সরকার আবদুল মান্নাননের গল্প ‘পরিদের দেশে হাজেরা আপু’
প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২৪
হাজেরা আপু এইটে পড়ে। দুটি বেনি করে বেনির মাথায় লাল ফিতার ফুল তুলে হাজেরা আপু যখন হাঁটে তখন পরির মতো সুন্দর দেখায়। ছোট-বড় সবাই আশ্চর্য হয়ে চেয়ে থাকে হাজেরা আপুর দিকে।
কিছুদিন হলো স্কুলে আর যায় না আপু। এইটে বৃত্তি দেওয়াও হলো না তার। সারাক্ষণ একা একা কী যেন ভাবে। করো সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলে না। কিন্তু আমরা যারা খুব ছোট-টু-থ্রি-ফোরে পড়ি তাদের সঙ্গে হাজেরা আপুর অনেক ভাব। আমাদের কাছে আসলে মন খারাপ করে থাকে না। বরং সারাক্ষণ গল্প করে বানিয়ে বানিয়ে।
আমাদের মধ্যে কেউ প্যান্ট পরে, কেউ পরে না, কেউ লুঙ্গি পরে কেউ বা লুঙ্গি গলায় বা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন বিল্লাল। হাতে পায়ে লম্বা। সারাক্ষণ লুঙ্গি ঝুলিয়ে রাখে কাঁধে। নাক দিয়ে বের হয় সর্দি। একদিন হাজেরা আপু বিল্লালকে বলে- অ বিল্লাল, আমারে কেমন লাগে রে?
বিল্লাল খুব লজ্জা পায়।
অতি বোকা গফুর বলে, বালা! খুব বালা।
কপট রাগ করে আর চোখ রাঙিয়ে হাজেরা আপু বলে, তোরে জিগাইসি? আমি তো জিগাইছি বিল্লালেরে! বিল্লাল ক, তুই ক। আমারে কেমন দেহায়?
বিল্লাল লজ্জায় লাল হয়ে বলে, বালা। খুব বালা।
হাজেরা আপু হাসতে হাসতে বলে, এত লজ্জা পাস কিলিগারে বিলাই। শয়তান আইয়া গেছস। বিয়া করবি আমারে?
আর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, তুই তো পোড়া মরিচ। তোরে বিয়া কইরা কাম নাই। কালা কালা পোলাপাইন অইব।
আমি খুশি হবো না রাগ করব বুঝতে না পেরে সবার সঙ্গে চুপ মেরে আছি। আমরা কেউই হাজেরা আপুর এমন বাজে কথার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সবাই বিব্রত হয়ে থাকলাম।
গফুর বলে ফেলল, আপু, আমনে ত বড়! আমনের বিয়া অইব জয়নালের লগে।
হাজেরা আপু কোনো কথা না বলে গফুরের গালে একটা চড় লাগিয়ে হন্হন্ করে বাড়িতে চলে গেল।
আমরা সবাই হতবম্ভব হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ করে বসে থাকি। কিন্তু গফুর রাগ করে না। হাসে। ওর মুখের সামনের উঁচু দাঁতগুলো বের করে হাসে। বলে, হাজেরা আপু একটা পাগল। জয়নাল ভাইয়ের লগে কতা কইতে দেহি না বুঝি!
কিছুক্ষণ পর হাজেরা আপু আসল হাতে ভাঁপা পিঠা নিয়ে। আমরা সবাই খুব খুশি। দৌড় দিয়ে আপুর কাছে গেলাম প্রায় এক সাথে। আপু আমাদের হাতে ভাঁপা পিঠা দিল সমান ভাগে ভাগ করে। কিন্তু গফুর একটু আগেই চলে গেছে বিলের দিকে। আপু জিজ্ঞাসা করল, গফুর কইরে? আমরা বললাম, গেছেগা। সুরুজের লগে বিলের দিকে গেছেগা। দেন আপু। আমারে দেন।
আপু রেগে গেল। বলল, ওই পোড়া মরিচ, তোর সাবুরি নাই। নে খা। বলে পিঠার সবচেয়ে বড় অংশটুকু পুকুরে ফেলে দিল।
খাবার পুকুরে ফেলে দিল! আমরা এখন সত্যি অবাক হলাম। পর্যাপ্ত খাবার আমরা কখনই পাই না। সেই মূল্যবান খাবার কেউ ফেলে দিতে পারে তা ভাবাই যায় না। তারপরেও হাজেরা আপুকে আমাদের খারাপ লাগে না। অনেক পরে বুঝেছি, কেন হাজেরা আপুকে আমাদের এত ভালো লাগত। কারণ আপুর মধ্যে নাটক ছিল, রোমাঞ্চ ছিল, ট্রাজেডি-কমেডি ছিল। সেই হাজেরা আপুকে পরিয়ে নিবে না তো কাকে নিবে? মুড়া বাড়ির বেডপ আম্বিয়াকে?
