চিত্রকর্ম: নন্দলাল বসু
সরদার জয়েনউদ্দীনের গল্প ‘নয়ান ঢুলি’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০১৯
কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীনের আজ জন্মদিন। ১৯১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) পাবনার সুজানগর উপজেলার কামারহাটিতে কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘নয়ান ঢুলী’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
ঠুক-ঠুক-ঠুক। ঢোল সারে নয়ান ঢুলি। ছোট হাতুড়ি দিয়ে পেটে, আর একগাছা করে তোয়াল টানে খুব সতর্কতার সাথে। পাঞ্জার চারটি আঙুল দিয়ে মাঝে মাঝে তাল ঠোকে, কান পেতে শোনে, ঠিক আওয়াজ উঠছে কি না। ডুং-ডুং-ডগ-ডুং। অনেক দিন পর নয়ানের কাছে একটা ঢোল মেরামতের বায়না এসেছে।
হাতে কাজ না থাকলে নয়ানের হাত নিশপিশ করে, কী যে করবে তাও টের পায় না। মাঝে মাঝে সুপারিগাছের খোল থেকে ও খেলার ঢোল বানায়, সে ঢোল ছেলেদের দিয়ে বলে, বাজা, খুব করে বাজা। তাতেই ওর আনন্দ। আজ হাতে একটা কাজ পেয়ে নয়ান তাই উঠেপড়ে লেগেছে, আচ্ছা করে এটা না সারলেই নয়। তাছাড়া এটা কাচারিবাড়ির ঢোল, সেরে দিলে বখশিশও আছে পুরোপুরি চার গণ্ডার পয়সা।
আগে কিন্তু নয়ানের খুব কাজ আসত। বারোয়ারি মন্দিরের কাজ, চৈত্রসংক্রান্তির কাজ, গাঁয়ের যাত্রা পার্টির কাজ। তাছাড়া ভাসান, গাজীর গানের সব দল থেকেও অনেক কাজ আসত। এখন সেসব বন্ধ হয়ে গেছে। কালে কস্মিনে তিন্নাথের মেলা কি রামনাম আসর বসে, তাদের আর ঢোল তবলার তেমন দরকার হয় না। হলেও ওই পুরনো ছেঁড়াটা ফাটাটা দিয়েই কোনোমতে চালিয়ে দেয়। মুসলমানদের গানের দল তো এখন নাই-ই।
পির ও মৌলবি সাবরা বলেন, গান-বাজনা করা হারাম। তাই ওরা ছবু কর্মকার, গহের গায়ানি, মেহের বয়াতি সব গান-বাজনা ছেড়ে দিয়েছে। না দিয়ে তো উপায় ছিল না। সমাজে একঘরে হয়ে থাকা যায় কতদিন। তাও ওরা জিদ করে ছিল অনেক দিন। বলত, একঘরে, কেন আরো যা পারো তাই করো, আমরা গান-বাজনা করবই। সে কথা নিয়ে মেহের বয়াতি ধুয়া বেঁধেছিল, আমরা কয়জন একঘরে আয়/ঘর বাঁধি একসাথে...
সত্যি ওরা গাজীর গান, ভাসান গান ও জারির গান নিয়ে রাতদিন মত্ত থাকত। তারপর দিনকালও যেমন খারাপ হয়ে গেল, সাথে সাথে মানুষের সুখও গেল। পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নেই, কার গান কে করে। তারপর এখন তো শরিয়ত মোতাবেক চলতে হবে, এখানে গান-বাজনার ঠাই নাই। তাই ওদের মুখ চিরদিনের জন্য গেছে বন্ধ হয়ে। ওদের গান-বাজনা যাবার সাথে সাথে নয়ানের কাজকামও গেছে। আজকাল একটা কাজকাম পেলে নয়ান যেন হাতে সোনার তাল পায়। একে কাজের অভাব, তাতে দুর্ভিক্ষের বাজার।
