সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘বিদায় এনসিটিবি’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৩, ২০২৪

৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার। এনসিটিবির মেম্বার থেকে আমার বদলির আদেশ হলো ঝিনাইদহের কেসি কলেজে। বুড়ো বয়সে সরকারি চাকরি পেয়েছিলাম। তার আগে টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি স্কুলে চার মাস, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে তিন বছর এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে সাত বছর চাকরি করেছি। আমার বয়স যখন ৩৪ বছর তখন সরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরি। সুতরাং বদলি যে সরকারি চাকরির অনেক শর্তের মধ্যে অন্যতম একটি, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই বদলি আমার জন্য কিংবা আমার পরিবারের লোকজনের জন্য কখনোই দুঃসংবাদ নয়।

আমার স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে ঢাকার বাইরে আমার বদলিতে যদি সামান্যতম কষ্ট পেতো তাহলে আমার খারাপ লাগত না। ভালোই লাগত। কিন্তু এই ভালো লাগার পথে আমিই পেরেক ঢুকে দিয়েছি। তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, সরকারি চাকরি চিরকালই বদলিযোগ্য। এখন দেশটা খুব ছোট হয়ে গেছে। সুতরাং বদলি হলেও খুব বেশি দূরে যেতে হয় না। কিন্তু পাকিস্তান আমলে কিংবা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সরকারি চাকরিজীবীদের যেখানে বদলি করা হতো, দূরত্বের দিক থেকে তার কোনো তুলনা হয় না। ঢাকাবাসী একজন কর্মচারীকে বদলি করা হলো করাচিতে কিংবা লাহোরে কিংবা বোম্বেতে আর সবচেয়ে কাছের কলকাতায়।

সেখানেই তাকে যেতে হতো, চাকরি করতে হতো। আজকে সেই অবস্থা নেই। স্বাধীন হয়ে হয়ে দেশ অনেক ছোট হয়েছে। প্রথমে ভারতবর্ষ, সেখান থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা পেয়ে বাংলাদেশ। সুতরাং বদলি অনিবার্য এবং সেটা নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। এইসব কথা তারা ধারণ করেছে এবং আমার বদলি নিয়ে কখনোই তারা উৎকণ্ঠিত হয়নি, কষ্ট পায়নি। কিন্তু এখন মনে হয়, যদি তারা এক-আধটু কষ্ট পেতো, একটু হাহুতাশ করতো এবং বদলি যারা করল, তাদেরকে গালমন্দ করতো, তাহলে খারাপ লাগত না। এমন পরিস্থিতিতে আমার যে খারাপ লাগে না, তা নয়। লাগে। আর সেটা হলো, যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়া নিয়ে।

এই তিনটি ক্ষেত্র স্বচ্ছন্দ, আরামদায়ক ও পরিচ্ছন্ন না হলে আমার কষ্ট হয়। সুতরাং আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে, ঝিনাইদহে আমার জন্য সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। যতদিন আমি ওখানে থাকি, আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে, অনেক ভুগতে হবে। যদি থাকা-খাওয়ার জায়গাটি ভালো না হয়, তাহলে আমার লেখালেখিও বন্ধ থাকবে। ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়েছিলাম যে, খিলগাঁও থেকে ঝিনাইদহে যেতে হলে আমাকে প্রথমেই যেতে হবে গাবতলী। খিলগাঁও থেকে গাবতলী যেতে আমার দেড় ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। সিএনজিতে যাওয়ার বিলাসিতা করার সুযোগ আমার নেই। আমাকে যেতে হবে পাবলিক বাসে চড়ে। সেখান থেকে ঝিনাইদহ।

বদলির পরে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে কখনই আমি কালবিলম্ব করিনি। কী সব সুযোগ-সুবিধা আছে। কয়েকদিন পরে যোগদান করা যায়। আমি সেই সব সুযোগ কোনো কালেই নিইনি। বদলির আদেশ হওয়ার পর দিনই আমি চেষ্টা করেছি নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে। এক্ষেত্রে এক ধরনের কৌতূহল ও আনন্দই অনুভব করি। নতুন কর্মস্থল, নতুন জায়গা, নতুন জনপদ, নতুন মানুষ, নতুন চ্যানেল এই বিষয়গুলো আমার বেশ আগ্রহের। সুতরাং ৬ এপ্রিল, ২০১৭ তারিখ বৃহস্পতিবার আমরা বদলির আদেশ হলো। ৯ তারিখে আমি রিলিজ নিলাম এবং পরদিনই ১০ এপ্রিল ঝিনাইদহের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

