সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘ব্যক্তিগত বিনোদন’

পর্ব ১

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০২৪

সত্তরের দশকের কথা। আমরা তখন খুব ছোট। আমাদের ব্যক্তিগত বিনোদনের একমাত্র বিষয় ছিল গ্রন্থপাঠ। কিন্তু বই তখন সহজলভ্য ছিল না। বললাম বটে ব্যক্তিগত বিনোদনের বিষয় ছিল গ্রন্থপাঠ, আসলে বিষয়টি তেমন ছিল না। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তখন ‘আউট’ বই ছিল সোনার হরিণ। সেই সোনার হরিণ নিয়ে টানাটানি, ঝগড়াজাটি, লুকোচুরি, আড়াল-আবডাল— এইসব করে করে ব্যক্তিগত বলে আর কিছু থাকতো না। আজ এতকাল পর এই ভেবে আনন্দ হয় যে, আমার সাহিত্য পাঠের অভ্যাসটা বয়সের ধারা মেনে হয়নি। অনেকটা কবি রফিক আজাদের সেই দুটি পঙক্তির মতো, “পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূলবই/ বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই।”

একটি বইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। বইটির নাম চিতা বহ্নিমান। ‘চিতা’ কী, ‘বহ্নিমান’ কী জানতাম না। কিন্তু ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি অনেকদিন আমাকে ঘোরের মধ্যে রেখেছে। হয়তো বলতে পারেন, ও তো একা বিনোদন। আসলে একা নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে বন্ধুরা মিলে পড়েছি আর তপন ও তপতীর সম্পর্কের ইতরবিশেষ নিয়ে কত যে ভাবনা ভেবেছি, কত যে কষ্ট পেয়েছি! বিশেষ করে বড় লোকের মেয়ে তপতীকে বিয়ে করে তপনের আত্মত্যাগ আমাদের খুব কষ্টের মধ্যে রেখেছিল। তখন সাহিত্য বুঝতাম না। সাহিত্যমূল্য বিচার করার বোধবুদ্ধি তখন ছিল না। ছিল একমাত্র আবেগ।

ওই উপন্যাসের কথা কলেজ পড়ুয়া এক বড় ভাইকে বললে সে হেসেছিল— অবজ্ঞার হাসি। আর বলেছিল, “রাখ, ফালতু উপন্যাস।” আমরা খুব অসন্তুষ্ঠ হয়ে ওই বড় ভাইকে কত যে গালমন্দ করেছি! “বুদ্ধিসুদ্ধি নাই, বোঝে না কিছু। তুমিই ফালতু।” বই পড়া যে একান্তই ব্যক্তিগত বিনোদন, সেটাও যে আমাদের শৈশবে শেষ পর্যন্ত আর ব্যক্তিগত থাকত না, প্রথমে সেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে নিলাম।

আমাদের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল মক্তব দিয়ে। বাড়িতে মসজিদ ছিল। সেই মসজিদে মক্তব বসতো। কিন্তু আমাদের অনেকটা সময় কেটেছে কয়েক বাড়ি পরে খাঁ বাড়ির মসজিদসংলগ্ন কাচারি ঘরের মক্তবে পড়ে। বড় হুজুর পড়াতেন ওই মক্তবে। তিনি আমাদের বাপ-চাচাদেরও শিক্ষক। আলিফ, বা, তা, কায়দা, কোরআন শিক্ষা থেকে শুরু করে নামাজ শিক্ষা, রোজা রাখা এ সবের ফজিলত সম্পর্কে আমাদের শেখানো হতো মক্তবে। খুব ভোরে আমরা দল বেঁধে মক্তবে পড়তে যেতাম। আসা-যাওয়ার পথে এবং এমনকি মক্তবের ভেতরেও আমাদের গল্পের শেষ থাকত না। কথা বলার জন্য হুজুরের মার খায়নি এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না।

মার খেয়ে আমাদের কথা থেমে যেত, আমরা বেজার হয়ে বসে থাকতাম এমনটাও কখনোই দেখা যায়নি। মার খাওয়ার পরে দু-চার মিনিটের মধ্যে আবার শুরু হতো কথা বলা। একটু আগে হুজুর যে মেরেছেন, তার কোনো চিহ্নও আমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যেত না। মক্তবে আমরা কোরআন পড়তে শিখেছি, নামাজ পড়তে শিখেছি আর শিখেছি আদব-কায়দা। কিন্তু হুজুর যা শেখাননি, অথচ কী করে যেন আমরা শিখে ফেলেছি, তা হলো, যৌথতার ব্যাকরণ। আমরা কেউ একা ছিলাম না, নিঃসঙ্গ ছিলাম না। আমাদের শৈশবের সেই পৃথিবীটা অনেক বড় ছিল, ছড়ানো-ছিটানো ছিল কয়েক গ্রামব্যাপী। সেই বিচরণে একজন বা দুজন অংশ নিত না- পাঁচ-সাতজন ঘুরে বেড়াতাম গ্রাময়। যুথবদ্ধতার ওই ব্যাকরণের মধ্যে অটিজম নিরাময়ের কোনো মহৌষধ আছে কিনা আমার জনা নেই। তবে একটি ঘটনা বলি।