এখন প্রায় সর্বক্ষণ আমাদের গবেষণার বিষয় হাজেরা আপু, পরি, কৈলাস পাহাড়।
হাজেরা আপুকে পরিয়ে নিয়ে গেল রাত নয়টায়। সেই আশ্চর্য খবরটি জানে সবাই। শুধু জানিনা কেবল আমরা কয়েকজন বালক-বালিকা। মুড়ার বাড়ির জামালদের বিশাল গাব গাছটার উপর দিয়ে যখন হাজেরা আপুকে নিয়ে যায়, তখন ছোট কাকু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছিল খালের পাড়। প্রচণ্ড বেগ ভুলে যায় কাকু। বিস্ময়ের সঙ্গে সে লক্ষ্য করে, একটি পরি কীভাবে ডানায় করে হাজেরাকে নিয়ে চলে যায় উত্তর দিকে। কইলাস পাহাড়ে।
কাকু বলে, হুন। আমার কাছ থিকা হুন। হাজেরা বাইরে আইছিল জানি কিলিগ্যা। মানুষ রাইতে বাইরে আইয়েই। এই সোময় পরি ওরে পিঠে তুইল্যা নেয়। জোর কইরা না। বুঝলি, ভালোবাইস্যা। পঙ্খিরাজের মতো হাজেরারে পিঠে লইয়া বিলাশ পাঙ্খা মেইল্যা পরি যখন উইড়া যায়, তখন আমি দেইখ্যালাই। আমি আছিলাম জামালগ বাড়ির পিছনে খালের পাড়। আগা-মুতার কতা ভুল্যা গিয়া আমি দেহি গাব গাছটার উপরে কি বাতাস আর কি আলো। ঝড় উঠতাছে মনে হয় ঝিলিক দিয়া। হেই আলোয় ত আমি হাজেরারে দেখলাম।
কাকুর কথা শুনতে শুনতে আমাদের আর বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কী আশ্চর্য ভাগ্যবান হাজেরা আপু। পরিয়ে নেওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার। কয়জন মেয়ের কপালে জোটে। আর হাজেরা আপুরে নেবেই না কেন! এত সুন্দর মেয়ে হয় কয়জন। ভাসা ভাসা চোখ দুইটি মায়ায় ভরা।
বাট্টু বলল, আচ্ছা গফুর, কৈলাশ পাহাড় কোনডাই? দূরে না অনেক?
গফুর বিজ্ঞের মতো এদিক-সেদিক তাকিয়ে মনে হয় কৈলাশ পাহাড়টা দেখে নিল। তারপর বলল, দূরে না! অনেক দূরে। উত্তরে হিমালয় পাহাড়ের কথা হুনছস? হের চেয়ে অনেক দূরে।
আমি বললাম, কৈলাশ পাহাড় উঁচা না অনেক? এমন উঁচা পাহাড়ে হাজেরা আপু থাকব কেমনে? পইড়া যাইব না?
তুই একটা গাধা। বুদ্ধি নাই একটুও। যে পরিরা ডানায় কইরা উড়াইয়া লইয়া যায় হেরা হাজেরা আপুরে পড়তে দিব? ধইরা হালাইব না পড়তে গেলে? আমাকে ব্যঙ্গ আর বিদ্রুপ করে বলল গফুর।
সুরুজ এতক্ষণ নিজের মতো চুপচাপ ডিল ছুড়ছিল পুকুরে আর পাশে বসা ওর কুকুরের লেজ সোজা করছিল। ওই জরুরি কাজ থামিয়ে দিয়ে সে বলল, গফুর তুই জানছ আন্ডাডা। কৈলাশ পাহাড় অইল একটা নিচা পাহাড়। পরিরা এতো উচা পাহাড়ে থাহে না। হাজেরা আপু পড়তে যাইব কোন দুখে?
সুরুজ সত্য বলল কি মিথ্যা বলল সেটা নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু হাজেরা আপু যে কৈলাশ পাহাড় থেকে পড়ে মরবে না এই নিশ্চয়তা পেয়ে আমরা সবাই খুশি। এমন কি মহাপণ্ডিত গফুরও নিরভার।
গফুর বলল, অইতে পারে। নিচাই অইতে পারে। পরিগ পাহাড় এত উঁচা অওয়ার কাম কী? পরিরা কি উঁচা পাহাড়ে উইঠ্যা নাচব?
পরিদের নৃত্যের কথা অনেক শুনেছি আমি। পরিরা সারাক্ষণ নাচে আর গান গায়। কিন্তু তারা কোথায় নাচে সেটা শুনিনি কখনই। আমাদের ধারণা হলো, যেখানে কোনো লোকবসতি নেই, মানুষ চলাচল করে না এমন কোনো নির্জন স্থানে পরিরা নাচে। কিন্তু উঁচু পাহাড়ে নাচে, নাকি নিচু পাহাড়ে নাচে কিংবা সমতলে নাচে এসব নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। হাজেরা আপু কেমন আছে, পরিরা তাকে নিয়ে নাচে, নাকি নাচতে দেয় না, এইসব নিয়ে আমাদের যত আগ্রহ।
সুরুজ বলল, হাজেরা আপু পরিগ লগে নাচব কেমনে? আপুর কি পাঙ্খা আছে?
