সব থেকে বড়ো প্রচার ভালো লেখা

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২২

প্রায়শই আমাদের লেখকদের বলাবলি করতে দেখি, তারা ওমুককে বই দিয়েছেন অথচ তিনি বইটি পড়েননি। অথবা তিনি তমুককে বই দিয়েছেন তমুক বইটি না পড়ে কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে লেখক নিজের অটোগ্রাফ দেওয়া বইটি ফুটপাতে খুঁজে পেয়েছেন। এ ধরনের বিস্তর অভিযোগ লেখকরা একে অপরের বিরুদ্ধে করে থাকেন। কখনো তরুণ লেখকরা বলেন, প্রবীণ লেখকরা তরুণদের বই পড়েন না। কখনো আবার প্রবীণ কোনো লেখক জনপ্রিয় তরুণ লেখকের সম্পর্কে একই ধরনের অভিযোগ করেন। যে, তরুণটি তার লেখা বই পড়েনি অথবা তিনি বইটি উপহার দিলেও বইটি পড়ে কোনো রিভিউ দেয়নি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপহার দেওয়া বই কেন পড়তে হবে? ধরুন, কেউ এখন ছড়া লিখতে চাচ্ছেন। সুতরাং তিনি নিজেই ছড়ার বই সংগ্রহ করে পড়বেন। আবার ছয় মাস পড়ে যদি তিনি গল্প লিখতে চান, তখন তিনি গল্পের বই সংগ্রহ করে পড়বেন। অর্থাৎ প্রয়োজনীয়তা। অর্থাৎ যে কোনো লেখকের কাছেই নির্দিষ্ট বা পছন্দের বই পড়ার একটি তাগিদ থাকে। যখন যে বইটি লেখকটি পড়তে চায়, তখন সে বইটিই তার কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। তিনি যদি তার কাঙ্ক্ষিত বইটি কিনতে না পারেন, তবে ধার করে পড়বেন। না হলে পিডিএফ পড়বেন। না হলে ফটোকপি করে পড়বেন। অর্থাৎ বইটি প্রয়োজনীয় হলে যে কোনোভাবে হলেও তিনি পড়বেন। প্রয়োজনীয় না হলে পড়বেন না। সে যত কাছের লেখকই বই উপহার দিক না কেন!

যেমন কারো জ্বর এসেছে। প্যারাসিটামল তার কাছে খুব প্রযোজনীয় ঔষধ। যার জ্বর নেই, তার কাছে প্যারাসিটামলের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। সুতরাং তার কাছে প্যারাসিটামল গুরুত্বহীন। এখন কেউ যদি একজন সুস্থ মানুষকে প্যারাসিটামল দেন, তিনি সর্বোচ্চ ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে ভেবে সেটি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। এর থেকে বেশি কিছু তার কাছ থেকে আশা করা যায় না।

এখন লেখকরা বেশিরভাগ সময় লেখককেই বই উপহার দেয়। অথচ বই উপহার দেবার সময় ভুলে যায় প্রতিটা লেখকেরই বই পড়ার একটা টার্গেট থাকে। কোনো লেখককে কেউ বই উপহার দিল অথচ লেখকের টার্গেট তখন অন্য বই পড়ার, তাহলে লেখক উপহার দেওয়া বইটি পড়বেন না। কারণ বইট পড়া তার প্রয়োজন নেই। তিনি হয়তো তখন অন্য টার্গেট নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সুতরাং উপহার দেওয়া বইটি তখন তিনি ফেলে রাখবেন।

