সম্মিলিতভাবে কেন নয় একুশের আয়োজন
তোফাজ্জল লিটনপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮
ভাষার প্রশ্নে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সব ভুলে ১৯৫২ সালে একত্রিত হয়েছিল বাঙালি জাতি। এরপর ভাষার জন্য জীবন দেয়া, ভাষাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক দিবস প্রতিষ্ঠা- এসব বিরল ইতিহাস সৃজনকারী গৌরবময় জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি। বিশ্বজুড়ে ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষা বলতে বিশ্ব বাংলাদেশকেই বোঝে। দেশের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা জাতীয় শহিদ দিবস পালন করে একুশে ফেব্রুয়ারি। দেশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও প্রবাসে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ সীমিত। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর নানা জায়গায় এর আয়োজন করে। নিউইয়র্কের প্রবাসী বাঙালিরা প্রশ্ন তুলেছে, ভাষার প্রশ্নেও কি আমরা পারি না এক হতে? আমাদের গৌরবময় মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে নিজেদের গণ্ডিতে না রেখে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে। আর এ কাজটি করা নিউইয়র্ক থেকেই সহজ হবে। তাই আমরা কী পারি না একসঙ্গে একটি বড় আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আমাদের গৌরবের কথা জানাতে? সবাই মিলে একটি জায়গায় স্থায়ী অথবা অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রেণি-পেশার মানুষ কী ভাবছে, তা নিয়ে প্রতিবেদক কথা বলেছেন সাধারণ মানুষ, শহিদ দিবসের নিয়মিত আয়োজক বাংলাদেশ সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাল্যামনাই অ্যাসোশিয়েশন এবং নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল শামীম আহসানের সঙ্গে।
নিউইয়র্কে ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালন করে আসছে আঠারো হাজার সদস্যের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি। বর্তমান সভাপতি কামাল আহমেদ ছাড়পত্রকে বলেন, “সবাই মিলে কেন্দ্রীয়ভাবে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান আয়োজন করলে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। আমরাও চাই একসঙ্গে এটি আয়োজন করা হোক। ফেব্রুয়ারিজুড়ে নিউইয়র্কে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকে। তাই চাইলেও উন্মুক্ত জায়গায় আয়োজনটি করা সম্ভব নয়। দূর-দূরান্ত থেকে হাজারও মানুষ ছুটে আসে শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জনাতে। আমাদের সাধ্য ও আয়ত্বের মধ্যে এত বড় হলরুম পাওয়াও মুশকিল। এরপরও আমি মনে করি, শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান একসঙ্গে আয়োজন করা সম্ভব এবং এটাই শোভন হবে। প্রতিবারই আমাদের আয়োজনে থাকে অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিবছর অন্তত একশো বিশটি সংগঠন আমাদের আয়োজনে ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। আমাদের এবারের আয়োজন করা হয়েছে ওড সাইডের গোলশান ট্যারেসে।”
বড় হলরুম ও দিবসটিকে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করেন অ্যাকটিভিস্ট ও চিত্রশিল্পী টিপু আলম। তিনি ছাড়পত্রকে বলেন, “এত বড় একটা বিষয়কে স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সরকার যদি সবার সঙ্গে আলোচনা করে একসঙ্গে একটি বড় আয়োজন করে, আমি মনে করি, সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হবে। যে কোনো বড় আয়োজনেই সবাই যুক্ত থাকতে পারলে গর্ববোধ করে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি নিরপেক্ষভাবে সবাইকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে বিষয়টি আরো সহজ হয়ে যাবে। তখন অর্থনৈতিক বিষয়টিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। টাইম বা ম্যাডিসন স্কয়ারে যদি বড় হলরুম নিয়ে দিবসটির আয়োজন করা হয় তবে বিষয়টা মূলধারার মিডিয়াও গুরুত্ব দেবে। তাতে করে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে সুনামের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে। যার ফল দেশের সরকার এবং প্রবাসী সবাই ভোগ করতে পারবে।”