শীত শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু উষ্ণতম এই মাসটির আজকের দিনটিতে প্রকৃতির মধ্যে কেমন একটা শীতলতা বিরাজ করছে, যেন শীত আর বসন্তের সন্ধিলগ্ন। সকালে উষ্ণতা ২৭ ডিগ্রির বেশি ছিল না। আকাশের মেঘমালা ভূমির খুব কাছে নেমে এসেছিল। লো ক্লাউডসের এমন একটি সকাল আমার ভেতরে সুখের গুঞ্জরন এনে দেয়। ভেতরে ভেতরে আমি গাইতে থাকি দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত, বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ/আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ।

এই সুখ বেশিক্ষণ থাকে না। খুব দ্রুতই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। কিন্তু একই তালে আর্দ্রতা বেড়ে না যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি। এর মধ্যে দুপুর হয়ে গেল। ব্যাগ-পত্তর নিতে হবে, সঙ্গে সামান্য কিছু বই। সুতরাং পুত্র সিএনজি নিয়ে এলো। সিএনজিতে উঠে আমার মনে হলো, বহুদিন পর একটি নির্ভার দিন। মনে হলো কোনো দায় নেই, দায়িত্ব নেই, অফুরন্ত কাজের অমানবিক অত্যাচার নেই। কিছুই নেই। বছরের পর বছর নিরন্তর প্রেসারের মধ্যে থেকে থেকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, নিয়মানুবর্তিতা, দায়-দায়িত্ব, আদের্শ-নির্দেশ এবং কাজ আর কাজ আর কাজের বাইরেও মানুষকে কিছু সময় নিজের কাছে যেতে হয়,  একান্ত নিজের কাছে।

বহু বছর পরে আমি যেন আমাকে খুঁজে পেলাম। এখন আমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কোনো কিছু নিয়েই আমাকে আর ভাবতে হবে না। দিন নেই, রাত নেই, ছুটি নেই, ঈদ নেই, পুজা নেই, পার্বণ নেই।  সব এখন আমার কাছে সমান। সারাক্ষণ ঊর্ধ্বতনদের ফোন আর আদেশ-নির্দেশ আর ঝারিঝুরিতে তটস্ত থাকার দিনও শেষ। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! আমি ফিরে যাচ্ছি আমার প্রিয় শিক্ষকতার পেশায়। আমার এখন সময় কাটবে অফুরন্ত প্রাণের ঐশ্বর্যে ভরপুর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। কী যে একটা সুখ অনুভব করছিলাম! কিছুতেই মনে হচ্ছিল না এনসিটিবির মেম্বার থাকাকালে আমার এসি ও এটাস্টেট বাতসমেত একটি বিশাল রুম ছিল এবং রেস্ট নেওয়ার জন্য অফিস কক্ষের সঙ্গে আরেকটি ছোট রুম ছিল।

ফুল টাইম পাজেরো গাড়ি ছিল, ড্রাইভার ছিল, পিএস-পিয়ন ছিল। এসবের ভেতরে আমি যে খুব সুখ লাভ করতাম, তেমন নয়। ব্যক্তিগত গাড়ি কখনোই আমার প্রিয় যানবাহন নয়। আমার বাবা হাঁটতে পছন্দ করতেন চিরকাল। মা বলতেন, রাস্তা দেখলে তোর বাপের হাঁটতে ইচ্ছা হয়; আর মানুষ দেখলেই ইচ্ছা হয় কথা কইতে। আমি আমার বাবার সবটুকু পেয়েছি। আমারও হাঁটতে ভালো লাগে, মানুষের সান্নিধ্য ভালো লাগে। ব্যক্তিগত গাড়ি এই দুটি স্বাধীনতা হরণ করে।

এনসিটিবিতে আমি আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা পেয়েছি। বেতনের বাইরে পেয়েছি ৪-৫টি অতিরিক্ত বোনাস। নানা রকম কাজের জন্য পেয়েছি সম্মানী। আমি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছি এই প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করে। এখানে অসাধারণ একটি কাজের পরিবেশ ছিল। কাজ, কাজ আর কাজ। কিন্তু সেই কাজ নিরানন্দময় ছিল না। একঝাঁক যুবক কাজ করতেন এনসিটিবিতে। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন কাজ পাগল আর আধ পাগল। তাই চিরকাল আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি। এদের সান্নিধ্য আমার জন্য ছিল বেঁচে থাকার আয়ুধ। এদের নিয়ে পরে লিখব।

