সম্রাট আওরঙ্গজেব কি সত্যিই মন্দির ভেঙেছিলেন?

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মার্চ ১১, ২০২০

সমাট আওরঙ্গজেব বানারসের বিশ্বনাথের মন্দির ভেঙেছিলেন কথাটা সত্যি। কিন্তু কেন ভেঙেছিলেন? সম্রাট আওরঙ্গজেব বানারসে বিশ্বনাথের মন্দির ভেঙেছেন সেটা খুব বড় করে প্রচার করা হয়েছিল ইংরেজদের দ্বারা। কিন্তু মন্দির ভাঙার পেছনের কারণটা বলা হলো না। মন্দির যখন ভেঙেছেন প্রমাণ তো হলোই আওরঙ্গজেব ছিলেন হিন্দু বিদ্বেষী। বহুজন জানেন না হিন্দু রাজা কলহন মন্দির ভেঙেছিলেন তার সময়কালে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রসঙ্গে থাকা যাক।

মন্দির ভাঙার মূল ঘটনাটা সম্পর্কে বিএন পাণ্ডে তার ‘মধ্যযুগের ইতিহাসের বিকৃতি’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব তার অধীনস্ত রাজাদের সঙ্গে নিয়ে বাংলা অভিমুখে যাবার সময় ঘটনাটা ঘটে। সম্রাট যখন বানারসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, রাজারা সম্রাটকে জানালেন তিনি যদি বানারসে একদিন যাত্রা বিরতি করেন তাহলে রাজ মহিষীরা গঙ্গাস্নান করে বিশ্বনাথকে শ্রদ্ধানিবেদন করতে পারেন। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। গঙ্গাস্নান করে পূজা অর্চনা সেরে যখন বাকিরা ফিরে এলেন, কচ্ছের মহারানীর দেখা পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ রানীকে পাওয়া গেল ধর্ষিতা আর ক্রন্দনরত অবস্থায়। মন্দিরের ভিতরে রাণী ধর্ষিতা হয়েছেন মোহান্তের দ্বারা। সকল রাজারা তাতে ভীষণ ক্ষেপে যান। সম্রাটের কাছে তারা বিচার চাইলেন। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে বললেন মন্দির থেকে বিগ্রহ সরিয়ে নিয়ে কলুসিত মন্দিরটিকে গুড়িয়ে দেয়া হোক। তিনি মোহান্তের অপরাধে বিগ্রহটিকে কোনো অসম্মান হতে দিলেন না আর মোহান্তকে কঠিন সাজা দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

ইংরেজরা যখন ক্ষমতায় এলো প্রথম যা করলেন তা ভারতীয়দের মধ্যে নানাভাবে বিভেদ সৃষ্টি করা। প্রথম এক অঞ্চলের সঙ্গে ভিন্ন অঞ্চলের। সেই সময়ে বাংলার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন প্রদেশের। কিন্তু ইংরেজদের বড় খেলাটা ছিল ভারতের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে দেয়া। মনে করলো, এই দুই সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নষ্ট করে বিরোধ তৈরি করে দেয়া গেলে বহুকাল তারা ভারতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে। ফলে মুসলমানদের নানা কুকীর্তি হিসেবে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কাহিনী বানিয়ে বলতে থাকলো। সবসময় যে মিথ্যা বললো তা নয়। বললো ঘটনার অর্ধেকটা। মন্দির ভেঙেছে আওরঙ্গজেব এটা প্রচার করলো, পেছনের কারণটা বললো না। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের একটা অংশ মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠলো। পরে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের ইতিহাসবিদরা অনেকে সত্যিটা বললেন, ততদিনে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বহু দূর পৌঁছে গেছে। সকলে বই পড়ে যে ইতিহাসের সত্য জানবেন, সে সুযোগ ছিল না।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্দিরকে প্রচুর জমি দিয়েছেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু যখন দেখলেন ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার জন্য সকলে মন্দির বানিয়ে বসতে চায়, তিনি তাতে বাধা দিয়েছিলেন। ফলে তিনি হয়ে গেলেন হিন্দু বিদ্বেষী। যে কোনো সম্রাটকে শাসন করতে গিয়ে নানারকম দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে নিষ্ঠুর হতে পারেন, কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন তার প্রমাণ নেই। কারণ ইতিহাসে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে বেশি অমাত্য ছিলেন হিন্দু। সামান্য আগের ঘটনা কি প্রমাণ করে তিনি হিন্দুদের পূজাপার্বণে বাধা দিতেন? রাজারা তাহলে কি সাহস করে সম্রাটকে বলতেন, তাদের স্ত্রীরা বিশ্বনাথের পূজা দিতে চান? কিন্তু মুসলমান শাসকদের নিষ্ঠুর আর হিন্দু বিদ্বেষী না বানানো গেলে ব্রিটিশরা ভারতে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াইয়ে গুটি কয়েক ইংরেজরা হেরে যাবে। ব্রিটিশ শাসকদের সেজন্য নানা গল্প বানাতে হলো, ইতিহাস বিকৃত করতে হলো। শাসকদের অধীনস্ত সুবিধাভোগীরা তখন শাসকদের সঙ্গে মিথ্যাচারে হাত মেলালেন।

বাংলার মানুষ বাঙালি না হয়ে, ভারতের মানুষ ভারতীয় না হয়ে, হয়ে গেল হিন্দু আর মুসলমান। ফলে ভারতের ইতিহাসকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো, ভারতে হিন্দু-মুসলমান ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভারতের মানুষ শেষ এসে এমন হলো যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে লড়াই করলো হিন্দু আর মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে। ভারতের ইতিহাস আজ আর হিন্দু-মুসলমান বাদ দিয়ে আলোচনা করা যায় না।