সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘একাকিত্বের দিনরাত’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৫, ২০২৪

ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের ডাকবাংলোটি কেসি কলেজের ফটকের উলটো পাসে। আমি যথারীতি ব্যাগ হাতে দোতালায় গিয়ে পৌঁছলাম। কোথাও কেউ নেই। ভুতুরে পরিবেশ। আলো আছে শহরের বারের মতো। কেউ আছেন, কেউ আছেন বলে ডাকাডাকি করলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দোতলায় একটি বিশাল রুম। অনেকটা খোলা হলরুমের মতো। কয়েকটি দরজা। সবগুলো খোলা। ভেতের পাঁচ-ছয়টি চকি বিছানো আছে। প্রতিটি চকির উপর মশারি টাঙানো। অবাক কাণ্ড। বাইরে ব্যাগ রেখে আমি ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আলো নেই। বারান্দার ক্ষীণ আলোতে ভেতরটা দেখা যায়। কিন্তু কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। আমার বাথরুম ব্যবহার করা দরকার। বাথরুমটি কোথায় আছে তা কিঝুতেই পাচ্ছিলাম না। অগত্যা আমি বেরিয়ে আসলাম। এক রাতের জন্যও এখানে থাকা সম্ভব নয়। কোথাও ব্যবস্থা করতে না পারলে হোটেলের খোঁজ নেব। তবুও ভাবলাম, এডিসি সাহেবকে ফোন করা যেতে পারে।

এডিসি সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি যথারীতি ফোন ধরলেন। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “কোনো অসুবিধা হয়েছে?” আমি বললাম, “ভাই, আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করছেন। বেশ কয়েকবার সার্কিট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। এখন ঝিনাইদহ জেলার ডাক বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু এই বাংলোটি আমার থাকার জন্য একদম অনুপযোগী। এখানে কিছুতেই আমি রাত্রিযাপন করতে পারব না। আপনি দয়া করে যদি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আমার জন্য খুব ভালো হয়। অন্যথায় আমাকে শহরের কোনো হোটেল খুঁজে নিতে হবে।” তিনি কিছুমাত্র চিন্তা না করে আমাকে বললেন, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি দেখছি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করা যায় কি না।”

বারান্দার ওই ক্ষীণ আলোতে দাঁড়িয়ে আমি রাস্তায় চলাচলরত মানুষ আর যানবাহন দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এই স্বল্প আলোর মধ্যে এই অবস্থায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ যদি ভূতের ভয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং আমার উচিত, ধীরে ধীরে এই ভুতুড়ে বাংলোটি পরিত্যাগ করা। আমি স্বল্প আলোতে সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম এবং হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে একটি টি স্টলের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। খুব যে বেশি সময় লাগল, তা নয়। এর মধ্যেই এডিসি সাহেব আমাকে ফোন করলেন। বললেন, “আপনার জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা করা গেছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের কার্যালয়ে কয়েকটি রুম আছে। এর মধ্যে দুটি রুম খুব ভালো। ওখানকার একটিতে আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আপনি চলে যান। সড়ক ও জনপদ বিভাগটি মূল রাস্তার উপরে। শহরের বড় কবরস্থানের কাছেই।”

বেশ কয়েকজনকে ওই জায়গাটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কারণ, রিকশা নিতে হলে তো জায়গাটার কথা বলতে হবে। কিন্তু খুবই অবাক কাণ্ড, কেউই ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না। আমি বিস্মিত হলাম। কবরস্থানের পাশে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় কারো কাছে জানা নেই, এটাও কি বিশ্বাস করতে হবে? অগত্যা আমি কলেজের প্রিন্সিপাল ড. রেজাউলকে ফোন করলাম। তিনি আমাকে রীতিমতো হতাশ করলেন। বললেন, “ওটা তো একটা পরিত্যাক্ত বাড়ি। ওখানে আপনার থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। সম্ভবত পিয়ন, দারোয়ান বা এ ধরনের নিম্ন আয়ের কিছু মানুষ ওখানে থাকে। আপনাকে ওখানে থাকার ব্যবস্থা করল কে?” আমি আর কোনো কথা বললাম না। আমার মনে হলো, এটা সম্ভবত ঠিক নয়। ড. রেজাউল কোথাও একটা ভুল করেছেন। আমি একটি মোটর চালিত রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেলাম কবরস্থানের পাশে। সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউই বলতে পারল না।

