, রানির জন্মদিন উপলক্ষে আজ দোররা মারার আগে সবার একটা করে ইচ্ছাপূরণ করা হবে।
ফ্রেঞ্চ বলল, বেশ দোররা মারা আগে আমার পাছায় একটা বালিশ বেঁধে দেন। শপাং শপাং চাবুকের ১০ ঘায়েই বালিশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন। বাকি ১০টার যন্ত্রণায় অস্থির ফেঞ্চ কাঁদছে।
এরপর জার্মানের পালা। সে বলল, আমার পাছায় দুটা বালিশ দিন। ১৫ ঘায়ের পর বালিশ উধাও। ৫টা জায়গা মতো পড়ল।
এবার ইজরায়েলিকে রাজা বলল, তুমি যেহেতু জেরুসালেম থেকে এসেছো। তোমাকে ২টা ইচ্ছাপূরণের সুযোগ দেয়া হবে। কি চাও? ইজরায়েলি বলল, ২০টার জায়গায় আমাকে একশেঅ দোররা মারুন জনাব! চমকে উঠলেন সৌদি রাজা। বলো কি! তোমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটা কি? আমার পিছে ফ্রেঞ্চ ব্যাটাকে বেঁধে দিন!
ঈশ্বর দেখবেন
এক সুন্দরী ইহুদি তার প্রেমিককে বাড়ি নিয়ে এসেছে। বাবা-মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। ওরা বিয়ে করতে চায়। ডিনারের পর মেয়ের বাবা ছেলেকে স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। মেয়ের পাণিপ্রার্থীর ইন্টারভিউ নেবেন। মেয়ের বাপ জিজ্ঞাসা করলেন ‘তো বাবা, তুমি কি করো?’
ছেলে বলল, আমি তাওরাত স্কলার।
‘বেশ! বেশ!’ মেয়ের বাপ প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘বুঝলাম, কিন্তু আমার মেয়ে যে লাইফ লিড করছে, তাকে এমন একটা বাড়িতে রাখতে পারবেতো? সেতো এই ব্যয়বহুল জীবনে অভ্যস্ত।’
‘ঈশ্বর আমাদের বাড়ি দেবেন’ তাওরাত স্কলারের উত্তর।
‘আর বাচ্চাকাচ্চা পালবে কিভাবে?‘ প্রশ্নের উত্তরে ছেলের একই উত্তর, ‘সেটাও ঈশ্বর দেখবেন।’
যে প্রশ্নই হোক, ইমানদার স্কলারের উত্তর একই। ঈশ্বর দেখবেন।
রুম থেকে ছেলেকে নিয়ে বের হলেন মেয়ের বাবা। মা জিজ্ঞাসা করলো, ছেলেকে কেমন দেখলে?
ইহুদি মেয়ের ইহুদি বাপের উত্তর, ‘ছেলেটার কোনও চাকরি-বাকরি নাই, কোনও ভবিষ্যত পরিকল্পনাও নাই। তবে একটা জিনিষ ভালো লাগছে, ছেলেটা আমাকেই ঈশ্বর ভাবছে।‘
হিব্রু রম্যগল্প
সংখ্যাতত্ত্ব
সীমান্ত লাগোয়া এক জার্মান ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয়া এক বালকের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। পোলান্ডের খ্রিস্টান শাসকের কানেও তার খবর পৌঁছালো। ইহুদি বালকের সুনামে একটু বিরক্ত হলেন। তাকে পরীক্ষার জন্য রাজদরবারে ডাকলেন। উৎকণ্ঠায় গোটা পরিবার। বালক একাই রওয়ানা দিলো রাজধানীর দিকে। হেঁটে হেঁটে অনেক দূরের শহরে প্রাসাদের সামনে এসে রক্ষীদের বললো, আমি তোমাদের রাজার সাথে দেখা করতে এসেছি।
স্মার্টনেসে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাত্তা দিতে বাধ্য হলো প্রাসাদরক্ষীরা। দরবারে খবর গেলো, গ্রাম্য জ্ঞানী বালকটি এসেছে। রাজা তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন। সংখ্যালঘু বালকের ড্যাম কেয়ার হাঁটার স্টাইল-স্মার্টনেস দেখে কানাকানি শুরু করলো রাজসভার লোকজন।
রাজা সবাইকে চুপ করতে বললেন। বালককে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি প্রাসাদ পর্যন্ত এলে কিভাবে? ঠিকানা পেলে কোথায়?
‘ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেছে।’ বললো বালক। ‘মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতেই প্রাসাদের পথ খুঁজে পেয়েছি, এই এত দূর হেঁটে এসেছি।
উত্তর শুনে আবারও ফিসফাস করে বিরক্তি প্রকাশ করছে রাজসভা। রাজা আবারও সবাইকে থামতে বললেন। এবার রাজা বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করলেন, প্রাসাদে আসার পথে যখন তোমাকে একজন বলছে ডাইনে যাও, আরেকজন বলছে বামে যাও। তখন তুমি কি করেছো?
‘মহামান্য রাজা, তাওরাতে ঈশ্বর আমাকে শিখিয়েছেন, যখন অনেকগুলো মত আসবে, তখন তুমি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বেছে নেবে। দুজন বিপরীতমুখী পথ দেখালে আমি তৃতীয় ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছি।’ বালকের নির্ভিক উত্তর শুনে অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন রাজা, সঙ্গে গোটা রাজসভা।
এবার রাজা বললেন, ‘শোনো হে বালক, আমি আমার রাজসভাসহ সংখ্যাগরিষ্ঠরা তোমাকে ইহুদি ধর্ম ছেড়ে দিতে বলছি। তোমার ধর্মগ্রস্থইতো বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বেছে নিতে। তুমিও আমার ধর্মগ্রহণ করো।‘
এবার জ্ঞানী বালকের উত্তর, মাফ করবেন রাজা। আমি যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নেয়ার কথা বলছিলাম, তখন আমি প্রাসাদ থেকে দূরে ছিলাম। এখন আমি প্রাসাদে রাজার সামনেই দাঁড়ানো। এখন যদি আপনার মন্ত্রী-রাজসভার সদস্যরা সবাই মিলে বলে যে, আমি ভুল জায়গায় এসেছি, আমি বিশ্বাস করবো না। আমি আমার চোখের সামনে রাজাকে দেখতে পাচ্ছি। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, তিনিও বিশ্বপ্রাসাদের রাজা। পৃথিবীর সবাই মিলে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও, তার প্রাসাদে দাঁড়িয়ে আমি সংখ্যাগরিষ্ঠকে বিশ্বাস করতে পারি না।’
প্রচলিত ইহুদি লোককাহিনি অবলম্বনে