এহেন এনসিটিবিকে ছেড়ে যাওয়ার পরেও আজ আমার মধ্যে মুক্তির আনন্দ খেলা করছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমি শিক্ষক এবং বিভাগের চেয়ারম্যান। এরই মধ্যে আমি প্রায় নয় বছর কলেজে শিক্ষকতা করেছি। আমি জানি শিক্ষকতার পেশায় কতটা অফুরন্ত সময় হাতে থাকে এবং এই পেশাটি কতটা নির্ঝঞ্ঝাট। তারপর আমি বিভাগে চেয়ারম্যান। আমার সঙ্গে একঝাঁক তরুণ ও যুবক শিক্ষক থাকবেন। সুতরাং, কোনো অসুবিধা নেই। তবে একটি বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম যে, আমাকে ঢাকা থেকে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আমি কিছু মনে না করলেও, মনে করার অনেক লোক আছে। তারা আমার সান্নিধ্যকে সহজভাবে নেবেন না। অধিকন্তু আমাকে নিয়ে তাদের নিজস্ব কিছু মূল্যায়ন আছে। সেই মূল্যায়ন সহজ নয়। সুতরাং আমাকে সচেতন থাকতে হবে এবং যতটা পারা যায় নির্জন থাকতে হবে। আর সেই সময়টুকুতে লেখালেখি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আমি গাবতলী চলে এসেছি, তা বলতে পারব না। এখানে এসে দেখলাম ঝিনাইদহে যাওয়ার জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি আছে। শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে এসি গাড়ি আমার খুব প্রিয়। বিশেষ করে দূর-যাত্রায় আমি ধুলি-বালি, প্রচণ্ড বাতাস আর রোদ-বৃষ্টি একদম পছন্দ করি না। সুতরাং আমার মন আরও ভালো হয়ে গেল। দুপুর গড়াতে না-গড়াতেই দিনের শরীরে নেমে এসেছিল রাতের কোমলতা।  রোদে তেমন প্রখরতা নেই। তাপমাত্রা নিশ্চয়ই তিরিশের অধিক। কিন্তু সংক্ষুব্ধ নয়। এই কিছুদিন পূর্বেও সূর্য যে প্রচণ্ড মূর্তি ধারণ করে পৃথিবীকে পুড়িয়েছে, সেই তাপ, সেই তেজ, সেই দাহ আজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। দূর আকাশে কুয়াশার একটি ক্ষীণ রেখা প্রলম্বিত হচ্ছিল, আর সেই রেখার চারপাশে সাদা মেঘের ভেলা ধীরেসুস্থে আপন মনে হাতি-ঘোড়া, ফুল-পাখি আর কার কার যেন অবয়ব ধারণ করে চলছিল। কোনো তাড়া নেই, দুরন্তপনা নেই। শরতের মেঘের মতো সৌম্য রূপ তার, ধ্যানমগ্ন প্রাচীন ঋষি।

আমি একটি এসি গাড়িতে উঠে বসে ছিলাম। কিন্তু সারাটা পথ জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমি বাইরের এই মহামহিম প্রকৃতির রূপ আর সৌন্দর্য, তার প্রশান্ত মূর্তি, কখনো কখনো তার চিরায়ত সন্ন্যাস গ্রহণ আপন মনে উপভোগ করছিলাম। গাড়ির গতিতে উদ্ভিদ, বৃক্ষ, বিটপী তাদের নব পত্রপল্লব আর ফুল দেখিয়ে না-দেখিয়ে দ্রুত পিছনের দিকে সরে যাচ্ছিল। একই তালে কত বিচিত্র জন আর জনপদ দ্রুত লয়ে সরে যাচ্ছিল! গাড়ি এখন কোথায়, আরিচা কত দূরে তা পরখ করার জন্য আমি সাইনবোর্ডের লেখ পড়তে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু দোকানপাট আর প্রতিষ্ঠানের নাম যতটা বড় করে লেখা হয়, ঠিকানার মধ্যে স্থানের নামটা ততই ছোট করে লেখা থাকে। মানুষের এই কার্পণ্যের কোনো মানে হয় না। সুতরাং স্থানের নামটি খুঁজে পাওয়ার আগেই পিছনের কোন অতীতের দিকে হারিয়ে যায় জনপদ। একসময় গাড়িটি মানিকগঞ্জ অতিক্রম করে নিরবচ্ছিন রাস্তায় প্রবেশ করে। ১৯৯৯ সাল থেকে এই পথ কতবার অতিক্রম করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আজও মনে হয় আমি এই জনপদের কোনো স্থানের নামই বলতে পারব না। এই আমার এক চিরকালের বিস্মরণ ক্ষমতা।

