প্রতীকী ছবি
সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘ব্যক্তিগত বিনোদন’
পর্ব ৬
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২৪
একবিংশ শতকের এই তৃতীয় দশকে এসে যদি প্রশ্ন করা হয়, মোবাইল আমাদের কী কাজে লাগে, তাহলে খুব বেমানান শুনাবে। কারণ মোবাইল ছাড়া আমাদের জীবন অচল। মোবাইলের মাধ্যমে আমরা যে শুধু যোগাযোগ স্থাপন করি তা নয়, আমাদে লেখাপড়া, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মোবাইলের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিচিত্র জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমরা প্রতিমুহূর্তে মোবাইলের আশ্রয় নিয়ে থাকি।
মোবাইলের যে বিষয়টি আমাদের জীবন ও জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক ও নেশাগ্রস্ত করে তোলে তাহলো বিনোদনের জগৎ। মোবাইলের ভার্চুয়াল বিশ্ব বিপুল। মহাজগতের মতো এর কোনো পরিসমাপ্তি নেই, কূলকিনার নেই। এই পুরো জগৎটিকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। কেননা ভালো লাগা বা না-লাগার বিষয়টি বিবেচনার জন্য সিদ্ধান্তের অবকাশ নেই। কিংবা সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজনীয় সময় একেবারেই বিবেচ্য নয়। স্কিনের উপর আঙুলের স্পর্শমাত্র পছন্দ ও বিকল্প বিস্ময়কর দ্রুততায় পরিবর্তীত হতে থাকে।
এর সঙ্গে মানসিক স্থিরতাও কমতে থাকে। ভার্চুয়াল এই জগতের অনেক অ্যাপই অতি ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ও কৌতূহল উৎপাদনকারী। এর মধ্যে একটি অ্যাপ হলো ফেসবুক কিংবা টিকটক। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং কোনো ব্যক্তি, মতাদর্শ, সমাজ বা সংগঠনের আদর্শে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে ফেসবুক। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অ্যাপটি আবার ব্যক্তিগত আনন্দের পটভূমিতে রাহুগ্রাসের মতো মানুষকে অধিকার করে নিয়েছে।
ফেসবুক একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যক্তিকে আনন্দে, উৎফুল্লে, হাস্যতামাশায়, হতাশায়, নৈরাশ্যে রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আছে ফেসবুকে। পৃথিবীতে যতজন মানুষ আছে ততজন মানুষই ফেসবুক তার নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে। সে স্ট্যাটাস দিতে পারে এবং সেই স্ট্যাটাসে অসংখ্য মানুষ তাদের মন্তব্য ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। একইভাবে অন্যের স্ট্যাটাসে সে তার মতামত ব্যক্ত করতে পারে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। প্রতিজন ব্যক্তির একটি নিজস্ব সত্তা আছে। তার নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা, পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-অরুচি, আদর্শ-অনাদর্শ, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাকার জগৎ রয়েছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিজন ব্যক্তি তার নিজস্ব ভালোলাগার জগৎটিতে ব্যাপৃত থাকতে পারে এবং একই সঙ্গে অপ্রিয়, অপমানকর, যন্ত্রণাদায়ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে পারে। কিন্তু ফেসবুক এমন এক ঘোর তৈরি করতে পারে, যে কোনো পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই আচ্ছন্নতার মধ্যে নিমজ্জিত না থেকে পারে না।
হাতের মুঠোয় পুরে রাখা টাচস্কিন একটি মোবাইল আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, পারা-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই যেন। একমাত্র মোবাইল নিয়ে আমাদের দিনের এবং বিশেষ করে রাতের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়। বিষয়টি এমন নয় যে, ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা ব্যবসা করছি, কোনো সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি, কিংবা অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজে ব্যাপৃত থাকি। তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ঠুনকো আনন্দের জন্য নিরন্তর মোবাইলের টাচস্কিনে আঙ্গুল সঞ্চালন করি। এতে শিক্ষার্থীদের তো বটেই, উপরন্তু সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রচুর সময় নষ্ট হয় এবং এক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। অথচ দিকে ৩০ মিনিটের বেশি ফেসবুকে থাকা স্বাস্থ্যকর নয়।
ফেসবুকের আনন্দ সমবেত আনন্দের ধারেকাছেও নয়। যে প্রাণপ্রাচুর্যে সমবেত আনন্দ অফুরন্ত হয়ে ওঠে, ফেসবুকের মতো ব্যক্তিগত আনন্দে তার লেসমাত্রও নেই। অধিকন্তু এই আনন্দ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, নিঃনঙ্গ করে, বিষণ্ণ করে। অনেক সময় বন্ধুদের সাফল্য, তাদের মন্তব্য আমাদের হতাশ করে। আবার আপনার সফলতার বয়ান দেখতে দেখতে তথাকথিত বন্ধুরা আপনার প্রতি ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠেন। তারা আপনার প্রতিটি কাজে, কথায়, আচরণে ভুল ধরতে থাকবে এবং তীব্র সমালোচনা করে আপনার জীবন অতিষ্ট করে তুলবে। কখনো দেখা যায়, বিকৃতমনস্ক ও ঈর্ষাকাতর ‘ফেসবুক বন্ধু’ অহেতুক বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। এতে করে মানসিকভাবে আমরা ভেঙে পড়ি। সুতরাং এই যখন পরিস্থিতি, তখন কী করে আমরা তাকে আনন্দ বলতে পারি! সুতরাং নিখাঁদ আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তির জন্য ফেসবুক কিছুতেই সহায়ক হতে পারে না।
ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা অনেক সময় ভুল তথ্য লাভ করি। এগুলো গুজব। সেই গুজব হতে পারে চিকিৎসা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, রোগশোক, বাজারব্যবস্থা, আইনের শাসন ইত্যাকার হাজারটা বিষয়ে। এইসব বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে সুস্থির সমাজ থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং এককথায জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে ফেসবুক আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে।
ফেসবুক মূলত অপরিচিত মানুষের প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্মে কে কী উদ্দেশে বিরাজমান, তা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, সরলতা ও বিশ্বাসের সুযোগে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের এই ঝুঁকি অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের ২০১৮ সালের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি ৫ জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন এবং প্রতি ১০ জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। আর সাইবার বুলিং থেকে বিষণ্ণতা, স্ট্রেস এবং এমনকি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার অবতারণা হতে পারে। সুতরাং হাতের মুঠোয় পুরে রাখা মোবাইলটি কিছুতেই দেহ-মনের জন্য আনন্দের হতে পারে না। চলবে
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