অর্থাৎ, যে জিনিসটা যার কাছে প্রয়োজনীয়, সে জিনিসটা তাকে দিলেই সঠিক দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় না হলে অনেকটা শেয়ালকে কুঁজোতে করে খেতে দেওয়া ও সারসকে প্লেটে করে খেতে দেওয়ার মতো প্রহসন হয়।
তাহলে বই কি উপহার দেওয়া যাবে না? যাবে না কেন? যাবে। যার প্রয়োজন আছে তাকে দিতে হবে। খুঁজে খুঁজে। আবেগ তাড়িত হয়ে যাকে তাকে বই দেওয়া যাবে না। এমনকি একটা প্রায়মারি স্টুডেন্টকেও নয়। কারণ তারও সময়ের মূল্য আছে। তারও চয়েজ আছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, বই কারা উপহার দেয়? যারা বই নিজের টাকায় ছাপে বা প্রকাশকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমান বই টাকা দিয়ে কিনে নেয়, তারা বই উপহার দিয়ে বেড়ায়। ভালো লেখক সহজে বই উপহার দিতে পারে না। কারণ, একজন লেখককে একজন প্রকাশক সর্বোচ্চ পাঁচ, দশ বা বিশ কপি বই লেখক কপি হিসেবে উপহার দেয়। এর থেকে বেশি বই পেতে হলে লেখককে প্রকাশকের কাছ থেকে বই কিনে নিতে হয়। তাই তিনি বই উপহার দিতে পারেন না। কারণ, এই সামান্য কটি বই তো লেখকের আর্কাইভ করতেই লাগে, উপহার দেবেন কীভাবে?

এখন লেখক কাউকে বই দিলে বইটি যদি তার কাছে অপ্রয়োজনীয় জিনিস হয়, তবে তো তিনি বই কেজি দরে বিক্রি করবেনই। বই তো ঠোঙা হবেই। অনেকে বলতে পারেন, বই কি অপ্রয়োজনীয় জিনিস হতে পারে? হ্যাঁ পারে। এই নাগরিক জীবনে মানুষের বাসাবাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। মানুষ চাইলেও পর্যাপ্ত বই রাখতে পারে না। তাই যারা প্রকৃত পাঠক, যাদের পাঠোভ্যাস দীর্ঘদিনের, তারা বেছে বেছে বই সংগ্রহ করেন। বেছে বেছে বই পড়েন। বেছে বেছে বই আলমারিতে রাখেন। অপ্রয়োজনীয় বই রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা তাদের আলমারিতে থাকে না।

এখন প্রশ্ন হলো, বই তো টাকা খরচ করে লেখক করতেই থাকবেন। আবার বইগুলো তো কাউকে না কাউকে দিতেও হবে। তাহলে বই কাকে দেবেন নতুন লেখক? বই দিলে দিতে হবে লাইব্রেরিতে। প্রত্যেকটা স্কুল-কলেজে লাইব্রেরি আছে। শহর-গ্রামেও লাইব্রেরি আছে। বই দিলে সেখানে দিতে হবে। তাহলে প্রকৃত পাঠক সেই বইটি খুঁজে পড়বে। আর যদি সেটা না করে কেউ কাউকে বই দিয়ে নিজের নামে বা নিজের লেখার গুণ নিয়ে স্তুতি বাক্য শুনতে চায়, তাহলে তার কপালে দুঃখ, হতাশা ও বঞ্চনাই লেখা থাকবে। তাকে আর যোগ্য লেখক হওয়া হবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, সব থেকে বড়ো প্রচার ভালো লেখা। কেউ ভালো লিখলে তা থেকে সুঘ্রাণ বেরবেই। প্রকৃত পাঠক মধুলোভি মৌমাছির মতো সেই বইয়ের মধু পান করতে ঠিক যাবেন। অতএব, লেখকদের উচিৎ ভালো লেখার পেছনে মনোনিবেশ করা। টাকা খরচ করে বই করা, সম্পাদক বা প্রকাশকদের পিছে পিছে না ঘুরে সেই সময়টুকু দিয়ে ভালো বই পড়লে ও ভালো লেখার চেষ্টা করলে আখেরে লেখক জীবনের উন্নতি ছাড়া অবনতি হয় না। জনে জনে বই উপহার দিয়েও বেড়ানো লাগে না। ভালো লিখলে, ভালো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি হলে, প্রকাশক অগ্রিম টাকা দিয়ে সে বইয়ের পাণ্ডুলিপি নেয়। পাঠকও নিজ গরজে খুঁজে খুঁজে সে বই কিনে নিয়ে পড়ে।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক