সবার গোল এক হইলেও ঐক্য হয় না কেন

মঈনুল ইসলাম তুহিন

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০১৯

আবরার ইস্যুতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলার মধ্যে বহুল কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের দেখা পাওয়া গেল না। এইটা খুবই অ্যালার্মিং, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য। আবরার হত্যার ইস্যুটি বিচ্ছিন্ন কিছু না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে সন্ত্রাস, হল দখল, গেস্টরুম, গণরুম, সিট বণ্টনে প্রশাসনের ভূমিকাহীনতা— এই সবগুলার বাই প্রোডাক্টই মূলত আবরার এবং তার মতো আরো অসংখ্য শিক্ষার্থী। এর সাথে যুক্ত হইছে ভারত-বাঙলাদেশের সম্পর্ক ও ভারতের কাছে নতজানু আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আলাপটিও। এসবই মূলত দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থারই কিছু দিক বা সিম্পটম মাত্র।

এই অবস্থায় একটা শক্তিশালী ছাত্রঐক্যের বিকল্প আর নাই। কিন্তু সবার এনিমি কমন হইলেও, গোল এক হইলেও, ঐক্য হয় না কেন? এইটি নিয়ে ভাবা দরকার। এই ব্যাপারে আমার অবজার্ভেশন সংক্ষেপে জানানো যাইতে পারে। শুরুতেই বইলা রাখা ভালো যে, ঐক্যপ্রক্রিয়া নাকাম হওয়ার দায় অন্তত এবারের ইস্যুটিতে, কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনমাত্রের নয়। ঐক্যের ব্যাপারে এইবারের মতো আন্তরিকতা অতীতে দেখা যায় নাই। দল-লাইন-মত-পথ ইত্যাদি বিতর্কগুলি কিছুটা হইলেও ঝিমায়ে আসছে এই মুহূর্তে। মূলত, এই ঐক্যটি না হওয়ার কারণ হিশাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে যাওয়া জালিয়াতির ডাকসু নির্বাচনটির ফলে উদ্ভূত, নতুন রাজনৈতিক সমীকরণটিরে দায়ী করা যাইতে পারে।

প্রথমত, আবরার হত্যাসহ অন্যান্য যেকোনো ইস্যুরেই, ছাত্র সংগঠনগুলি এই মুহূর্তে নিজেদের সাংগঠনিক রাজনীতি ও ব্যক্তিগত রাজনীতির জন্য অপরচুনিটি হিশাবেই ট্রিট করতেছেন। সেটা করা খুব একটা খারাপ, তা বলি না; কিন্তু সাংগঠনিক রাজনীতির হিশাব-নিকাশ করতে গিয়া যখন একটা বৃহত্তর সম্ভাবনারে শেষ কইরা দেওয়া হয়, সেইটা কিছুটা কলঙ্কেরই ব্যাপার বোধহয়। এর দায় এড়াইতে পারে না, এমনকি সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারাও। একটা ঐক্যমঞ্চের জন্য তারা যে কিছুমাত্র ছাড় দিতেও রাজি হইলেন না, এইটা তাদের ডাকসুর প্রতিশোধ নাকি সামনের ডাকসুর প্রস্তুতি নাকি আরো ভিন্নকিছু— তা আমার কাছে পষ্ট না। সাংগঠনিক রাজনীতির চুলচেরা হিশাব-নিকাশের যে ভূত তাদের মাথায় এই মুহূর্তে সওয়ার, এইটা দিনশেষে তাদের রাজনীতিতে কী ধরণের সুফল নিয়া আসবে, তা নিয়া আমি যথেষ্টই শঙ্কিত।

দ্বিতীয়ত, এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও, কেউ কেউ ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিতে নারাজ। এই নারাজির কী কারণ, আমরা জানি না। হইতে পারে, ওনারা `রাজনীতি` করতে চান না। বা, কিউট রাজনীতিটাই করতে চান। কিন্তু, অতীতে পপুলিস্ট রাজনীতিতে স্টেক নিতে গিয়া তাদের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হইছে, এই অভিজ্ঞতাটি তাদের আবারো পর্যালোচনা করা উচিত। কেবল ডাকসু নির্বাচনই যদি কোনো রাজনীতির মূখ্য ব্যাপার হয়, সেইটা আসলেই খুব দুঃখজনক।