অগত্যা যেদিক থেকে গিয়েছি, আবার আমি সেদিকে ফিরে এলাম। বাস থেকে যেখানে নেমেছিলাম, ঠিক সেখানে। এখানে এসে আবার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। তাদের একজন বললেন, “কবরস্থান পর্যন্ত যেতে হবে না। তার আগেই হাতের বাঁদিকে সড়ক ও জনপদ বিভাগের অফিস।” আমি ওই জায়গাটা অতিক্রম করে একবার কবরস্থান পর্যন্ত গিয়েছি, একবার এসেছি। কিন্তু আমার চোখে পড়ল না কেন! ভাবলাম, হতে পারে, ভেতরে কোনো একটা অস্থিরতার জন্য হয়তো। সুতরাং আবার আমি কবরস্থানের দিকে রওনা দিলাম। রিকসাওয়ালাকে বললাম, আস্তে আস্তে যাবেন। তিনি তাই করলেন। আমি দেখলাম, খুব বেশি দূরে নয়। হাতের বাঁদিকেই সড়ক ও জনপদ বিভাগের অফিসটি। বিশাল ফটকের এই অফিসটি কেন আমার চোখে পড়ল না, তা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।

রিকসাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ফটকের এক পাশ দিয়ে একটু দরজার মতো।  ঢুকে দেখি, হাতের বা পাশে মসজিদ আর ডান পাশে ক্লাব। বিনোদনের জন্য একতলা একটি স্থাপনা। সেখানে বেশ কয়েকজন লোক তাস খেলছেন, টেলিভিশন দেখছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। আমি তাদের একজনকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি এখানে থাকতে এসেছি, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব?

কিছুটা আলো-আঁধারের মধ্যেই আমি লক্ষ্য করলাম, সামনে বিশাল একটি চত্বর। সেই চত্তরটির দুপাশে অস্থায়ী কয়েকটি স্থাপনা। আর বাকি সবটুকু গাছ-গাছালিতে ভরপুর। গেট থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এর ভেতরে একটি ডুপ্লেক্স বাংলো আছে এবং সেই বাংলোর এক পাশে কলেজের মতো লম্বা একটি তৃতল ভবন। ওই বাংলোটি জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর আবাসস্থল। চতুর্দিকে উঁচু দেয়াল। ভেতরটা সম্পূর্ণরূপে বৃক্ষাচ্ছাদিত। বাংলোর ফটকের পাশে গার্ডরুম। স্বল্প বয়সী একটি ছেলে বসে আছে। প্রহরীদের ওই রুম থেকে কিউর মতো ছিদ্র করা। প্রহরীদের সেই রুমটি গেটের ভেতরে। কিন্তু বাইরের লোকজন চলাচল দেখার জন্য এবং কোনো অভ্যাগত অতিথির আগমন দেখার জন্য একটি চৌকো ছিদ্র দিয়ে ওই কিশোর আমাকে দেখছিল। আমাকে নিয়ে যাওয়া লোকটি আমার পরিচয় দিলেন।