একঘরের এক বাড়ি। ঘর তো নয় ঝুপড়ি। পাটশোলার বেড়া, কোনো জায়গায় আছে, কোনো জায়গায় নাই। নয়ান বলে উইয়ের জ্বালায় কিছু রাখা যায় না। বাড়ির চারদিক বেড়ার বেশি দরকারও করে না। নয়ান কোনোদিন তা দেয়ও না। নানান আগাছা, ঝোপ-জঙ্গলেই ঘেরা, বেড়ার কাজ ওতেই হয়ে যায়। এখানে ওখানে আমের গাছ, বেড়ার মাটি সব সময় স্যাঁতসেঁতে পিচপিচে ভিজে থাকেই। ঘরখানার চালায় বিশেষ ছাউনি নেই। কেউ কেউ মজা করে বলে, নয়ান ঢুলির আকাশ-কুলকুলি ঘর। মানে, ঘরে শুয়ে আসমানের তারা গুনা যায়। একপাশে ছোট্ট একটি বারান্দা, তার আবার এককোণা ঘিরে একটি খোপ তৈরি করা। তার মাঝে থাকে নয়ানের সাধের টেপি, একটা ছাগল। বারান্দার খোলা দিকে বসেই নয়ান কাজকর্ম করে আর হুককুর হুককুর কাশে। ওটুকু ও বৈঠকখানারূপে ব্যবহার করে। লোকজন এলে ওখানেই ডেকে বসায়, বলে, বোসো, বোসো।
সেখানে বসেই নয়ান ঢোলে চাম সাঁটবার কসরত করছিল সেই সকাল থেকে। পচা দাই এসে দাঁড়াল, কী ওস্তাদ, কী করছ বসে। নয়ান মাথা তুলে না চেয়েই জবাব দেয়, আরে ভাই, হাতে বড় একটা জরুরি কাজ এসে পড়েছে। তা বসো, পিঁড়িখানা টান দিয়ে পাছা এঁটে বসো।
রাখো তোমার কাজকাম, তামুকটামুক খাওয়াও।
তামুক! তামুক পাব কোথায়? শালার চিটেগুড় কি দেশে আছে? সে-না বাঘের চোখের চাইতেও দুর্মূল্য হয়ে গেছে, সাপের মণিও বলতে পারো। গিরিস্তের গুড়ের দাম দেড় টাকা সের আর চিটের দাম চার টাকা, আজব কারখানা, তাও মেলে না। চেষ্টা করলে বেলাকে পাওয়া যায়, তা দাম আরো বেশি। বেলাকেরই তো বাজার এখন। সব জিনিসই বেলাক। তামুক খাওয়া ছেড়ে দিলাম পচাই সে জন্যে।
তামুক খাওয়া তো ছাড়লে, ভাত ছাড়তে পারলে তো বুঝতাম তুমি একটা কাজের মতো কাজ করেছ।
ভাতও তো প্রায় ছেড়েছি পচাই, চাল কেনার পয়সা কোথায়? আজ দুদিন তো চুলোর মাথায় হাঁড়ি বসেই না। এই তো একটা কাজ পালাম, একেবারে ভাঙা ঢোল, তালা নাই দুটোর একটাতেও। তা বছির প্যায়দা এসে বলে গেল পাঁচ টাকা আট আনার মধ্যেই সব সেরে দিতে হবে, নায়েব বাবুর হুকুম।
অনেক আপত্তি করলাম, বছির ভাই! পাঁচ টাকা আট আনার তো চামড়াই লাগবে, আরো আরো জিনিসপত্তরও তো আছে। তা বলে কি না আচ্ছা আচ্ছা সার তো। যদি সন্ধ্যার মধ্যে সেরে কাচারিবাড়ি দিয়ে আসিস, তবে আরো চার গণ্ডার পয়সা বখশিশ পাবি। মনে রাখিস ব্যাটা, কাচারিবাড়ির ঢোল। ভালো যেন হয়, আর আজই যেন হয়, কাল সকালে ক্রোক পরওয়ানা জারি হবে ওই ঢোল দিয়ে।
সারা দিন তাই সেই কাম নিয়ে পড়ে আছে নয়ান। ঠুক ঠুক করছে আর কাশছে। কেমন হল পচাই, আওয়াজটা একবার শোনো, বলেই হাত মারে নয়ান, কেমন হে? শালার ঢোল যেন কথা বলে।
তা তোমার হাত যখন পড়েছে কথা না বলে যায় কোথায়! পচাই উত্তর দেয়।
আরে আমি কী? ঢোল সারত আমার ওস্তাদ বুঝলে হে পচাই! যার নিকট আমি হাতে খড়ি নেই এ কামে, সে সেই জেলের মধ্যে। আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি আর কী জানি? সে ছিল জাত ঢুলি, নয়ান বলে চলে, আমার তো জাত ব্যবসা এ না, আমি হলাম ঘরামির ছেলে, ঘর সারা ছিল আমার কাজ। যাকগে, সেসব পুরান কথা, সেসব তো তোমাদের কাছে অনেকই বলেছি। তা ছাড়া তোমরা তো তা জানোই। এখন এ অসময় কী মনে করে গরিবের বাড়িতে পা দিলে তাই বলো?
সব কথা খুলে বলা যায় না ওস্তাদ। কয়েক দিন ধরেই ভাবছি, তোমার সাথে একবার দেখা করে মনের কথা সব খুলে বলব। কী দুঃখে যে দিন কাটছে। তা সাহসও হয় না, কী জানি তোমার মতিগতি বা এখন কেমন!
পচাই তুমি দেখি তাজ্জব করলে, তুমি কি আজ আমায় নতুন দেখলে, না চেনো না আমায় যে, অত সংকোচ?
না ওস্তাদ, তা নয়। যেমন দিনকাল পড়েছে তাতে কারো কাছে কইতেও সাহস হয় না।
তা যাক, এখন বলো তোমার কথা কী? জিজ্ঞাসা করে নয়ান ঢুলি।
কথা আর কী, দিন যে আর চলে না ওস্তাদ।
দিন তো চলেই পচাই। আল্লাহর দিন বসে থাকে না, তবে কারো যায় সুখে কারো যায় কষ্টে।
কিন্তু কষ্টের তো একটা সীমা আছে ওস্তাদ।
সেজন্যই তো ১৩৫০ সনে অমন ঘটনাটা ঘটে গেল, নইলে শিকার কি আমি কোনোদিন করতাম। ঘর সারতাম, দু পয়সা পাতামও বেশ। সুখে-দুঃখে কোনোমতে ওতেই চলত। নয়ান ঘরামির ওপর টেক্কা দিয়ে ভালো ঘর বেঁধে যায় এমন লোক এ দেশে কি ছিল? তোমারই বলতে হাঁ ওস্তাদ বটে, নয়ান একটু মুচকি হাসে। আর গালের দুদিকের গর্তদুটো খানিক গভীর হয়। সহসা গম্ভীর হয়ে আবার বলে, কিন্তু ১৩৫০ সনে সে ঘর বাঁধায়ও পেট চলে নাই। অতি দায় ঠেকেই হারান পরামানিকের বাড়ির খোঁজ দেই সিঁধেল চোরের। ওদের ঘর সারতে গিয়ে দেখলাম হারান কাঁড়িখানেক টাকা এনে মাচার নিচের ব্যাঙ্কে বন্ধ করে রাখল অথচ আমার মজুরি দেবার সময় বলল, আজ টাকা নাই, কাল নিও।
বললাম, পরামানিক ভাই, বাড়িতে চাল একেবারেই নাই।
উত্তর দিল, আরে যা-যা ভ্যানর ভ্যানর করিস না।
চার-পাঁচ দিন আমার মতো লোকের মজুরি আটকে রাখলে কী হাল হয় বলো? মনটা বড় ছোট করে বড় ভাবনা নিয়ে ফিরে আলাম বাড়ি। এসে দেখি, আমার জড়িপোশ, ক্ষিধের জ্বালায় বড় কাঁদছে, ওর মা জ্বরের তাপে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে অজ্ঞান ডাক্তার, আরো অনেকে দেখা সাক্ষী দিয়ে এলো, কোর্টে হলপ করে, আমরা চুরি করেছি।
জেল থেকে ফিরে এসে জড়িপোশ আর তার মাকে আর দেখতে পাই নাই। শুনেছিলাম ওরা নাকি মরে গেছে। নয়ানের গলা ধরে আসে, তবু ও বলতে চায় কত কথা, কত ইতিহাস যা ওর বুকভরা গাঁথা রয়েছে। আজও নয়ানের মনে আছে সব কথা, খুব ভালো করেই মনে আছে। ও বলেছিল, পরামানিক তুমি মানুষ না, একটা পশু।
আবার পচাই প্রশ্ন করে, তোমার সেদিনের সেই সব কাহিনী বললে কি পেট ভরবে ওস্তাদ? আমারও যে তোমার মতো দিন হল। এখন কী করব বলো?
কী করবি, মাথা দুলিয়ে বলে নয়ান। দ্যাখ পচাই, পিতৃপুরুষের ব্যবসা ছেড়েছি কম দুঃখে না। নইলে নয়ান ছিল ঘরামি, আজ সে ঢুলি কেন?
শুনতেই কেমন বেখাপ্পা শোনায় কথাটা, কদম ঘরামির ছেলে নয়ান ঢুলি। নয়ানের চোখ বেয়ে আসে দরদর পানি। ও চুপ করে থাকে, কোনো কথা আর উচ্চারণ করতে পারে না।
পচা বলে, ওস্তাদ, কাঁদলে কি এর প্রতিকার হবে?