তৃতীয়ত, লেফটিস্টরা আছেন পুরান বৃত্তেই। যদিও, এইবার তাদের বরফকঠিন `লাইন`র অভিমান অনেকটাই বিগলিত হইছিল, ঐক্যের আন্তরিকতাটিও তুলনামূলকভাবে ছিল বেশিই। কিন্তু ডাকসুর সময় যে স্ট্রাটেজিক ভুল তারা করছেন, তার খেসারত এই মুহূর্তে দিতে হইতেছে তাদের। সামনে আরো দিতে হবে, সম্ভবত।

চতুর্থত, আবরারের ইস্যুটিরে সরকারের স্ট্রাটেজিক উইং নয়া নয়া ডাইমেনশন দিতে চাইতেছেন। এই মুহূর্তে বাঙলাদেশের সবচাইতে বড় ইস্যু আবরার হত্যা বা হলের দখলদারিত্ব নয়, বরং ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। হাইকোর্টে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণের জন্য রিট হইছে। সুশীলসমাজও মুহুর্মুহু কলামবাজির মাধ্যমে এটিরে বরণ করে নিতে চাইছেন। সেই ডাকসুর সময়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন, জালিয়াতির ডাকসুতে এক অভিনব ফলাফলের মাধ্যমে সম্ভাব্য ছাত্র আন্দোলনটিরে হত্যা, ছাত্রলীগে নেতৃত্বের টানাপোড়েন, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নেতৃত্বের নতুন সমীকরণ, যুবলীগের বিরুদ্ধে অভিযান, ক্যাসিনো-কাণ্ড, যুবলীগ চেয়ারম্যানের `বিরাজনীতিকীকরণ` থিওরি, আবরার হত্যা, সম্ভাব্য সকল পন্থায় শুধুমাত্র যুবলীগ ও ছাত্রলীগরে ডেমোনাইজ করা, মিডিয়া ও সুশীল সমাজের এতে ব্যাপক সমর্থন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা, হাইকোর্টে রিট— এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ একটা অদৃশ্য সুতায় গাঁথা বইলা আমাদের ধারণা।

আবরার হত্যাটি এই যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণে আইসা ঠেকলো, এটি সরকারের ফিউচার স্ট্রাটেজি হওয়া অস্বাভাবিক না। বাঙলাদেশে যে নয়া ছাত্ররাজনীতির উত্থান, তার জন্য এই নিষিদ্ধকরণ, সম্ভবত, লাভজনক। ফলে, এই নতুন ধারার ছাত্রনেতারা, যারা কয়দিন আগ পর্যন্তও জোরেশোরে ছাত্র রাজনীতির কথা বলছে, তারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে নীরব। এর একদিকে আছে পপুলিস্ট মতামতের চাপ, অন্যদিকে নিজেদের সাংগঠনিক চিন্তা। কিন্তু, সরকারের স্ট্রাটেজি আর তাদের স্ট্রাটেজি যখন এক, তখন দুই পক্ষের জন্যেই এইটা একটা জুয়া খেলার মতো। এই খেলায় জয় কার হবে? সরকারের জয় রুইখা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি বা নেতা আমরা এখনও অব্ধি দেখি নাই। বরং, বারবারই, আমরা দেখছি সরকারের সাফল্য, সেটি যেভাবেই আসুক। এইটা ডাকসুর সময় থেকে নিয়া আজ অব্ধিও, চলমান আছে।

আবরারের খুনরে কেন্দ্র কইরা কোনো ঐক্য করতে পারা গেল না। এইভাবে প্রত্যেকটা ইস্যুতেই, ছাত্রসমাজের বড় একটা অংশ একটু একটু কইরা ডিমোরালাইজড হইতেছেন আন্দোলন ইত্যাদির ব্যাপারে। কিন্তু রাজনীতির স্বাদ পাওয়া পুরান ও নতুন নেতাদের এই ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা আছে, এমন মনে হয় না। কেউ কেউ নিজেদের উপস্থিত সাফল্যে খুশি, কেউ কেউ উপস্থিত ব্যর্থতায় হতাশ। তবে আশার কথা, সাধারণ ছাত্র বলতে যেই বর্গরে আমরা বুঝি, তারা সবসময়ই থাইকা যায়, একইরকম জাগরণের স্পৃহা নিয়া। কেবল নেতা আর সংগঠন বদল হয়, ইস্যু বদল হয়, কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের স্পিরিট বদলায় না। সেই স্পিরিটটুকুই আমাদের আগামীদিনের রাজনীতির ভরসা হইতে পারে।