দিল্লিতে সহিংসতা (ফাইল ছবি)

দিল্লিতে সহিংসতা (ফাইল ছবি)

সবকিছুই কেবল প্রতারণা আর ধোঁকাবাজি

জাভেদ আখতার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০

আমি মুম্বাইতে থাকি। বেশ কয়েক দিন ধরেই খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারছি দিল্লিতে খুব শীত। এমন শীত গত একশো বছরেও পড়েনি। এমন শীতের রাত শেষ ৭০ বছরেও আসেনি, এ রকম খবর প্রায়ই পড়ছি। মৌসুম তো আসা যাওয়া করবেই, অক্টোবরে শীত শুরু হয়, ফেব্রুয়ারির দিকে চলে যায়। যেভাবে সরকার আসে যায়, সেভাবে মৌসুম পরিবর্তিত হয়। কিন্তু একটা মৌসুম আছে যেটা সব সময়ই থাকে। সেই মৌসুম হলো অবিচার, শোষণ আর বেঈমানির! যেভাবে কখনো শীত কম-বেশি হয়, ঠিক সেভাবেই এই মৌসুমও চলে, কিন্তু সব সময়ই থাকে। আজকাল শীত একটু বেশিই লাগছে (রূপক অর্থে), অনেক বছরই এ রকম শীত লাগেনি।

এটা অনেক সময়েই বলা হয় যে, আসলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা হচ্ছে সেটাতে মুসলমানদের কোনো পরওয়া নেই, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এই সব কিছু যা হচ্ছে সেটা ভারতের সংখ্যালঘু সেটা মুসলিম হোক বা আর যেই সম্প্রদায়ই হোক, তাদের জন্যই শুধু হচ্ছে না। দেখুন, আমি মঞ্চে ওঠার জন্য যে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি, সেটা না থাকলে ওপরে আসতে পারতাম না। ঠিক সেভাবেই ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হলো সেই সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে কোথায়? ১২-১৫% সংখ্যালঘুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য? না, ভুল। নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে সেই ৮৫% হিন্দুদের! বাকি সব তো শুধুই বাহানা। আর আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে দুনিয়ার দিকে একবার নজর দিয়ে দেখো।

খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানের দিকে তাকাও। তারা মুসলিমদের বলেছিল, ‘তোমরা আলাদা দেশ বানিয়ে নাও, তাহলেই নিরাপদ থাকবে, শান্তিতে থাকবে, তোমাদের দেশ হবে শুধু ইসলাম নিয়ে।’ তারা বানালো আলাদা দেশ। ওখানে হিন্দুর পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তো নিশ্চুপ করে দেয়া হলো, এখন তারা কেমন আছে, কীভাবে থাকে সেটা নিয়েও ভালোমতো জানার উপায় নেই। কিন্তু পাকিস্তানের এখন যেসব মুসলমান আছে তারা কি খুব শান্তিতে বসবাস করছে, হ্যাঁ? তাদের কি অনেক স্বাধীনতা আছে? তাদের কি নিজেদের অধিকার মেলে? জবাব হলো ‘না’!

ভারতের এই খারাপ সময়েও আমার আপনার কাছে যেই স্বাধীনতা আছে সেটাও পাকিস্তানের একজন সাধারণ মুসলমানের কাছে নেই। তো তারা ভারতকে হিন্দু পাকিস্তান বানাতে চায়। কবজা করতে চায় আসলে হিন্দুদের, ১২-১৫% মানুষ কি এমন করে ফেলবে? তাদের জন্য এত পরিশ্রম কে-ই-বা করবে! যখন কেউ বলবে যে, তুমি বিপদে আছো, সমস্যায় আছো, বেঈমানির মুখোমুখি হয়েছ, তখন খবরদার কেউ নিজের হকের কথা, নিজের অধিকারের কথা বলবে না! ঠিক এটাই এখন হচ্ছে। আর এ রকম যখন হয়, তখন দেশের সব মানুষ গোলামে পরিণত হয়।