কলামিস্ট হাসান ফেরদৌস ছাড়পত্রকে বলেন, “শত ফল ফুটতে দাও। আমি তো মনে করি, যে যেভাবে দিবসটির আয়োজন করছে সেটাই ভালো। আমরা সমস্ত ক্ষেত্রে বিভক্ত। নেতৃত্বে বিভক্ত। জাতীয় সার্থে বিভক্ত। এখান থেকে কথা বলা মানে গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে ডগায় পানি দেয়ার মতো। গোড়া থেকে যদি কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয় তবে তা কোনোভাবেই সফল হবে না।”
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “এ বিষয়ে আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। আমি চাই, ম্যানহাটনে বড় একটি হলরুম ভাড়া করে সম্মিলিতভাবে একুশে উদযাপন করা হোক। বাংলাদেশ সোসাইটি, ঢাবি অ্যালামনাই এবং মুক্তধারা নিয়মিত এই আয়োজন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। উনারা যদি একমত হন দেশের জন্য সত্যিকার অর্থে বড় কিছু করতে তাহলেই বিষয়টি সফল হবে। আমি দলের নামও চাই না, নিজের নামও চাই না। দেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী, এই আমার চাওয়া। আমি চাইবো সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজটি করতে। এ বিয়য়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কনসুলেট অফিস এবং জাতিসংঘে স্থায়ী মিশনকেও অনুরোধ করবো আমাদের সহযোগিতা করার জন্যে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত শহিদ দিবসের আয়োজন করে আসছে। বাংলাদেশ সোসাইটিও দীর্ঘদিন ধরে এ আয়োজন করে আসছে। আপনারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে নিজেরা পৃথক আয়োজন করতে গেলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি তাজুল ইসলাম ছাড়পত্রকে বলেন, “দেশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পস্তবক দেয়ার আয়োজক থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই নিরিখে আমরা চাইছিলাম শহিদ মিনারে ফুল দেয়া আয়োজনটি আমরা করবো। অন্য সমস্ত আয়োজন যেমন, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান যা যা আছে অন্য সবাই করুক। আমরা অনেক আগে এ প্রস্তাব দিয়ে সোসাইটির সঙ্গে অনেক আগে আলাপ করেছিলাম, কিন্তু তারা রাজি হয়নি। আমরা এখন যে আয়োজন করি তাতে আমাদের সংগঠনের নামও ব্যবহার করি না। আমরা ‘সম্মিলিত মহান একুশ উদযাপন’র ব্যানারে কাজ করি। আমাদের তালিকাভুক্ত ৪৫টি সংগঠন ছাড়া আরো ৫০টির মতো সংগঠন আমাদের এখানে পুস্পস্তবক অর্পণ করে। সবাই মিলে একসঙ্গে বড় আয়োজন করতে চাইলে আমরা সবার সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করবো। আমাদের এবারের আয়োজন করা হয়েছে উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য তিনটি বিভাগে কবিতা আবৃত্তি, হাতের লেখা ও চিত্রংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল শামীম আহসান ছাড়পত্রকে বলেন, “নিউইয়র্কে সম্মিলিতভাবে শহিদ দিবস পালন একটি প্রসংশনীয় উদ্যোগ হতে পারে। বাংলাদেশ কনস্যুলেট এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। নিউয়ইর্কের বিভন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বসবাস করে। রয়েছে অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের সবাইকে না হোক, বড় একটি অংশকে একসঙ্গে করে আয়োজন করা একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। শহিদ দিবস একইসাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সে আলোকে অন্যান্য ভাষার মানুষকেও সম্পৃক্ত করার তাগিদ আছে। সেই কাজটি কনস্যুলেট ও মিশন নিয়মিত করছে। আমাদের এবারের আয়োজনটি করা হয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি, কনস্যুলেট কার্যালয়ে। একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। কুইন্স বু্রো প্রেসিডেন্ট মিলিন্ডা কাট্জ এর সঙ্গে এ বিষয়ে মিটিং হয়েছে। তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন। স্থায়ী শহিদ মিনার হলে সম্মিলিতভাবে আয়োজন করাটি সহজ হবে।”
মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ২৬ বছর ধরে শহিদ দিবস পালন করে আসছে। শহিদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য শীত উপেক্ষা করেও শত শত মানুষ প্রতিবার জাতিসংঘ ভবনের সামনে রাত ১২টায় উপস্থিত হয়। মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিৎ সাহা আমেরিকার বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এবার তাদের কোনো আয়োজন আছে কীনা, এ বিষয়ে মুক্তধারার কেউ কিছু বলতে পারেনি।