ছেলেটি দ্রুত বের হয়ে এসে আমার হাত থেকে ব্যাগটি নিতে নিতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি খাবানে? নাকি এক দৌড়ি গিয়ে খাউন লইয়ামুনে?” ওর আঞ্চিক ভাষা বুঝতে আমার সামান্য অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু দ্রুতই আন্দাজ করে নিলাম এবং বললাম, “দরকার হবে না। আমি খেয়ে এসেছি। তোমার নাম কী?” “আমার নাম? নিতাই।” বললাম, “বাহ্! খুব সুন্দর নাম। তবে পুরনো। এখন আর কেউ রাখে না। কিন্তু খুব সুন্দর নাম। নাম-দাম কিছুই আমার মনে থাকে না। তবে তোমার নামটা বেশ পরিচিত। তোমার নাম ভুলব না।” ছিপছিপে লম্বা এই কিশোরটিকে প্রথম দেখাতেই আমার বেশ ভালো লেগে গেল। উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের মধ্যে দৃঢ়তা আছে। মুখে সহজ-সারল্যের ছাপ। আচরণে সপ্রতিভ, দায়িত্বশীল, আন্তরিক। শুরুটাতে মনে হলো এখানকার সময় আমার জন্য বেশ কল্যাণকর হবে। মনে হলো, এই ছেলেটি যদি আমার দেখবালের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে মন্দ হবে না।

তিনটি কলাপসিবল গেটের তালা খুলে খুলে নিতাই যখন আমার রুমটির কাছে পৌঁছল, তখন আমি নিরাপত্তার কথা ভেবে শঙ্কিত হব, নাকি খুশি হব, বুঝতে পারছিলাম না। নিচের তলায় একেবারে রাস্তার পাশে যে গেট, সেটিতে অধিকাংশ সময় তালামারা থাকে না, ভেজানো থাকে। কিন্তু দোতলায় কলাপসিবলের পর পর দুটি ফটক থাকে তালাবদ্ধ। তারপর আমার থাকার রুমটি। নিতাই রুমের তালা খুলে যখন ভেতরের আলো জ্বালিয়ে দিল, আমি তখন আনন্দে অভিভূত। তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেল-রুমে যে ধরনের ব্যবস্থা থাকে, তার সবই আছে এই রুমটিতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমটিতে কুইন সাইজ একটি ম্যাট্রেস, উন্নতমানের ও আরামদায়ক বেডসিট, কম্বল ও কুশন। অতিরিক্ত কম্বল ও কুশনও আছে। বড় পর্দার একটি টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, একটি সোফা, দুটি চেয়ার, পোশাক রাখার জন্য একটি আলমারি। চেয়ারসহ একটি ড্রেসিং টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও আরও  একটি চেয়ার।

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য ড্রয়ারসহ একটি টেবিল। বাথরুমটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। গরম পানির ব্যবস্থা থেকে শুরু করে একটি আধুনিক বাথরুমে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তার সবই ছিল ওই বাথরুমটির ভেতরে। আর রুমের বাইরে একতলার ছাদ। এখানে আর দোতলা হয়নি। এখানে একটি কিচেন। কোনো রুমের মধ্যে নয়, একদম খোলা। অনেকদিন হয় কিচেনটি  ব্যবহার করেনি কেউ। ফলে সবকিছুই নষ্ট হয়ে আছে। এটি সচল করা তেমন কোনো কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ছিল না। কিন্তু সে ব্যবস্থা কখনোই আমি করতে যাইনি।

বেশ কয়েকটি চাবি আমার হাতে ধরিয়ে দিল নিতাই। এবং কোন চাবিটি কোন গেটের, তাও ঠিক ঠিক বুঝিয়ে দিয়ে গেল। আর বলল, ছাদে যাওয়ার জন্য এখানে দরজা আছে। এই দরজায় কোনো তালা-চাবি নেই। দরজা বন্ধ রাখলেই হবে, না হলে একতলা টপকিয়ে চোর ঢুকে পড়বে ভেতরে। সুতরাং ছাদের দরজাটি সব সময় বন্ধ রাখতে হবে। নিতাই চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিলাম এবং রুমের কোথায় কী আছে, পই পই করে দেখতে লাগলাম।