আচ্ছা একবার ভেবে দেখেন তো, এই দেশের জনগোষ্ঠীকে ভাগ কীভাবে করা হয়? সমাজকে কীভাবে ভাগ করা হয়? ‘এরা হিন্দু, ওরা মুসলিম, এরপর শিখ, এরপর খ্রিস্টান, পার্শি’ ইত্যাদি ইত্যাদি এভাবেই কেন ভাগ করা হয়? কেন এভাবে ভাগ করা হয় না যেখানে বলা হবে, ‘এরা বিশাল ধনী, এরা অনেক ধনী, এরা মধ্যবিত্ত, এরা গরিব, এরা অনেক গরিব, এরা একেবারেই নিঃস্ব? এভাবে তো ভাগ করা যাবে না! কারণ এভাবে ভাগ করলে সবার আসল রূপ বেরিয়ে আসবে, সবার চেহারা থেকে মুখোশ খুলে পড়ে যাবে! এজন্য হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান এভাবেই ভাগ করতে হবে। কারণ যদি ধনী গরিব দিয়ে ভাগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে ধনী আছে খুবই অল্প। কিন্তু নিচে যেই কোটি কোটি কোটি গরিব রয়েছে তাদের বিশাল অংশ হলো হিন্দু। আজকে দেশে যেই বেকারত্বের হার, সেটা কি শুধুই সংখ্যালঘুদের মধ্যেই আছে? সংখ্যাগরিষ্ঠ সবাই কি চাকরি পেয়ে গেছে? এই দেশের প্রায় ১০ কোটি লোক রাতের বেলা খালি পেটে ঘুমায়, তারা সবাই কি সংখ্যালঘু? মুসলমানরা খালি পেটে ঘুমাচ্ছে শুধু? খোঁজ নিয়ে দেখুন প্রায় বেশির ভাগ হিন্দুরা ঘুমাচ্ছে।

এই কথাগুলো হিন্দুদের কাছ থেকে লুকানো হচ্ছে। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে অন্য জিনিস। তাদের বলা হচ্ছে, ‘তোমরা তোমাদের বেকারত্ব নিয়ে ভেবো না! তোমাদের ঘর নেই সেটা ভেবো না! দুবেলা পেটে খাবার জুটছে না সেটাও ভেবো না! বাচ্চাদের জন্য স্কুল নেই সেটাও ভেবো না! তোমাদের স্ত্রীদের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, সেটাও ভেবো না! তোমরা শুধু ভেবো যে, তোমরা সবাই হিন্দু! গর্ব করো তোমরা হিন্দু সেটা ভেবে! অনাহারে মারা যাও, বাচ্চা ভিক্ষা করুক, স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় মারা যাক, কিন্তু তোমরা গর্ব করে বলো যে তোমরা হিন্দু! আমরা তোমাদেরকে রুটি, চাকরি, স্কুল, চিকিৎসা, ঘর কিছুই দেব না, শুধু হিন্দু হওয়ার গর্ব দেব, সেটা নিয়েই থাকো তোমরা!’

