সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘ব্যক্তিগত বিনোদন’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০২৪

আমাদের শৈশবে গ্রামে খুব মেলা হতো। দুই ঈদের সময় মেলা বসতো। বিশাল আয়োজন করে মাহফিল অনুষ্ঠিত হলে সেই মাহফিলকে কেন্দ্র করেও মেলা হতো। বৈশাখী মেলা তো ছিলই। এছাড়া বিচিত্র পুজার্চনায়ও মেলা বসতো। আর মেলা বসতো জাতীয় দিবসগুলোতে।

তখন মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড় হয়ে উঠত। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোনো খোলা মাঠে বা বাজারে আয়োজন করা হতো মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো। গ্রামের সেইসব মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা মুগ্ধ করত দর্শনার্থীদের।

মেলায় আবার বিভিন্ন নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হতো। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা নির্বিশেষে এইসব মেলায় সবাই অংশগ্রহণ করত আনন্দের সঙ্গে। ফলে মেলাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হতো। এছাড়া বিয়েসাদি, খতনা, পরীক্ষার রেজাল্ট এইসবকে কেন্দ্র করেও অনুষ্ঠান হতো।

মানুষের কর্মের জগৎটিও ছিল বহুজনের সম্মিলনে।  খেতে ফসল বোনা, খেত পরিষ্কার করা বা নিড়ানো, ফসল কাটা, পাকা মরিচ তোলা, ধান মাড়াই, ঘর তৈরি করা, মাছ ধরা, খাল বা পুকুর কাটা, পুকুরের পানি সেচে মাছ ধরা ইত্যাকার সব কাজই ছিল অনেকে মিলে কারার কাজ। আমাদের সেই শৈশবে দেখেছি, সম্মিলনটা এত সত্য ছিল যে, একার কোনো স্থান জীবনের কোথাও ছিল না।

মানুষের জীবনে মারাত্মক দারিদ্র্য ছিল, দুঃখ-কষ্ট ছিল, ঝগড়া-বিবাদ ছিল, মারমারি-কাটাকাটিও ছিল। বাড়িতেই ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, চাচা-জেঠার মধ্যে মারামারি, মহিলাদের ঝগড়া, পাড়া-প্রতিবেশির সঙ্গে মারামারি, এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের যুদ্ধ। এসব ছিল। কিন্তু এসবকে অতিক্রম করে যা ছিল, তার নাম প্রশান্তি। কারো মধ্যেই লোভ দেখিনি।

অন্তরে বিষ জমা করে রাখার যুগ তখনো শুরু হয়নি। ‘একা’র ধারণা তখনো শুরু হয়নি। দারিদ্র্যের মধ্যে এক ধরনের ভেতরগত আনন্দিত জীবন মানুষকে মোহমুগ্ধ করে রাখতে দেখেছি। আর তার মূলে ছিল যূথবদ্ধতার ব্যাকরণ।

সত্তরের দশকে তো নয়ই, এমন কি আশির দশকেও আমাদের গ্রামে কোনো টিভি ছিল না। একাশি সালে আমি যখন সরকারি তোলারাম কলেজে ভর্তি হই, তখন টিভি দেখার সুযোগ হয়। পুরো দুই বছরে একদিন মাত্র নারায়ণগঞ্জের কদমরসুল মাজার রোডের কাছে এক বন্ধুর বোনের বাড়িতে প্রথম টিভি দেখি। তাও কয়েক মিনিট মাত্র। কারণ, ঘরের মেজেতে এত মানুষ বসা ছিল যে, আমি কিছুতেই স্বস্তিতে বসার মতো একটু জায়গা পাইনি।

ফলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বিটিভি-র সাদা-কালো স্ক্রিনের সেই যুগে টিভি মানেই ছিল বহু মানুষের সমবেত বিনোদনের উৎসব। গ্রামে-গঞ্জে তখন বিদ্যুৎ সহজলভ্য ছিল না। যেখানে বিদ্যুৎ ছিল সেখানে কোনো কোনো বাড়িতে টিভি ছিল। লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টেনা লাগানো দেখলে রাস্তা থেকেও বোঝা যেত যে, ওই বাড়িতে টিভি আছে। সন্ধ্যার পরে ঘরের ভিটিতে বা উঠানে পড়ার টেবিল বসিয়ে টিভি রাখা হতো, আর উঠান ভরা থাকত কাছে-পিঠের দশ বাড়ির দর্শক-শ্রোতা।

আর বাঁশের মাথায় লাগানো অ্যান্টেনা ঠিক মতো ঘুরিয়ে স্থাপন করার জন্য ছিল এক্সপার্ট লোক। বাঁশটি যেখানে কোপা হতো সেখানে মাটি সরিয়ে এমনভাবে স্থাপন করা হতো যাতে বাঁশটি সহজেই ঘোরানো যায়। তারপরও কিছুক্ষণ পরপরই বাঁশ সরে যেত, নাকি কী হতো- টিভি ঝিরঝির করতে শুরু করত। বিশেষ করে কোনো জনপ্রিয় অনুষ্ঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহ‚র্তে সেই ঝিরঝিরটা হঠাৎ করেই বেড়ে যেত।

আবার অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ছবি ঠিক করার ওই বিরক্তিকর কাজটি যে করত, তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ বাঁশটি সামান্য এদিক-সেদিক হলেই টিভি ঝিরঝির করতে শুরু করত আর তখনই ওই লোকটিকে উঠে যেতে হতো ঝিরঝিরে রোগ সারানোর জন্য। টেলিভিশনের ঝিরঝিরে কম্পনের সেই যুগে একা কেউ টিভি দেখার সুযোগ পেয়েছে, এমন ঘটনা সহজলভ্য ছিল না। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল তখন একমাত্র চ্যানেল।

বিটিভির খবর, নাটক, বিভিন্ন বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান, বিদেশি অনুষ্ঠানের বাংলা অনুবাদ (ডাবিং) প্রোগ্রাম, সংগীত অনুষ্ঠান, নাচের অনুষ্ঠান, স্টেজ শো, জাদু প্রদর্শন, থিয়েটার প্রোগ্রাম, কবিতা ও কবিদের নিয়ে অনুষ্ঠান, জনসচেতনতা ও উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান ছাড়াও ছিল বাংলা পুরোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শন। ছিল পাপেট শোর মতো ও অন্যান্য শিশুতোষ অনুষ্ঠান, খেলাধুলার অনুষ্ঠান।

মূলত সন্ধ্যা থেকেই শুরু হতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো। আর আস্তে আস্তে ভরে উঠত উঠান। সমবেত সেই বিনোদনের মধ্যে এক ধরনের প্রগাঢ়তা থাকত। সবার মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার বোধ তৈরি হতো এবং আমাদের ভাবনার জগতেও আলোড়ন সৃষ্টি হতো। আমরা সেইসব অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলতাম।

এইসব অনুষ্ঠান দেখে আমাদের বোধবুদ্ধি, অনুভব-অনুভূতি এবং আবেগ নানাভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠত। সেই বিচিত্র অনুভব-অনুভূতি, আবেগ-উচ্ছ্বস ও আনন্দ-বেদনার অংশীদার হতো আমাদের সঙ্গীরা। আর এই সব সমবেত বিনোদনের ভেতর দিয়েও তৈরি হতো বন্ধুত্ব। চলবে

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