সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ৫

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২১

ভারত ভাগের সময় সাতচল্লিশ সালে যে দাঙ্গা হলো, সত্যিকার অর্থে তার দায় কি হিন্দু মুসলমানের ছিল? নাকি ব্রিটিশ প্রশাসন আর রাজনৈতিক নেতারা তা বাধিয়ে তুলেছিলেন? ভারত ভাগের জন্য ব্রিটিশ সরকার সময় দিয়েছিল উনিশশো আটচল্লিশ সালের জুন মাস পর্যন্ত। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তা এগিয়ে সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসে নিয়ে এলেন কেন? মাউন্টব্যাটেন আর জওহরলাল চাইছিলেন দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। মাউন্টব্যাটেন-এর তাড়াহুড়ো করার পেছনে ভিন্ন একটি কারণ ছিল, ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে তাঁর একটি বিশেষ কার্যভার গ্রহণ করার কথা ছিল। কংগ্রেসের ভয় ছিল, দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর না হলে সাম্যবাদীরা আবার কোনো আন্দোলন শুরু করে দেয় কিনা। ইতিপূর্বে নৌবিদ্রোহ ঘটে যাবার ফলে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন একটি চিঠিতে জানান, ‘এটি একটি পাহাড়প্রমাণ কাজ এবং এই কাজের সামান্য অংশমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সমাপ্ত হতে পারে। মানে দাঁড়ায়, কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়। কিন্তু মাউণ্টব্যাটেনের হাতে সময় ছিল আরো দশমাস। কিন্তু তিনি সে সময়টা কাজে না লাগিয়ে একটা গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা করেন। কারণ জিন্নাহকে তখন তারা খলনায়ক বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

জিন্নাহ পাঞ্জাব আর বাংলা-ভাগ ঠেকাতে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন। শুচিব্রত সেন এবং অমিয় ঘোষ জানাচ্ছেন, জিন্নাহ বাংলা-ভাগ ঠেকাতে বলেছিলেন, বাংলাকে তিনি পাকিস্তানে চান না এর পরিবর্তে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম বঙ্গদেশ মেনে নেবেন। কংগ্রেস কি তখন ‘অবিভক্ত বাংলা’ মেনে নিতে রাজি হয়েছিল? কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যুক্তবঙ্গের প্রথম প্রস্তাব করেন আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু। সুহরাওয়ার্দী এই প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসেন। ইতিমধ্যে বাংলার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ও স্বাধীন বঙ্গের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সুহরাওয়ার্দী হিন্দুদের অনেক আশ্বাস দেয়ার পর স্বাধীন বাংলার জন্য একটি সংবিধানও রচিত হলো। বলা হলো, এটি হবে এক সমাজবাদী সাধারণতন্ত্র। মুখ্যমন্ত্রী হবেন মুসলমান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন হিন্দু। কংগ্রেস বা গান্ধী কেউ তা সমর্থন করলেন না। গান্ধী শরৎ বসুকে লিখলেন, ‘এটা আমার মনে হয় তোমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হবে না... তোমার উচিত হবে বাংলার অখণ্ডতার জন্য সংগ্রাম পরিত্যাগ করা এবং বঙ্গভঙ্গের জন্য যে পরিবেশ রচিত হয়েছে তাতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করা।’ বাংলা-পাঞ্জাব-ভাগের কথা তাহলে বারবার কারা বলছেন, কারা তবে হিন্দু আর মুসলমানকে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করতে চাইছেন? কিন্তু নাটক সাজানো হচ্ছে জিন্নাহকে দায়ী করে।

সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় কী তথ্য দিচ্ছেন? তাঁরা লিখেছেন, এই সময়ে স্বাধীন বাংলার দাবিও প্রবল হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু দায়িত্ববান হিন্দু ও মুসলমান নেতা এই দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সাতচল্লিশের তেইশে এপ্রিল ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমউদ্দীন বলেন, ‘মুসলমান হোক বা অমুসলমান হোক, বাংলার জনগণের স্বার্থে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সবচেয়ে ভালো...প্রদেশের বিভাগ বাংলার স্বার্থের পক্ষে ধ্বংসাত্মক। বাংলা নিজের ভাগ্য নিজে পরিচালনা করুক। এই দাবির যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত হচ্ছে বাংলাকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া।’ জিন্নাহ তখন একইভাবে উনিশশো সাতচল্লিশ সালের মে মাসের শেষে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে বলেছিলেন, পাঞ্জাব এবং বাংলা বিভাজন সম্বন্ধে দুই প্রদেশের মানুষের অভিমত গণভোটের মাধ্যমে যাচাই করা হোক। গণভোট হলে পাঞ্জাব আর বাংলাকে ভাগ করা যেতো কিনা সন্দেহ! ব্রিটিশ সরকার তা করেনি, কংগ্রেস তা চায়নি। জওহরলাল চেয়েছিলেন খুব দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। সিদ্ধার্থ গুহ রায় আর যশোবন্ত সিং দিচ্ছেন এইসব তথ্য। বাংলাকে অবিভক্ত রাখার জন্য জিন্নাহ যেমন সুহরাওয়ার্দী-শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, পাঞ্জাবকে অবিভক্ত রূপে পাবার জন্য তিনি শিখ নেতাদের নেহরু-প্যাটেলের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কংগ্রেস যখন বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ করে তখন কি জানা ছিল না, হিন্দুদের একটি অংশ সংখ্যালঘু হিসেবে পাকিস্তানে থেকে যাবে এবং হয়তো তাদের মানসিক যাতনার শিকার হতে হবে। বাংলাকে তো পাকিস্তানের হাতে সমর্পণ না করে স্বাধীন রাখাই যেতো। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা তাতে রাজি হলেন না কেন? জিন্নাহ বহুভাবে চেষ্টা করেও বাংলা আর পাঞ্জাব-ভাগ ঠেকাতে পারলেন না। মাউন্টব্যাটেনের ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যেতে হলো। ব্রিটিশ বেনিয়া-শাসক আর ভারতীয় নব্য শিল্পপতি-বণিকদের কারণেই বাংলা-ভাগ, পাঞ্জাব-ভাগ আর ভারত ভাগ মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

যখন দেশভাগ নিশ্চিত, তখন ভারতবর্ষে যেসব মুসলমানদের থেকে যেতে হচ্ছে ছয়ই জুলাই জিন্নাহ তাঁদের পরামর্শ দিলেন, ‘সংখ্যালঘুরা যে রাষ্ট্রের অধিবাসী তার প্রতি অনুগত হবেন।’ সাতই আগস্ট তিনি স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে বলেছিলেন, ‘অতীতকে কবর দিতে হবে এবং আসুন আমরা হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামক এই দুই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের শুভারম্ভ করি। হিন্দুস্থানের সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য আমি কামনা জানাই। জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব দিলেন তখন জগন্নাথ আজাদকে। পাকিস্তানে সে সময় অনেক বড় বড় নামিদামি উর্দু কবিরা ছিলেন। জিন্নাহ বললেন, থাক; আমি চাই একজন সংখ্যালঘু ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করবেন। জিন্নাহ এভাবেই পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। জগন্নাথ আজাদ জিন্নাহর নির্দেশ পেয়ে তড়িঘড়ি করে জাতীয় সঙ্গীত রচনা করে দিয়েছিলেন। জিন্নাহ তাঁর অপরিচিত এই তরুণের লেখা গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করলেন। জিন্নাহ এসব ক্ষেত্রে নানারকম প্রগতিশীল মনোভাব দেখালেও তিনি মুসলমানদের দ্বারা দেশবিভাগের আগে ও পরে পাঞ্জাবের দাঙ্গায় অংশগ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। পাঞ্জাবের লীগ নেতারা তাঁদের যুব কর্মীদের দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করার মধ্যে নিন্দার কিছু দেখেননি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দাঙ্গায় এপ্রিলের মাঝামাঝি পাঞ্জাবে পঁয়ত্রিশশো মানুষ মারা যায়। যার মধ্যে মুসলমান ছয় ভাগের এক ভাগ, বাকিরা হিন্দু এবং শিখ। জিন্নাহ এবং গান্ধী তখন দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য যৌথভাবে একটি বিবৃতিতে বললেন, ‘কারা আক্রমণকারী আর কারা তার শিকার ছিল; এ বিবেচনায় না গিয়ে আমরা সাম্প্রতিক আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী হিংসাত্মক ঘটনাবলীর জন্য গভীর পরিতাপ ব্যক্ত করছি। এইসব ঘটনা ভারতের সুনামের উপর দুরপনেয় কলঙ্ক লেপন করছে এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের আত্যন্তিক দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের জন্য হিংসার সহায়তা নেওয়াকে আমরা সর্বদা নিন্দা করি এবং দল-মত-নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সকল সম্প্রদায়ের কাছে এই আবেদন জানাই যে, তাঁরা  হিংসা ও বিশৃঙ্খলার যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকবেন।