আরিচা ঘাটে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এই এপ্রিলের বসন্তকে আহ্বান জানানোর কিংবা বসন্তের আগমনের জন্য বৃক্ষাদির পত্রপুষ্প অবারিত করে দেওয়ার পৌরাণিক কোনো তাড়া নেই। বরং একটি অস্বস্তিকর ভেপসা গরম পার করে ফেরিতে উঠতে হলো। এসি গাড়ি থেকে নেমে আসার জন্য এমনটা লাগছে, শতভাগ তা নয়। মনে হলো, কখন যেন বায়ুতে পানির পরিমান কমে গেছে, আর বাতাস মানুষের শরীর থেকে পানি নিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করছে। শুষ্ক বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমারও বেশ জলপিপাসা পেয়েছে। এক বোতল পানি নিয়ে আমি ফেরিতে গিয়ে উঠলাম। তখন সন্ধ্যা ৭টা।

মানুষের বিপুল কোলাহল, হকারদের চিৎকার, যাত্রীদের হুড়োহুড়ি এবং বাতরুমের সামনের বিশাল কিউ অতিক্রম করে আমি সোজা চলে গেলাম উপরে। সেড দেওয়া ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আমি জলের উপরে বিপুল আকাশটার দিকে তাকালাম। পূর্ব-দক্ষিণ পাশে, বিশাল নীল কাশাটার ওই নির্জন দিকটাতে ওকি দিচ্ছে একফালি চাঁদ। কাছেপিঠে তার কেউ নেই। আকাশে তার সহযাত্রীরা যার যার মতো কোথায় আছে কে জানে। অফুরন্ত নীলের মধ্যে এমন নির্জন, এমন একা, এমন নিঃসঙ্গ! মানুষ কখনো হতে পারে এমন! আমার খুব ইচ্ছে হয়। মন বলে, ওই নির্জন চাঁদের মতোই আমিও যদি একা হতে পারতাম!

অসংখ্য মানুষ ফেরির রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মা আর তার জলের উপরে জনজীবন দেখছে। পদ্মার উপর জেগে উঠা চরের জনপদ দেখে দেখে কেউ চা পান করছে, সিগারেট ফুকছে, পান খাচ্ছে। ব্যস্ততার মধ্যে প্রশান্তির এই রূপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফেরির মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা তো থাকেই। কিন্তু অসংখ্য মানুষের অফুরন্ত কোলাহলের ভেতরে কোথায় যেন প্রতিটি মানুষই নিজেকে পদ্মার রূপৈশ্বর্যের মধ্যে আবিষ্কার করতে চাচ্ছে নিজেকে। একটু ভালোলাগা, একটু নিজেকে খোঁজা, নিজের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ডুব দেওয়া,  এইসব মনে হয় আমাকেও অভিভূত করে তুলল। ফেরি চলছিল দ্রুতই। মনে হচ্ছিল, পদ্মার বুকে কোলাহলে ভরপুর মানুষের ব্যাক্তিগত নির্জনতা আরও কিছুক্ষণ থাকুক। কিন্তু ব্যক্তির এই চাওয়ার কি কোনো মূল্য আছে! হয়তো এই আনন্দটুকু নিজের মধ্যে সযত্নে লালন করার মধ্যেই এর যা মূল্য। এইটুকু কম কিসে!

ফেরিঘাট এখনো বেশ দূরে। উপর থেকে নিচে নেমে আসার জন্য এর মধ্যেই মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্থিরতা হুড়োহুড়িতে পৌঁছল। ফেরি ঘাটে এসে পৌঁছুতে না-পৌঁছুতেই হুড়োহুড়িটা মহা হুলস্থুলু হয়ে উঠল। ফেরি থেকে নামতে হবে আমাকে। উঠতে হবে আবার বাসে। এক গতির আনন্দ থেকে অন্য গতিতে সমর্পণ। গতি মানুষের ভেতরে, তার দেহে এবং মনে কী প্রেরণা সঞ্চার করে, জানি না। কিন্তু এইটুকু অনুভব করি, গতি মানুষের ভাবনায় রক্ত সঞ্চালন করে, মানুষের মধ্যে নতুন নতুন মুখরতা তৈরি করে, নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়। এ জন্যই বুঝি, পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, বিশ্বচরাচর নিরন্তর গতিময়। গতি নেই তো সৃষ্টি নেই। মানুষের ভেতর থেকে এই গতি যখন থেমে যায়, তখন সে আর বেঁচে থাকে না। তাই কে একজন বলেছিলেন গতিই জীবন।

গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমার পাশে যিনি বসেছিলেন, তিনি নেই। তার জন্য গাড়ি ছাড়তে পারছেন না ড্রাইভার। হেলপার আমাকে বলল, ও ভাই চিনেননি হেরে আমনে?
বললাম, না, চিনি না।
হালার চুদিয়া যাত্রী। কই যাবি, কইয়া যাবি না! এহন তোরে আমি কই খুঁজি? হালার যাত্রী, থুইয়াই যাইতে অইব।

বাসের যাত্রীরা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। ওই নিখোঁজ যাত্রীকে নিয়ে উষ্মা প্রকাশ চলছে, আক্কেল কী মানুষের! কমন সেন্স নাই। ফালতু!
এমন সময় তিনি আসলেন। মুখ ভরা পান। তাড়াহুড়া করে সিগারেট শেষ করতে পারেননি। বাসের গেটে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেটে কয়েকটা টান দিতে চেয়েচিলেন। কিন্তু শুনতে পাচ্ছি, হেলপার বলছেন, ধুর মিয়া, ফালান আমনের সিগারেট। আধ ঘণ্টা বসায়া রাখছেন আমনে। এইডা কি আমনের প্রাইভেট গাড়ি? যান যান, ওডেন। ওস্তাদ আইছে। বিসমিল্লাহ কইয়া ছাড়েন গাড়ি।

যাত্রীরা তার দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং আশ্বস্ত হয়ে যার যার মতো নিশ্চিন্ত হয়ে বসেন। প্রচুর জর্দাসমেত তাম্বুলভোজী এই সহযাত্রীর সঙ্গে আমার একটি কথাও হয়নি। কারণ মোবাইল থেকে এক মুহূর্তের জন্য তিনি মাথা উপরে তুলেননি। তিনি এসে বসলেন। কিন্তু একেবারেই নির্বিকার। আবারও মোবাইলে ঝুঁকলেন।

গতির মধ্যে জীবন ও জগৎ অন্য এক তাৎপর্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। স্থিরতা ও দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সেই জীবন ধরা দেওয়ার মতো ফুরসৎ পায় না। আর এই জীবন হলো, মানুষের ভাবনার স্তরে স্তরে প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে সেই জীবনের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, সংক্ষোভ, বেদনা, হতাশা, আনন্দ এবং ভাবনার মধুরতা। এই সবকিছুই যেন খুব পরিচ্ছন্নভাবে ধরা দেয় গতিশীলতার মধ্যে।

এই পথ দিয়ে আমি কতবার ফরিদপুর আসা-যাওয়া করেছি। এই পথ আমার কাছে খুবই পুরাতন। পুরনো পথে পথের কৌতূহল থাকে না। কৌতূহলের ওই সময়টুকু কাজের সময়ের মধ্যে চলে যায় বলে পুরোনো পথ অতিক্রম করতে সময় কম লাগে। পথের দৈর্ঘ্য সমান থাকলেও ভাবনার দৈর্ঘ্য কমে যায় বলে পথের মানসিক দূরত্বও কমে যায়। আবার পুরাতনের মধ্যে কিছুই ঠিকমতো ধরা দেয় না। প্রথাগতের এই হলো প্রাণহীন স্বরূপ। কিন্তু আজ কেনো যেন সবকিছু নতুন বলে প্রতীয়মান হলো। মানুষের চিন্তা, তার প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার মধ্যে কোথাও এমন একটি মাত্রা আছে, যেখানে ভাবনা স্থির করে দেয় পথ চলার স্বরূপ। আমি ঠিক জানিনা, ঝিনাইদহ কত দূরে। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল, পথ যেন শেষ হয় না।

কেন এমনটা মনে হচ্ছিল, সেটা আমি ঠিক স্পষ্ট করে, বোধগম্য ভাষায় লিখতে পারবো না। কিন্তু এই যে পথ শেষ হচ্ছে না, তার জন্য আমার মধ্যে কোনো রকমের তাড়া নেই, কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। অধিকন্তু মনে হচ্ছে, ভালোই তো। ভাবনা বলাকার মতো পাখা পেয়েছে, আর পেয়েছে অনুকূলে প্রবাহিত বায়ুর গতি। সুতরাং পথ শেষ না হলেই ভালো। ঝিনাইদা কতটা দূরে সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ ২০০৫ সালে একাধিক বার আমি ঝিনাইদা গিয়েছি।

