সম্পদ আহরণের চেয়ে ভাষাশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ
শরিফ সাইদুরপ্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৮
একবার এক ইংরেজ গবেষক পশ্চিমবঙ্গে এসে এক শিলালিপি উদ্ধার করল। কিন্তু লিপির অর্থ উদ্ধার করতে পারলো না। শেষে গিয়ে হাজির হলো `হরিপদ দে` এর বাড়িতে। কিন্তু হরিপদ দে`কে বাড়িতে খুঁজে পেল না। হরিপদ দে ছিল এমন পণ্ডিত যিনি ত্রিশ বছর বয়সেই ত্রিশটি ভাষা জানতেন। ত্রিশটি ভাষা জানলে কী হবে! তার আবার গণিকালয়ে গমনের অভ্যাস ছিল। প্রায় সেখানে তিনি দিনকতক কাটাতেন। বাড়িতে আসতেন না।
ইংরেজ গবেষক হরিপদ দে`কে পরদিন সকালে `সোনাগাছি`তে খুঁজে বের করল। তিনি ইংরেজকে বললেন, কী কারণে তাকে এত খুঁজাখুঁজি? ইংরেজ বলল, এই লিপির অর্থ উদ্ধার করে দিন। তিনি বললেন, আরে বাপু এইটা! তা কয়টা ভাষায় লিখে দিতে হবে, বলো?
ক্লাস সিক্সে বা সেভেনে আমাদের বাংলা বইয়ে একটি লেখা ছিল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে। শহীদুল্লাহ এমন জ্ঞানী ছিলেন যিনি পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই নারিকেল গাছের উপর ইংরেজিতে এমন এক রচনা লেখেন যা তার শিক্ষক বিশ্বাসই করেননি যে, এটা তিনি লিখেছেন। অল্প বয়সে লেখাটি পাঠ্যবইয়ে পেয়েছিলাম কিন্তু ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহটা সৃষ্টি হয়নি। যদি সে সময়ে ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতো তবে এই লেখাটি হালিখানেক ভাষায় লেখার যোগ্যতা থাকতো।
কিছু মানুষের প্রতি আমার খুব ঈর্ষা। সেই মানুষদের প্রতি আমার ঈর্ষা যারা বেশ কয়েকটি ভাষা জানে। একটি ভাষার দাম আমার কাছে ইন্ডাস্ট্রির দামের চেয়ে বেশি। দশটি ইন্ডাস্ট্রির মালিকের চেয়ে বেশি সম্পদশালী সে, যে দশটি ভাষা জানে। ভাষা শিখতে কি লাগে? এই প্রশ্নের উত্তর তারাই ভালো দিতে পারবে, যারা বহুভাষী। তবে আমি বলব, ভাষা শিখতে লাগে একাগ্রতা, নিমগ্নতা, ধীরতা, ধৈর্য ও দুনিয়া বিমুখতা। দুনিয়া বিমুখতা বলতে অর্থ উপর্জনের জন্য ভাষা শেখা যাবে না বলে আমার বিশ্বাস। ভাষা শিখতে হবে সে ভাষায় পুঞ্জিভূত জ্ঞানের অন্বেষণ বা উচ্চাভিলাষী মনোভাব নিয়ে। এই ইচ্ছা থাকলে সেই ভাষাজ্ঞান দিয়ে অর্থ আসতে বাধ্য। যা মুখ্য ইচ্ছা নয়, যা গৌণ ইচ্ছা।
আবুল মনসুর আহমদ বলেন, একটি ভাষাকে পূর্ণাঙ্গ আয়ত্তাধীন করতে তিন বছর সময় লাগে। তিন বছরে একটি ভাষা নখদর্পণে চলে আসে। তার এই কথাটি সত্য বলে আমি বিশ্বাস করি। ইরানে চতুর্থ শ্রেণির আগে ইংরেজি শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা জরুরি বলে আমি মনে করি। এই চার বছরে আমাদের দেশে কি ইংরেজি শিক্ষা হয় তা জানি। এসময়ে ইংরেজি বাচ্চাদের কাছে একটি বিভীষিকার নাম।