সার্কিট হাউজ হোক, হোটেল হোক আর বাংলো হোক, আমাকে প্রথমেই খুঁজতে হয় মশারি আছে কিনা। কারণ মশা থাকুক বা না-থাকুক মশারির নিচে ঘুমানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সুতরাং অনেক কিছুর মধ্যে আমি মূলত মশারিটা কোথায় রাখা হয়েছে, তা খুঁজতে লাগলাম। কোনো কারণে যদি এই রাতের বেলা মশারি খুঁজে না পাই, তাহলে তিনটি কলাপসিবল গেটের তালা খুলে খুলে আমাকে নিচে নামতে হবে নিতাইয়ের খোঁজে। কারণ ভুল করে ওর মোবাইল নম্বর রাখা হয়নি। কিন্তু না, দুশ্চিন্তার প্রথম স্তরেই একেবারে নতুন সাদা ধপধপে মশারি পেয়ে গেলাম। এখন আমি পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিন্ত। এই নিশ্চিন্ততার এক ধরনের প্রকাশ আছে। সেই প্রকাশ হলো, খুব নির্জনে একাকী এক কাপ চা এবং একটি সিগারেট নিয়ে বসা এবং আয়েশ করে কিছুটা সময় কাটানো। আমার ফ্লাক্সে চা ছিল। হয়তো কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সুতরাং আমি এক কাপ চা নিয়ে ছাদের দরজা খুলে উচিয়ে থাকা একটি পিলারের মাথায় বসলাম।

আমার জন্য এরকম আশ্চর্য একটি পরিবেশ, প্রকৃতির এরকম বিস্ময়কর আয়োজন অপেক্ষা করবে, তা ভাবতেও পারিনি। চারদিকের আলোতে এই রাতের বেলায়ও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, তিনদিকের অসংখ্য বৃক্ষ তার সকল শাখা-প্রশাখা, পত্রপল্লব এবং ফুলফলসমেত এই ছাদের উপরে এসে হুমরি খেয়ে পড়েছে। ছাদের প্রান্তিকের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে এই বৃক্ষকূল। মধ্যাকাশে পরিপূর্ণ চাঁদ এবং চারদিকটা নীরব-নিস্তব্ধ। এরকম নিসীম নিস্তব্ধতার মধ্যে বসে এই মধ্যরাতে একাকী বসে চা এবং সিগারেট উপভোগ করার সুযোগ বহুদিন হয়নি। আমার মনে হলো, প্রথাগত পৃথিবীর সকল কোলাহল অতিক্রম করে আমি অন্য একটি জগতে চলে এসেছি।

এই নির্জনতা হজম করার শক্তি ও সাহস খুব কম মানুষেরই থাকে। কারণ এমন পরিস্থিতিতে রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো এক ধরনের ভুতুরে পরিবেশ তৈরি হয়। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে, রক্তের মধ্যে, চেতনার মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আমি হলফ করে বলতে পারি, একটি তিন তলা ভবনে আর কোনো লোক নেই, তার মধ্যে তিন-তিনটি কলাপসিবল গেট পার হয়ে আপনার রুম এবং কাছেপিঠে কোনো জনবসতি নেই। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস যদি আপনার না থাকে, তা হলে আপনি কিছুতেই সেখানে অবস্থান করতে পারবেন না। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ মানুষের দেশে অধিকাংশ মানুষেরই এই অভ্যাস থাকে না। কিন্তু আমার আছে। নির্জন পরিবেশে একা থাকার আনন্দ আমি উপভোগ করে আসছি খুব শৈশব থেকে।

এখলাসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি চেয়ারম্যান মনু সিকদারে বাড়িতে থাকতাম। যে ঘরে আমি থাকতাম সেই ঘরটি ছিল বাড়ির বাইরে। কাচারি ঘরটির সামনে ছিল বিশাল একটি তেঁতুল গাছ এবং একটি গাবগাছ। দিনের বেলায়ও এই স্থানটিতে অন্ধকার বিরাজ করত। তার পরে ছিল বিশাল একটি মজা পুকুর। পুকুরের চারদিকটা জঙ্গলে আচ্ছন্ন। পুরো এলাকাটি গাছপালা-ঝোপ-ঝাড় পরিবেষ্টিত। পুকুরের পাড় ঘেষে ক্ষীণ একটি রাস্তা ছিল দক্ষিণের গ্রামে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যার পর তো দূরের কথা, দিনের বেলায় অধিকাংশ মানুষ ওই পথ মারাত না। এই বিশাল জঙ্গলের জগতে আমি কমপক্ষে চারটি বছর অতিবাহিত করেছি। সন্ধ্যার পরে কোনো মানুষ এখানে আসত না। কিন্তু আমার ভালোই  লাগত। কারণ, ভয়ের বোধ আমার মধ্যে তৈরি হয়নি।