সত্যি বলতে মাউন্টব্যাটেনের বা ব্রিটেনের কী উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়? যশোবন্ত সিংহ মন্তব্য করেন, সাম্রাজ্যের অবসান নিশ্চয় ব্রিটিশদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়েছিল, কিন্তু তারা সে-কথা কাউকে জানাতে পারেনি। কিন্তু ভিতরের ক্রোধকে প্রশমিত করতে ভারতকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল ভাইদের মধ্যে তীব্র বিরোধ বাধিয়ে দিয়ে। ব্রিটেনের ক্ষোভের বা তার ভুলের মাশুল দিতে হলো ভারতকে। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে তারা টিকিয়ে রেখে গেল চিরস্থায়ী বিভেদ। হিন্দুর অভিযোগ মুসলমানদের প্রতি, মুসলমানদের অভিযোগ হিন্দুর প্রতি। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে এখনো, আসল শত্রু চলে গেল আড়ালে। প্রায় দুশো বছর ধরে ভাইয়ে-ভাইয়ে এইরকম বিরোধ বাধিয়ে দেয়ার খেলা খেলবার ঘুঁটি সাজিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ মুহূর্তেও সে খেলা বন্ধ ছিল না। ইতিহাসে রয়ে গেছে তার প্রমাণ। মাউন্টব্যাটেন সীমান্ত ভাগ করার কাজ আরম্ভ করলেন এবং যতোটা দ্রুত সম্ভব। যদিও দুটো কমিশন গঠন করার কথা দুজন সভাপতির অধীনে। মাউন্টব্যাটেন দুটি কমিশনের জন্য মাত্র একজন সভাপতি নিয়োগ দিলেন, তিনি হলেন সিরিল জন র‌্যাডক্লিফ। কংগ্রেস প্রথম র‌্যাডক্লিফের নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তি জানায়, কিন্তু পরে সুর নরম করে। পরবর্তীতে জুন মাসের বারো তারিখে মাউন্টব্যাটেনকে লেখা চিঠিতে পাঞ্জাব আর বাংলার জন্য সীমান্ত ভাগের বিষয়ে কমিশনের নির্দিষ্ট তালিকা সংযুক্ত করে জওহরলাল বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য করবেন যে, এগুলি খুবই সরল এবং সংক্ষিপ্ত...এটা সীমান্ত কমিশনের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো...সীমান্ত কমিশনের কাজ মানেই সেটা দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হওয়ার কথা।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি বিষয়টাকে এই স্তরে জটিল করে তুলি কাজটা প্রলম্বিত হবে আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা পিছিয়ে যাবে। আমি মনে করি যখন দুটি রাষ্ট্র তৈরি হয়ে যাবে, এই দুটি রাষ্ট্র সীমান্তের ভিন্ন রূপ বা অদলবদল নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায় আসবে, যাতে একটা সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানো যায়।’ যশোবন্ত সিংহ মন্তব্য করেছেন, জওহরলাল যা বলেছিলেন তা প্রায় অবিশ্বাস্য রকম অবাস্তব আর অতিসরল কথা। একটা দেশ অনতিক্রমণীয় মতবিভেদের জন্য ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সীমান্তের ‘ভিন্ন রূপ আর অদলবদল’ নিয়ে আর কখনো ‘পারস্পরিক’ আদান প্রদান হতে পারে? চলবে