জানি, কাঁদলে এর প্রতিকার হয় না পচাই। তাই তো বয়সের সময় কত ঝড়-বৃষ্টি-বাদল মাথায় কত আঁধার রাতের অন্ধকারেও ঠেলে ফেলে শিকারে বেরিয়ে যাতাম! কোনো শালাকে পরোয়া করি নাই। সেদিন গায়েও বল ছিল, বলেই নয়ান তার দুমড়ে পড়া শরীরটার দিকে একবার ফিরে তাকায়। আবার বলে, কত জায়গায় রাতবিরাতে হানা দিয়ে ফিরেছি। জঙ্গলের বাঘ আর বড়লোকের বন্দুক, ওতে নয়ানের বুক একটুও দমে নাই। আরে আজ তো নয়ান মরা, সে নয়ান নাই।
না ওস্তাদ, তুমি একেবারে ভেঙে পড়ছ। তুমি শুধু সাথে থাকো ওস্তাদ, শিকারের কাজ সব আমি নিজে হাতে করব। তুমি আর একবার উঠে দাঁড়াও, নইলে আমরাও বাঁচব না, ওস্তাদ। সব কথাই তো তোমাকে খুলে বলেছি, আর চোখে দ্যাখো সব। জীবনকে বঞ্চনা আর কতকাল করব। ওস্তাদ বলে তোমাকে মেনেছি, তুমি মাথার মণি। তুমি সাথে একটু সাহস জোগালে পচাইও কারো কেয়ার করে না।
ধীরস্থির হয়ে ভাটার মতো দুটো চোখ দিয়ে চেয়ে থাকে নয়ান পচাইর আকুতি-ভরা মুখের দিকে। তারপর ধীর গম্ভীর স্বরে বলে, হুঁ। আচ্ছা আসিস রাতে, ডাক দিস। এ রাতের দিকে নয়, মানুষ শেষরাতে ঘুমায় বেভোরে, সেই সময় কেমন?
আচ্ছা, বলে চলে যায় পচাই! পচাই শুয়েছিল বিছানায় কিন্তু ঘুম আসে নাই। বারবার বাইরে বেরিয়ে দেখেছে, অনুমান করেছে রাত কতখানি হল তা জানতে। প্রহরে প্রহরে রাত এগিয়ে গেছে, ধীরে ধীরে পার হয়েছে দুপুর, চাঁদ ডুবে গেছে অন্ধকার হয়েছে ঘন, আরো ঘন নিঝঝুম আকাশ, পৃথিবী। তারাগুলো ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রয়েছে মাটির পৃথিবীর দিকে। পচাই বলেছে, আল্লাহ মেঘ দাও, ঝড় দাও, আঁধার করে দাও দুনিয়া। তারপর নিঃশব্দে বারান্দা থেকে নেমে পড়েছে পচাই বালিশের নিচে রাখা লাঙলের ফালটা হাতে করে। মুখে বলেছে, বিসমিল্লাহ।
ধীরে ধীরে সেই আঁধার পথ কেটে এগিয়ে চলেছে পচাই, নয়ানের বাড়ির দিকে।
ওস্তাদ, ওস্তাদ। ফিসফিস করে ডাকে পচাই।
এসেছিস? ঘুমাইনি রে পচাই। দাঁড়া! বাস্তু খুঁটিটার নিচে টিপ করে একবার মাথাটা ঠোকে নয়ান আর মনে মনে ভাবে, তোর কাছে আবার যেন ফিরে আসতে পারি। তারপর সোজা উঠে দাঁড়িয়ে মাজার কাপড়টা কষে গিঁট দেয় মাজার সাথে, তারপর বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে যায়।
বাইরে তখন গহন আঁধার সারা পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে। এত আঁধার যে সে আঁধারের গভীরত্ব ভয় জমিয়ে তোলে মানুষের মনে। তবু ওরা দুজন গায়ে গায়ে মিশে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সে আঁধার ভেদ করে চলে এগিয়ে।
লোকজন জাগোও, মাঝে মাঝে চৌকিদারের হাঁক সে রাতের গভীর নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দূর হতে আরো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নয়ান আস্তে আস্তে পচাইকে সাহস দিয়ে বলে, ভয় খাসনে পচাই, ও গোপাল চৌকিদার ঘরে শুয়েই হাঁকছে।