পাঙ্খা থাহন লাগব না। নাচতে পাঙ্খা লাগে তোরে কে কইছে? গফুর ক্রুদ্ধ হয়ে সুরুজকে বলল।
সুরুজ দমে গেল না। বরং গফুরের রাগের উপর রাগ দেখিয়ে বলল, হাজেরা আপুর পাঙ্খাও নাই, পরিদের মতন সোন্দরও না। নাচতে লইব, না কচু।
এবার গফুর কিল নিয়ে এগুয়ে যাচ্ছিল সুরুজের দিকে। আর গোদ গোদ করে বলছিল, কী কলি, কী কলি? হাজেরা আপু সোন্দর না! পরিগ থিকা সোন্দর। বাপের গোত্তে দেখছস কোনো দিন পরি?
আমি আর বাট্টু গফুরকে সামলিয়ে নিালাম। সামলাতে গিয়ে দেখি গফুর আরও উত্তেজিত হয়ে সুরুজকে মারতে উদ্বুত। ঠেকাতে যাওয়ার এই একটা মুশকিল। যাকে ঠেকাতে যাব সেই মারামারি করতে বেশি জোরাজোরি করে। বীরত্ব দেখানো সুযোগ পেয়ে যায়।
বাট্টু বলল, এ্যা, জোর কত! দেই ছাইড়া। সুরুজের হাতে মাইর খাইয়া তক্তা অইয়া যাবি। আর গ্যা গ্যা করতে করতে বাইত যাবে। বাইত গিয়া দাদির হাতে আরো কয়ডা খাবি।
গফুর দমে যায়। আমরা ওকে ছেড়ে দিই। ছেড়ে দেওয়ার পর মারামারিটা আর হলো না। কিন্তু হাজেরা আপু যে পরিদের চেয়েও সুন্দর গফুরের এই ধারণা হুমকির মধ্যে পরল। বাট্টু বলল, পরি অইল পরি। পরির লগে মানুষের জোদা কী। মানুষ কোনো দিন পরির লাহান সোন্দর অয় না।
এর মধ্যে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সুরুজ চিন্তায় পড়ে গেল। গফুর বলল, কিরে সুরুজ, তোরে তো কিছু কই নাই। কিল তো একটাও খাস নাই। তাইলে বেজার অইছস কিলিগ্যা।
সুরুজ উত্তেজিত হলো না। খুব শান্তভাবে বলল, ইহ্! হেয় আমারে কিলাইব! হেরে কিলায় কত জনে।
আমি বললাম, বাদ দে, বাদ দে। কিলাকিলির দরকার নাই। তুই বেজার অইয়া আছস কিলিগ্যা হেইডা ক।
সুরুজ বলল, আইচ্ছা, হাজেরা আপু খায় কী? খাওয়ার সমস্যা অইতেছে না?
সুরুজের মন খারাপের কারণটা এখন আমরা বুঝতে পারলাম।
গফুর বলল, হাজেরা আপু এহন রাজরানির মতো থাহে, বুঝলি। খায়ও রাজরানির লাহান। পরিগ কি খাওনের অভাব আছে? মিষ্টির দোকানগুলি খালি অয় কিলিগা, জানস না? পরিরা নেয়, পরিরা।
বাট্টু আরো কিছু যোগ করে অতি উৎসাহ নিয়ে বলল, হুদা মিষ্টি না। পোলাউ, কুর্মা, কালিয়া-কুত্তা কিছুরই অভাব নাই পরিগ দেশে। আমাগ মতো কচু-ঘেচু আর রিলিফের ছাতু খায় না পরিরা।
হাজেরা আপু সে খুব ভালো খায়-দায় এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকল না। আমরা সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে আইসক্রিমঅলার পিছু নিলাম। ভাঙা কাচের বোতল, পুরানো হারিকেনের খোল, পথে কুড়নো পাটের গোছা, এইসব সংগ্রহের জন্য গফুর দৌড়াল বাড়ির দিকে। পরপর বেশ কয়েকদিন আমরা হাজেরা আপুকে আর আলোচনায় আনলাম না। বলা যায় হাজেরা আপু, পরি, কৈলাশ পাহাড় হারিয়ে গেল আমাদের স্মৃতি থেকে।
এমন সময় আমরা যখন ঢাকার গাছ সাদা কেন নিয়ে বিস্ময়কর গবেষণায় মত্ত এবং ঢাকা এসে এখানকার সাদা গাছ দেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন জানলাম হাজেরা আপু জয়নাল ভাইকে বিয়ে করে বাড়িতে এসেছে। জয়নাল ভাই আমাদের হাতে অমৃতসম চিৎ মিঠাই দিয়ে তার পোষ্য করে নিল। আর বলল, খবরদার জয়নাল ভাই কবি না। কবি দুলা ভাই। আমরা এখন জয়নাল ভাইকে দুলা ভাই বলি। কিন্তু পরিদের দেশে গিয়ে হাজেরা আপুর কী অবস্থা হয়েছিল তা আর জানতে পারিনি।