সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘ব্যক্তিগত বিনোদন’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৪, ২০২৪

আশির দশকের শেষদিক থেকে শুরু হয় আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উত্থান পর্ব। মূলত কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশে তখন থেকেই খুলে যেতে থাকে অর্থনীতির আরও বিচিত্র ক্ষেত্র। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি এবং মূলত নারীনির্ভর গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের ফলে আমাদের চিরচেনা গ্রামীণ অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়। সম্পদ ও ক্ষমতার চিরায়ত গ্রামীণ কাঠামো ও স্থিতিশীলতা দ্রুত ভেঙে পড়ে। আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও সম্পর্কের বন্ধনও শিথিল হতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এই ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে।

এ সময় থেকে অনিবার্যভাবেই উৎসব ও বিনোদন ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক হতে শুরু করে এবং সঙ্গে সঙ্গে টাকার গরম ও লোক দেখানোর প্রতিযোগিতা প্রবল আকার ধারণ করে। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সমাজের ভেতরগত ঐক্য ও সংহতি শ্লথ হতে থাকে। আর এ সময় উত্থান হতে থাকে ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মের আশ্রয়ে অধর্ম ও চরম ধর্মীয় গোঁড়ামির। ফলে অনিবার্যভাবেই গ্রামীণ সমাজে চিরকাল ধরে যে সব অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব, অনুষ্ঠানাদি, খেলাধুলা প্রচলিত হয়ে আসছিল, তা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে। যেমন নাটক, যাত্রা, পালা, কবির লড়াই, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া গান, গাজীর গীত, বিয়ের গীত, বিচার গান, কবি গান, ভাব গান, পালা গান, ধোয়া গান, ভাটিয়ালি গান।

এ সবই ছিল সমবেত উৎসবের আয়োজন। এছাড়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছিল কানামাছি, বৌ বৌ, গোল্লাছুট, গুডুলা, বৌচি, কুতকুত, দাড়িয়াবাঁধা, ডাংগুলি, মার্বেল, হা-ডু-ডু, কাবাডি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, হাড়িভাঙা, লুকোচুরি, দড়ির লাফ, এক্কা-দোক্কা, আগডুম-বাগডুম, পাতাখেলা, লুডু খেলা। এই সব খেলাধুলার ভেতর দিয়ে যে মনোগড়ন তৈরি হতো তা ঐক্যের, সংহতির, সমতার, সংবেদনার, সহমর্মিতার। বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যেও ছিল রং ছিটানোর খেলা, কাদায় লুটোপুটি খেলা এবং গৃহিণীদের দলবেঁধে বিয়ের গানের আয়োজন। যেমন, সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে এই গানটি শুনতে পাওয়া যায়- লীলাবলি লীলাবালি/বড় যুবতী সই গো/কি দিয়া সাজাইমু তোরে।

চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের সিনেমা গোলাপি এখন ট্রেনে বিয়ের এই গানটি উল্লেখ আছে। সে সময় এই গানটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। “আইছে দামান সাহেব হইয়া, বইছে মুখে রুমাল দিয়া/ঘোমটা খোলার আগে তোমায় করিগো সাবধান,/চান্দের আলো দেইখা তুমি হইয়ো না অজ্ঞান।”

যৌথ নারী অবচেতনার চিরায়ত আকাঙ্ক্ষা অসাধারণ যূথবদ্ধতায় প্রকাশিত হতে দেখেছি গ্রমীণ বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে। সেখানে ব্যক্তির মধ্যে সবাই এবং সবার মধ্যে ব্যক্তি আনন্দিত রূপে বিরাজমান ছিল। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ নারীরা একসময় দলবেঁধে পাখি, ফুল, লতাপাতা ও বিভিন্ন চিত্র এঁকে আকর্ষণীয় নকশি কাথা, শিকা, বাঁশ ও বেতের নানা রকম সৌখিন জিনিস তৈরি করত। এসব নকশি শিল্পকর্ম তৈরিতে মেয়েদের যেমন শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যেত, তেমনি তাদের মনোগড়নে ঐক্যের সংহিতা ও আনন্দের নিরবচ্ছিন্ন উত্তরাধিকার মূর্ত হয়ে উঠত।

কার্তিকে ছিল নবান্ন উৎসব, পিঠা উৎসব। পৌষ পার্বণে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে গ্রামীণ ছেলে-মেয়েরা মেতে উঠতো বিভিন্ন উৎসবে। পৌষ-মাঘ মাসে ধান কাটার পরপরই ছেলে-মেয়েরা বাড়ির কাছাকাছি নিজেদের মতো করে ঘর বানিয়ে আয়োজন করত জোলপাতির। এই পিকনিকে থাকত নিজেদের তৈরি নানা রকম খাবারের আয়োজন ও সঙ্গে গান আর হৈ-হোল্লুড়। এক সময় গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বিয়ের অনুষ্ঠান, খাৎনা ও নানা রকম অনুষ্ঠানে রেডিও, ক্যাসেট, মাইক, ভিসিডি ব্যবহারও লক্ষ করা যেত। কিন্তু কোথাও এই সব আনন্দ-উৎসব ব্যক্তিবিশেষ হয়ে উঠেনি। সব উৎসবই ছিল সবার উৎসব, সবার আনন্দ।

এমনকি গ্রামে একসময় শীতকালে পুকুরে, খালে, বিলে মাছ ধরার উৎস হতো। গ্রামে গ্রামে এবং এমনকি বাজারে ঢোল বাজিয়ে মাছ ধরার স্থান, সময় ও তারিখ ঘোষণা করা হতো। কয়েক গ্রামের মানুষ জড় হতো মাছ ধরার জন্য। শত শত মানুষ এক সঙ্গে জলে নেমে যেত ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, ব্যাগজাল, পলো আর ঠেলাজাল নিয়ে। যখনই কারো জালে মাছ উঠত তখনই তীরের দর্শকগণ একসঙ্গে হৈহৈ করে উঠত। যূথবদ্ধ সেই আনন্দের স্মৃতি এখনো অনেকের কাছেই উজ্জ্বল হয়ে আছে।

সে সময় মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য ছিল, অভাব-অনটন ছিল। শিক্ষাদীক্ষা তেমন ছিল না বলেলই চলে। কিন্তু হতাশা ও নৈরাশ্য ছিল না। সমাজের কেউই একাকিত্ব বোধ করত না। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঝগড়াঝাটি নিয়ে সবাই একসঙ্গে বসবাস করত। মানুষের মধ্যে লোভ, চরম স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না বললেই চলে। এক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য বিরাজ করত সর্বত্র। চলবে

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