আমরা চাচাতো ভাইয়ের বয়স তখন তিন-চার বছর। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল, সে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। বাক্য পরিপূর্ণ করে না। একই রকম কাজ বারবার করছে। কেউ ডাকলে তার দিকে তাকাচ্ছে না। চোখে চোখ রাখছে না। ওর এমন আচরণ নিয়ে কারো মধ্যে তেমন কোনো উৎকণ্ঠা নেই। বয়স্করা বলতেন “ঠিক হয়ে যাবে”। কীভাবে ঠিক হবে সেটা কেউই জানতেন না। প্রায় অর্ধশতক বছর আগে গ্রামীণ জীবনে শিশুদের দিনব্যাপী হুল্লোরের মধ্যে আমার ওই চাচাতো ভাইটির একা থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। বাড়ির ভেতরে হোক কিংবা বাইরে হোক, তাকে শিশুদের ভিড়ের মধ্যেই থাকতে হতো। এক সময় দেখা গেল, তার ওই অস্বাভাবিকতা কখন যেন কেটে গেছে।

গ্রামীণ জীবনে একজন শিশু কতকগুলো খেলাধুলার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতো। যখন ভালো করে হাঁটতেও শিখিনি তখনই কাচা জামবুরায় লাথি দিয়ে শুরু হতো আমাদের ফুটবল খেলা। একজনে শান্তিতে লাথি দিতে পারত না। কতজন যে জুটে যেত, তার ইয়ত্তা থাকত না। সে সময় থেকেই আমরা বুঝতে পারতাম যে, একান্নবর্তী পরিবারে আমরা যেমন কোনো কিছুই একা খেতে পারতাম না, একা পরতে পারতাম না, একা ব্যবহার করতে পারতাম না, তেমনি বাইরের খেলাধুলার জগতেও একা বলে কিছু ছিল না। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে, খেলতে হবে, খেতে হবে, পরতে হবে।

এই মানস-সংগঠন রচনায় আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিল খেলাধুলা। অঞ্চল বিশেষে খেলাগুলোর নাম ভিন্ন হতে পারে এবং আরো অনেক খেলা আছে যেগুলো সব অঞ্চলে প্রচলিত নয়। খেলাগুলো হলো কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, বৌচি, কুতকুত, দাড়িয়াবাঁধা, ডাংগুলি, মার্বেল, হা-ডু-ডু, কাবাডি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, হাড়িভাঙা, লুকোচুরি খেলা, দড়ির লাফ, দড়িটানা, এক্কা-দোক্কা, আগডুম-বাগডুম, ফুটবল খেলা, লাটিম খেলা, ঘুড়ি উড়ানো, লুডু খেলা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, রাজা-চোর-মন্ত্রী-সেপাই, ওপেন টু বাইস্কোপ এইসব। এগুলো প্রত্যেকটি যৌথ খেলা। একক খেলা বা একক বিনোদন বলে কিছু ছিল না তখন।  খেলাগুলোতে নানা সংখ্যায় পক্ষ-প্রতিপক্ষ নির্ধারিত হতো। সবাই মিলে খেলত, আনন্দ করত, হৈহৈ রৈরৈ করত, ঝগড়া-বিবাদ করত। খেলতে গিয়ে যখনই কেউ আঘাত পেত, হাত-পা কেটে ফেলত, শরীরের কোথাও ফুলে যেত বা থেতলে যেত তখন সেই দুঃসংবাদ যেন কিছুতেই বাড়ি পর্যন্ত না পৌঁছায়, সেই ব্যবস্থা বন্ধুরাই করত।