বিজ্ঞানের এই সময়ে ইংরেজির বিকল্প নেই। বিজ্ঞান শিখতে গেলে ইংরেজি লাগবে। যদি বলেন চীনাদের মতো মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিখবো, তবে বলব, আগে চীনাদের অবস্থানে যান তারপর মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিখেন। ক্লাস ফোরের পর ক্লাস নাইন পর্যন্ত যে সময়টুকু পাওয়া যায় সে সময়ই ইংরেজি শেখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমরা শিখতে পারি না, কারণ আমাদের অধিকাংশ ইংরেজি শিক্ষকই মূর্খ ও দালাল। এদের ইংরেজি শেখানোর মানসিকতার চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর মানসিকতা প্রবল। আর ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, এদেশের হাইস্কুল লেভেলের ইংরেজি ক্লাস নেয়া শিক্ষকদের ৮৩ ভাগের ব্যাকগ্রাউন্ডই ইংরেজি নয়।
পৃথিবীর অধিকাংশ জ্ঞানভাণ্ডার চারটি ভাষার পুস্তকে আবদ্ধ। আরবি, ফার্সি, ফরাসি ও ইংরেজি। এখন এই চারটি ভাষা আয়ত্ত করতে পারলে জ্ঞানরাজ্যে অবাধ ঘুরাঘুরির বিস্তর সুযোগ মেলে। ভাষা শেখার পরও উচ্চারণে সমস্যা থেকে যায়। অনেক সময় আমাদের ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ সঠিক হয় না। কারণ যাদের এটি মাতৃভাষা আমরা তাদের কাছ থেকে শিখিনি। ওস্তাদ সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, কোনো ভাষা শিখতে চাইলে তাদের কাছ থেকে শিখবে যাদের এটি মাতৃভাষা। তবে তোমার উচ্চারণ সঠিক হবে। তিনি বলেন, আমার ইংরেজি উচ্চারণ তেমন ভালো না আবার আমার জর্মন উচ্চারণ খাঁটি জর্মনদের মতো। (আলী সাহেবের ইংরেজি উচ্চারণও অসাধারণ ছিল। ইউটিউবে তার লেকচারটা শুনলেই বোঝা যায়)
আরবি, ফার্সি জানাটা অনেকের কাছে সেকেলে মনে হলেও বিষয়টা তা নয়। বিশেষ করে ফার্সি ভাষাটা জানা এখন অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন ফার্সি, সংস্কৃত, আরবি ভাষা জানা লোকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই গবেষণায় মূল সোর্স ও অনুবাদিত সোর্সের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। ওস্তাদ আলী সাহেব এরকম একটি কথাতেই বলেন, ফার্সি ভাষা জানা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদের প্রকৃত ইতিহাস জানা অসম্ভব।
কথায় কথা বাড়ে। আর বড় কথা অনেকে পড়ে না। তাই ছোট করে আরও কিছু বলি। আমার মনে মাঝে মধ্যে আজব আজব ইচ্ছা জাগে। এই ইচ্ছা মনের মধ্যে সুপ্ত থাকে। আর আচনক সুপ্ত ইচ্ছা তপ্ত হয়ে ফুটে ওঠে। একসময় ইচ্ছা ছিল ইংরেজি শিখবো। কিছুদিন ইংরেজি শেখা শুরু করলাম। উর্দু শেখার বাসনা স্তিমিত হয়ে গেল। বহুদিন ভাষা শেখার এসব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা স্থগিত ছিল। হঠাৎ আবার ইচ্ছা হলো হিন্দি শিখবো। হিন্দি শেখার চেষ্টায় সামান্য সফলতা অর্জন করেই আবার মনে হলো, ফার্সি শিখি।
ভাষা শেখার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন করে নিজকে বিনয়ের দ্বারা সাজিয়ে অহংকারকে পরাজিত করা। এখন আপনি দুই এক কলম ইংরেজি শিখে এমন ভাব ধরেন আর অন্যদের হেলাফেলা করেন, যেন ইংরেজি ভাষাটা মঙ্গল গ্রহের আর এটি কেবল পৃথিবীতে আপনিই জানেন। আপনার এমন ইংরেজি জ্ঞানের উপর মূত্রবিসর্জন করা যেতেই পারে।
ওস্তাদ আলী সাহেব দেড় ডজন ভাষা জানতেন। কেমন জানতেন? এক মহিলা আলী সাহেবের ভাষাজ্ঞানের প্রশংসা করলে তিনি একটি গল্প লেখেন। গল্পটির নাম হচ্ছে, ‘ঊনপঞ্চাশ বছর ধরে করছি সাধনা। কটা ভাষা? হায়! বাংলাটাই হলো না।’