পৃথিবীর কিছুকে বা কাউকে আমি কখনোই ভয় পাই না। তবে অসম্মানীত হওয়ার, অপমান-অপদস্ত হওয়ার ভয় আছে। রাস্তায় যত সতর্কতার সঙ্গে আপনি গাড়ি চালান না কেন, অন্যের যদি সেই সতর্কতা না থাকে, তা হলে আপনি নিরাপদ নন। এই অনিরাপত্তার আশঙ্কা আমাদের জীবনে প্রতি মুহূর্তে বর্তমান।

জায়গাটি আমার খুব প্রিয় হয়ে গেল। আমার মনে হলো, আমি যে প্রকৃতির মানুষ, তার জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কোনো স্থান হয় না। কিন্তু এখানে কত দিন বসবাস করতে পারব, সেই অনিশ্চয়তা তো আছেই। তবুও আমি সড়ক ও জনপদ বিভাগের এই আবাসন ব্যবস্থাটি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। এখানে আমার সঙ্গী বহু বছরের পুরনো একটি ল্যাপটপ, আর কিছু বই। আমি ধূমপায়ী। প্রতিদিন সর্বোচ্চ তিনটি এবং সঙ্গে অবশ্যই চা। উলটো বললাম। বরং বলা ভালো, যখন আমি চা খাই তখনই একটি সিগারেটের দরকার হয়। চা ছাড়া আমি সিগারেট খাচ্ছি, এমন কোনো নজির নেই। তবে সিগারেট ছাড়া চা-তে তেমন কোনো সমস্য নেই। কিন্তু চা কিংবা কফির ব্যবস্থা কী করে হবে, আরও কিছু ফাইফরমাশ তো থাকেই, সেইসব ব্যবস্থা কী করে হবে, রাতে এইসব ভেবে ভেবে একটা সময় যখন ঘুমোতে গেলাম।

আমার মনে হলো, এর চেয়ে নির্জনতম ঘুম বহু বছর ধরে ঘুমাই না। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এবং আরও কী সব নিঃশব্দের শব্দ আমাকে অভিভূত করে তুলল। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়লাম এবং সেই ঘুম যে বহুদিন ঘুমাইনি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা শহরটিতে কখনো রাত হয় না। আকাশে সূর্য না থাকলেই যে রাত হবে, এমন হিসাব এখন আর চলে না।

হাসপাতালের কথা ছেড়ে দিন। সেখানে রাত ও দিনের তারতম্য না থাকারই কথা। কারণ অধিকাংশ রোগাক্রান্ত মানুষের মধ্যে রাত ও দিনের ব্যবধান থাকে না। কিন্তু আপনি রাতের ঢাকার বাড়িগুলোর দিকে তাকান, বহুতলন ভবনগুলোর দিকে তাকান, রাস্তাঘাট ও হাটবাজারের দিকে তাকান, দেখবেন সর্বত্র আলো জ্বলছে। সেই আলো উৎসবের নয়, আনন্দের নয়, আমন্ত্রণের নয়, সেই আলো কর্মের, ব্যস্ততার, বিস্রস্ততার। দেখবেন মানুষ সারাক্ষণ ব্যস্ত। কী নিয়ে মানুষের এত ব্যস্ততা? সেই মহাকাব্যিক জগতের হিসাব না নিলেও চলবে। এর মধ্যে যারা ঘুমোতে যান তাদের ঘুম দিবানিদ্রারই আরেক রকম। দিবানিদ্রায় ঘুমের মধ্যে যেমন দিনের বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ আঘাত হানতে থাকে, তেমনি রাতের ঘুমের মধ্যে দিন এবং দিনের কর্মকোলাহল, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, হিংসা-প্রতিহিংসা, মিত্রতা-শত্রুতা ভিন্ন এক স্বভাবে আঘাত হানতে থাকে।