কারণ তারা জানত যে, বাড়িতে কেউ আল্লাদ করার জন্য বসে নেই। অধিকন্তু যখনই শুনবে ব্যথা পেয়ে এসেছে, তখনই শুরু হবে বকাবকি। আবার কেউ কেউ উলটো মারও খেত। হাডুডু খেলতে গিয়ে একবার পায়ে খুব চোট লেগে ছিল আমার। মাটিতে পা রেখে কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিলাম না। পাহাড়ি লতা ছেচে বন্ধুরা হাটুতে লাগিয়ে দিয়েছিল। আরও কী কী তারা করেছিল, এখন আর মনে নেই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। দুই জন বন্ধু ধরে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। এমন অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনার মুখোমুখী হতে হয়েছে দুর্বিনীত শৈশবে। আর বন্ধুরাই ছিল রক্ষাকবচ। শৈশবে অন্যের গাছের ফলমূল চুরি করেনি এমন কে আছে! সেই চুরিও কি কেউ একা করেছে? নিশ্চই নয়। বেশ কয়েকজন মিলে চুরি করতে হতো। ফলে চুরিটা আর চুরির মতো হয়নি। আমরাও কেউ চোর হইনি। তবে না-বলে কারো গাছের, খেতের, ঘরের কিছু যে আনতে হয় না, এই শিক্ষা পেয়েছে চুরি করতে গিয়েই। কেননা, ধরা তো পড়তেই হতো।

এভাবে তখন যূথবদ্ধ আনন্দের একটি মনোগড়ন তৈরি হতো সবার মধ্যে। দক্ষতা, দায়িত্ববোধ, সামাজিকতাবোধ, সহযোগিতার মনোভাব, নেতৃত্বের গুণাবলি, খাপখাইয়ে চলার মনোভাব, মূল্যবোধ ইত্যাকার মানবিক গুণাবলি তৈরি হতো ওইসব যৌথ খেলাধুলার ভেতর দিয়ে। আর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আজকে যে অর্থে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা ভাবা হয়, তখন তেমন ছিল না। মুররমের সময় অনুষ্ঠিত হতো জারি গান। ‘জারি’ কী জিনিস আমরা বুঝতাম না। কারবালার যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন। সেই হৃদয়বিধারক ঘটনা অবলম্বনে শোকের গান পরিবেশিত হতো এই সময়। গানের সঙ্গে নাচ ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হতো। গ্রামের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষ গভীর শোকের আবহে এই গান উপভোগ করত।

ছিল সারি গানের অনুষ্ঠান। একে ঠিক অনুষ্ঠান বলা যাবে না। কর্মজীবী মানুষ এক সঙ্গে কোনো কাজ করতে গিয়ে যেমন ঘর বানানোর সময়, মাটি কাটার সময়, ফসল চাষের সময়, ঘরের ছাদ পেটানোর সময় এই গান পরিবেশিত হতো। কিন্তু সব কাজের সঙ্গে সারি গান যেত না। এক দল কাঠুরিয়া আমাদের বাড়িতে আসতেন গাছ কাটার জন্য। গাছ কাটতে কাটতে তারা গান গাইতেন। কিন্তু আয়েশ-আয়োজন করে তারা গান পরিবেশন করতেন রাতের বেলা। আমরা শিশু-কিশোররা ওই গান শোনার জন্য রাত জেগে বসে থাকতাম। কিন্তু ওই গানগুলো কোন শ্রেণির গান তা আর বলতে পারব না। কিন্তু খুব মনে আছে গুর, তেজপাতা আর লবণ দিয়ে তৈরি চা খেতে খেতে আর হুকায় টান দিয়ে তারা মাঝরাত পর্যন্ত গান গাইতেন। সেই সব গান নিয়ে, গানের কথা নিয়ে, গায়কদের নিয়ে, তাদের গান পরিবেশনের ভাবভঙ্গি নিয়ে আমরা যে কত আলাপ-আলোচনা করতাম! কোনো কিছুই তখন কারো একার ছিল না। সবকিছুই ছিল সবার।

আমাদের এক জেঠা ছিলেন চিরকালের সুখী মানুষ। দারিদ্র্য কোনো কালেই তার পিছু ছাড়েনি। সেই দারিদ্র্যকে অতিক্রম করার কোনো চেষ্টা কোনো কালেই তিনি করেননি। এক জীবন আপন মনে গান গেয়ে কাটিয়েছেন। সন্ধ্যার পরপরই তার ঘরের সামনের উঠোনে হোগলার বিছানা পেতে বসে পড়তাম আমরা। আমরা মানে কয়েক বাড়ির ছোট-বড় সবাই। আর তিনি কি যে এক আবেশ নিয়ে আমাদের সামনে বসতেন এবং হুকায় টান দিয়ে শুরু করতেন ইউসুফ-জোলেখা, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, বিদ্যাসুন্দর, হানিফা-কয়রাপরি, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, মধুমালতী, পদ্মাবতী, গুলে-বকাওলী আর সতীময়না ও লোরচন্দ্রনীর প্রেমের আখ্যান পরিবেশন। জেঠার সেই গানের কোনো তুলনা আমাদের কাছে ছিল না। জেঠার দরদি কণ্ঠে প্রেমের সেই আখ্যান শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। সেই সব প্রেমকাহিনি নিয়ে কত কথা, কত আলাপ-আলোচনা, কত তর্ক-বিতর্ক যে আমাদের মধ্যে হতো, তা বলে শেষ করা যাবে না।