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কৌশল ও শিক্ষার্থী মূল্যায়নের বিষয় নিয়ে আমি দুই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কথা বলেছি। সন্ধ্যার পরে ঝিনাইদহ শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেরিয়েছি। সারাদিনের ব্যস্ততার পরে বিকেলটা বেশ আনন্দে কাটিয়েছি। কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে অনেক সম্মান করেছেন, প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আদর-আপ্যায়ন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা আমি ভুলে যাইনি। কিন্তু সেই ঝিনাইদা শহর আজ কেন আমার কাছে এতটা অপরিচিত মনে হচ্ছে এবং কেনই বা তার দূরত্ব সম্পর্কে আমার মাথায় কোনো তথ্যই কাজ করছে না, তার রহস্য স্পষ্ট নয়।

তবে আজকের যাওয়াটা একেবারেই ভিন্ন রকম। আমি অতিথি নই। আমাকে ওখানে থাকতে হবে। অন্য একটি জীবন ওখানে যাপন করতে হবে। অনেক প্রতিকূলতা হয়তো থাকবে। কিন্তু  তার পরেও একটি নতুন জায়গায় থাকা, নতুন এক জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করা, এই তৃষ্ণা আমার কোনো দিনই মিটবে না। আমাকে কোথায় বদলি করা হলো, সেই বদলিটা শাস্তিমূলক কি না, এইসব ভাবনা আমাকে কখনোই আক্রান্ত করেনি। আমার মনের শান্তি বিনষ্ট করেনি।

একজীবনে আমি কখনোই হতাশাগ্রস্ত হইনি। জীবনের প্রতি গভীর এক আকাঙ্ক্ষা, তৃষ্ণা ও  প্রগাঢ় মমত্ববোধ সারাটা জীবন আমাকে অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করেছে। আজও এই ৬১ বছর বয়সে এসে অনুভব করি, জীবন অসাধারণ, বেঁচে থাকার মতো আর কিছু হয় না। ফলে বেড়ে উঠার এক সহজাত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এই সত্য কী করে যেন আমার মধ্যে প্রগাঢ়ভাবে চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে গিয়েছে যে, জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকার মতো মহার্ঘ্য আর কিছুই হতে পারে না।

জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, অনেক প্রতিকূল অবস্থার শিকার হতে হবে, কখনো কখনো সেই প্রতিকূলতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠতে পারে যে, অস্তিত্ব বিনাশের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। কিন্তু তারপরেও বেঁচে থাকাই চূড়ান্ত। এর বাইরে আর কোনো সত্য নেই, আর কোনো সুন্দর নেই, আর কোনো মহার্ঘ্য নেই। সুতরাং আমি প্রবলভাবে জীবনোৎসুক হংসের মতো এই জীবন যাপনের জন্য চিরকাল তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকি। কতদিন বেঁচে থাকব জানিনা। কিন্তু এই জীবনতৃষ্ণা কোনো কালেই মিটবে না। এর মূলে আছে মানুষকে ভালোবাসা, প্রকৃতিকে ভালোবাসা এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ ও অপ্রাণ সদস্যকে গভীরভাবে অস্তিত্বের সঙ্গে বরণ করে নেওয়া। আমার এক জীবন বেঁচে থাকার এই হলো আয়ুধ।

খুব বেশি সময় লাগল না, ঝিনাইদা এসে নামলাম এবং যেখানে বাস থামল সেখানেই একটি হোটেলে সামান্য কিছু খেয়ে নিলাম। এডিসি সাহেবের সঙ্গে আগেই আমার কথা হয়েছিল। এখন আবার তাকে ফোন করলাম। তার নাম আমি ভুলে গেছি। তিনি খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন। তিনি বললেন, সার্কিট হাউজে আপনার জন্য সিট বরাদ্দ করা আছে। এখান থেকে রিকশায় খুব সহসাই আপনি সার্কিট হাউসে পৌঁছতে পারবেন।

এভাবে একে একে তিনবার গিয়ে আমি সার্কিট হাউজে থেকেছি। কিন্তু চতুর্থবার এডিসি সাহেব জানালেন যে, সার্কিট হাউজে কোনো সিট খালি নেই। আমাকে থাকতে হবে কলেজের সামনেই জেলা পরিষদের বাংলোতে। মূলত এখান থেকেই ঝিনাইদহ কেসি কলেজে আমার অন্য একটি জীবন শুরু হয়।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