সুতরাং ঢাকা শহরে রাতের ঘুম বলা যাবে না। কারণ রাত হতে হবে তো! ঢাকা শহরে রাত হয় না। একে বলা যায়, দিনেরই প্রলম্বিত অন্য এক স্বরূপ। এমন একটি শহরে বসবাস করে করে সত্যিকারের ঘুমের নির্জনতা, নিবিড়তা, প্রগাঢ়তা কবে যে ভুলে গেছি, তার খোঁজ কে রাখে! কোন শৈশবে, গ্রামীণ জীবনে দেখেছি, সূর্য ডোবার সাথে সাথে চারদিক থেকে বিপুল আয়োজন করে নেমে আসত রাত। সেই রাতের শরীরে কখনোই এক ফোঁটা আলো পড়ত না। সেই রাতের নির্জনতায় বৃক্ষ থেকে একটি পত্রের পতনও বিপুল হয়ে উঠত। এমনকি পথের একটি কুকুরও কোনো কারণে গভীর রাতে ডেকে উঠলে রাতের অফুরন্ত নির্জনতার স্বরূপ আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠত।

গ্রামীণ জীবনে পাখ-পাখালির গুঞ্জনের ভেতর দিয়ে রাত শেষ হওয়ার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠত। এই সময় সূর্যের ক্ষীণ আভাসে পূর্বাকাশ কিছুটা ফর্সা, কিছুটা রহস্যময় রূপ ধারণ করত। রাতের অন্ধকার ভেদ করে পূর্বাকাশ জুড়ে অসংখ্য রং, রঙের রেখা, রঙের ধোয়া, রঙের ঢেউ যেন এক মহাজীবনের আয়োজন। আর এর সঙ্গে মানুষের দেহগড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে কবে থেকে যে জড়িয়ে গেছে, তার কোনো ইতিহাস নেই। প্রকৃতিসংলগ্ন এই টাইম টেবিলটা সূর্য উঠার মতোই মানুষকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয় চিরকাল। খুব ভোরে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সবার দিন শুরু হয়ে যেত। তারপর সামনে পড়ে থাকত সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময়।

সেই গ্রামীণ জীবনে দিবানিদ্রা কাকে বলে তা কখনো জানা ছিল না। মানুষ দিনে ঘুমাবে, এ ছিল আমাদের ভাবনার অতীত। দুপুরের খাবারের পর বাবাকে দেখতাম চকির এক কোণে বসে অথবা ঘরের ভিটিতে বসে একটু সময়ের জন্য তন্দ্রাতুর হয়ে ঝিমোতেন। ওই পর্যন্তই। বাকি সময় নানা রকম ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততার মধ্যে প্রকৃতিসংলগ্ন এমন এক নিয়মানুবর্তিতা ছিল, যাকে অতিক্রম করার সুযোগ ছিল না তাঁর। ভোর রাতে পৃথিবী জুড়ে যে প্রশান্তি বিরাজমান থাকেত তার অমৃত পান করার অবারিত সুযোগ প্রায় সবাই গ্রহণ করত। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যেত জীবনের কোলাহল। সেই কোলাহলের মধ্যেও এক ধরনের নির্জনতা ও প্রশান্তি বিরাজমান থাকত। আজ অনেকদিন পরে মনে হলো, গ্রামীণ জীবনের সেই গভীর রাতের মধ্যে আমি নিশ্চিন্তে নিজেকে সমর্পণ করেছি। এখানে সামান্যতম শব্দ নেই। এখানে রাতের নিজস্ব ও চিরায়ত কিছু শব্দকল্প ছাড়া, নৈঃশব্দের মধ্যে শব্দের কিছু অনুভব ছাড়া আর কিছু নেই। এখানে রাত নিরন্তর রাতের মধ্যে বিরাজমান।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