ওই গানগুলোর গল্প, আখ্যান, আবহ, সুর, তাল, লয় এবং বিশেষ করে জেঠার দরদ আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমাদের মধ্যে আমাদের জন্য, চারপাশের মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য এবং বিশেষত নারীদের জন্য এমন এক বোধ তৈরি করেছে যা ভালোবাসার, সম্মানের, মর্যাদার। কারুণ্যের সেই সলজ্জ ও উজ্জ্বল অনুভূতি কোনো কালেই আমরা অতিক্রম করতে পারিনি।  শুধু তাই নয়, ওইসব গানের ভেতর দিয়েই আমাদের মধ্যে নারী-পুরুষের প্রেমের এক চিরকালীন বোধ তৈরি হয়। তাই বুঝি সেই স্কুলে পড়ার সময় যখন জানতে পারতাম যে, কোনো বন্ধু প্রেমে পড়েছে বা কাউকে মনে ধরেছে তখন সেই সম্পর্ককে আমরা শ্রদ্ধা করতাম। কখনোই খারাপ কোনো চিন্তা মাথায় আসত না। আজ এই পরিণত বয়সেও যখন নর-নারীর প্রেমের সম্পর্কের কথা শুনি তখন তাকে খারাপ চোখে দেখি না, পাপ-পুণ্যের হিসাব কষি না। এই বোধও তৈরি হয়েছে আমাদের সেই সমবেত ভাবনার পটভূমিতে, চিন্তার যৌথতার ঐক্য ও অন্বয়ের ভেতর থেকে।

আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পশ্চিমে ছিল প্রধান বাড়ি। প্রধানদের একটি পরিবার আধ্যাতিক গানের ভক্ত ছিল। আর ওই বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হতো মুর্শিদি গানের অনুষ্ঠান। হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যের বিষয়গুলো তখন বুঝতাম না। ওই গানের অনুষ্ঠানে বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে আমরা অনেক শিশু-কিশোরও উপস্থিত হতাম। থাকত আমাদের প্রতিবেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক বন্ধুরা। কেউ বারণ করত না। অধিকন্তু ওদের আমরা একটু বেশি খাতিরই করতাম। কারণ ওদের বাগানের পাকা গাব আমাদের খুব প্রিয় ছিল। কী যে মায়া আর ভক্তিসহকারে ওইসব গান পরিবেশন করতেন ফকির গায়করা, তা আর কি বলব! আজও মনে আছে “ও তুমি আইসরে দয়াল আমার মুর্শিদ রে।” কিংবা “দয়াল আমার কাণ্ডারি হইও রে।” এইসব গানের সুর, সুরের ভেতরে পুরে দেওয়া দরদ, ভক্তি-শ্রদ্ধা ভোলার মতো নয়। শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে আজও স্মৃতিচারণ করি। বুঝি না, ওই সব গান থেকেই কি আমরা জীবনের প্রতি গভীর মায়া অনুভব করতে শিখেছিলাম?

কিংবা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-পেশা নির্বিশেষ সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব কি তৈরি হয়েছিল ওইসব সম্মিলনের ভেতর দিয়ে? আরও কত রকমের গান তখন পরিবেশিত হতো— ভাওয়াইয়া গান, গাজীর গীত, বিয়ের গীত, কবি গান, পালা গান, ভাটিয়ালি গান এইসব। পাঁচ-সাত গ্রামের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলেও ওইসব অনুষ্ঠানে আমাদের যাওয়ায় তেমন কোনো বারণ থাকত না। আর জারি গানের সঙ্গে জারি নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ আমাদের মুগ্ধ করে রাখত। আর এগুলো ছিল সকল শ্রেণির মানুষের চিত্তবিনোদনের উৎস। এইসব অনুষ্ঠানে যেতে চাইলে মা মাঝেমধ্যে বকাবকি করতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু বাবা ছিলেন উদার। তিনি বলতেন, “যাউক না। গেলে কী হয়? অনেকের লগে দেহা অইব, কতাবার্তা অইব, দোষ কি?” বাবার এই প্রশ্রয়টুকুতে আমাদের বন্ধু-পরিসর অনেক বেড়ে গিয়েছিল। জীবনের অনেক আয়ুধ সংগ্রহ করেছি যূথবদ্ধ ওইসব বিনোদনে বন্ধুদের সান্নিধ্য থেকে।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