এই সবকিছুই কেবল প্রতারণা আর ধোঁকাবাজি। এই দেশের যত সব আসল সমস্যা আর ইস্যু তার বিশাল অংশ টিভি কিংবা পত্রিকা, কোথাও দেখা যায় না! এগুলো কী হচ্ছে, কী ধরনের কথাবার্তা আমার বোধগম্য নয়। একজন সাধারণ ভারতবাসীকে তুমি কীভাবে জিজ্ঞেস করতে পারো সে ভারতীয় কি না? তার কাছ থেকে জন্মসনদ দাবি করবে? যেখানে ভারতের কোটি কোটি মানুষ তাদের জন্ম-তারিখই জানে না! কীভাবে করবে এসব? আর তারপর যেসব আদিবাসী, দলিত সমাজ, গরিব মুসলমান আছে তারা কী করবে? ধনী মুসলমানদের তো কিছুই হবে না, তাদের কাছে সবকিছুই আছে। এই পুরো সমস্যায় তো গরিবদের কেন্দ্র করে। আমার কাছে আসলে কোনো লাভ হবে? আমার আর আমার বাচ্চাদের তো অনেক টাকা, আমাদের তো কিছুই করতে পারবে না! এই পুরো সমস্যা গরিবদের নিয়েই। সেই সব মানুষকে তুমি প্রশ্ন করবে, সেই সব মানুষদের কাছ থেকে তুমি প্রমাণ চাইবে যাদের ভোটে তুমি ক্ষমতায় এসেছ? এখন তারা আর ভারতীয় নয়? তাহলে তুমি গদিতে কীভাবে বসলে? যখন তোমার ভোটের দরকার ছিল, তখন তারা ভারতীয় ছিল! আর এখন তুমি যখন তাদের ভোট পেয়েই গেলে, তখন প্রশ্ন করছো তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে? এটা তো তোমার নির্বাচনের আগেই করার দরকার ছিল, তখন কেন করোনি? তখনই তো বলে দেয়া দরকার ছিল যে, ‘যারা ভারতীয় না তারা আমাকে ভোট দিবেন না।’

তারা চায় যেসব গরিব হিন্দু, দলিত, আদিবাসী, মুসলিম আছে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে। এদের কোথায় পাঠিয়ে দেবে? পাকিস্তান, আফগানিস্তান ৫ জন মুসলমান ও নিবে না ভারত থেকে। যাদের তোমরা বলছ ভারতীয় না, তারা কোথায় যাবে? তারা এখানেই থাকবে, এখানেই কাজ করবে, চাকরি করবে। ১২-১৫ কোটি মানুষের জন্য ডিটেনশান ক্যাম্প বানাবে? সেখানে তাদের খাওয়াবে? তারা শুধুমাত্র ওই গরিব আদিবাসী আর দলিত সমাজ হতে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চায়, যারা কখনোই তাদের ভোট দেয়নি, দিবেও না। যারা তোমাদের ভোট দেয় না, তাদের ভোট না দিতে দেয়াই তো তোমাদের লক্ষ্য, এটাই একমাত্র কথা। আর ঠিক এটাই হলো সিদ্ধান্ত নেবার সময়। রাজনীতিতে ঠিক-ভুল ঘটনা হতেই থাকে। কখনো ভুলভাল বক্তব্য, কখনো সঠিক সিদ্ধান্ত, কখনো ইতিহাস বিকৃতি এসব হতেই থাকে, এত বড় দেশ, হতেই পারে। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, যে এ দেশের যেই গরিব জনমানুষের অংশ আছে তাদের ভোটাধিকার থাকা উচিত কি উচিত না? বাকি সবকিছুই অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা!

তাদের কথা একটায় আর তা হলো, যারা গরীব, দলিত, যারা তাদের ভোটার নয়, যারা অধিকার, রুটি, ঘর, শিক্ষা,চিকিৎসা এসবের দাবি করে,তারা যাতে ভোট দিতে না পারে। এই মানুষগুলো কোথাও যাবে না, তারা এখানেই থাকবে। আর এত বেশি মানুষকে হত্যা করাও সম্ভব নয়। তাই তাদের ভোটের শক্তি ছিনিয়ে নিতেই এতসব আয়োজন। তাই আপনাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আগামী নির্বাচনের আগেই। আপনারা কি চান এদেশের সবাই ভোট দিক নাকি শুধু তারাই দিক যারা এই অন্যায় নীতি মেনে নিতে চায়!

লেখক: গীতিকার, সুরকার, চিত্রনির্মাতা ও কবিত

অনুবাদ: তানজিম আজমি