সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘ভালোবাসার শেষটা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২০

কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৯৩৩ সালের ২৫ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের `আভাঁ গার্দ` লেখকগোষ্ঠীর অন্যতম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার রচিত ‘ভালোবাসার শেষটা’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আমার বিয়ের মাসখানেক আগে পর্যন্ত আমি ঘনশ্যামকে ডেট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর যেদিন এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে, গড়িয়াহাটের মোড়ের শোভা থেকে শেষপর্যন্ত নিজেই পছন্দ করে সাদা বেনারসিটা কিনলাম, তখনই ঠিক করলাম, আর। তাহলে আগামীকালই হোক আমাদের শেষ দেখা।

বেনারসি কেনা হয়েছে— এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে। যা বোঝার তাতেই বুঝে যাবে। বিয়ের ডেটটা ঘনশ্যামই বারণ করেছে জানাতে। প্রায় হুবহু একই গল্পে দিলীপ মিত্র—তখন ওরা আর জি কর-এ একই হোস্টেলে রুমমেট আর ফাইনাল ইয়ারে— ভাগ্নির ফুলশয্যার রাতে ঘাটশিলায় চলে যায় এবং সেদিনই সুবর্ণরেখার তীরে ‘আত্মহত্যা করে। অশ্বথের-শাখা থেকে নতমস্তকে ঝুলে ছিল সারাটি রাত। বিয়ের দিনটা আগে থেকে জানত বলেই না!

ওদের অবশ্য ছিল প্রায় ইনসেস্ট অ্যাফেয়ার। মেজদির মেয়ে। পিসতুতো খুড়তুতে হলেও কথা ছিল। উপায় ছিল না। অবশ্যি, উপায় আমাদেরও নেই। ঘনশ্যামের বউ-বাচ্চা আছে। অন্য কোনও চিন্তা-ভাবনা থাকলে অন্তত-উকিলের কাছে যেত। আর ডিভোর্স যদি হয়ও পাঁচ আর তিন বছরের দু-দুটো বাচ্চার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিবাহিত জীবনের শুরু তার ভবিষ্যৎ কি খুব উজ্জ্বল?

ভালোবাসার দাম গায়ে-গতরে গত পাঁচ বছর ধরে আমি যথেষ্ট দিয়ে গেছি—এভাবে দিয়েও যেতাম, যদি-না রজত এসে পড়ত। হঠাৎ দেখি, আরে! আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে। এদিকে বয়সও তিরিশ ছুঁলো বলে। মেয়েদের হিসেবে তো মধ্যাহ্নও নয়—রীতিমতন অপরাহ্ন। বাথরুমে টুলে বসে স্নান করতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করেছি, পেটের মাংস আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে, বোধ হয়তো রাতারাতিই, কত উপখাঁড়ি আর খাড়িবহুল হয়ে গেছে।

হ্যা, মিস্ট্রেস হয়ে থাকলে সারাজীবন থাকা যায় এভাবে, তবে সন্তানহীনা মিস্ট্রেস শেষবিচারে এক মহার্ঘ যৌনপুতুল ছাড়া কী? নায়ক-নায়িকার ভূমিকার অবসানে বাবা মার ক্যারেকটার রোল পাবার সম্ভাবনা সে চিত্রনাট্যে কোথায়? ওর ছোটভাই বনবিহারী কি আমাকে ‘বৌদি বলবে কোনওদিন নাকি ভাগ্নি মামি’ বলে ডাকবে? অতএব, যে-দিক দিয়েই ভেবে দেখা যাক না কেন, আমাদের যার পর নেই অলাভজনক লগ্নী। তাই যেদিক থেকেই দেখি, আমার বিবেক বেশ সাফ-সুতরা। তাছাড়া পাঁচ বছরে একটিবারের জন্যেও তো উকিলবাড়িতে গেল না। অবশ্য আমিও চাপ দিইনি। আমার বেরিয়ে যাবার রাস্তাটা তাই এখনও খোলা।

তোমার বিয়ের দিনটা ঠিক কবে, আমাকে বলবে না। দিলীপ মিত্রের গল্প বলে ঘনশ্যাম আমাকে বলে রেখেছে, আমি ওটা জানতে চাই না।

ওর মনের জোর দেখে আমি অবাক। ভরসাও পেয়েছি যথেষ্ট। সত্যি কথা বলতে কি, ওর এই স্ট্যান্ডটায় পুরোপুরি আস্থা না-রাখতে না-পারলে রজতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে আমি অগ্রসর হতেই পারতাম না। তৈরি করা ছাড়া কী? সবটা বানানো। অন্তত আমার দিক থেকে। ঘনশ্যামকে পূর্বাপর ও যথারীতি ডেট দিতে দিতেই আমি রজতের সঙ্গে এই কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছি। একসঙ্গে দু-ঘাটের জল খেয়ে গেছি, যতদিন সম্ভব। প্রথমে চার ফেলে কাছে এনে, তারপর বঁড়শিতে গেঁথে খেলিয়ে একদম ডাঙার কাছে এনে যখন আব-একটি খাচ মারার অপেক্ষা, আমি তখনই ঠিক করলাম—তা হলে আর না।

বেনারসি কেনা হলো, বিয়ের দিনটা বলতে বারণ করলেও, ঘনশ্যাম আমাদের ব্যাপারটা সবই জানত। এ নয় যে, লুকিয়েছি কিছু কখনও, ওর কাছে। এমনও হয়েছে, সারা দুপুর রজতের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধেবেলা ছুটে গেছি ঘনশ্যামের কাছে। যেভাবে পাখি ফেরে নীড়ে। না , ভুল। যে-ভাবে দিনান্ত রিপোর্টার ফেরে তার কাগজের অফিসে। নিউজ এডিটরের সামনে দাঁড়ায়।

আজকের ডেভেলপমেন্ট কী, বলো?
আজ তারা দেখাল রজত।
তারা? দুপুরবেলায়!
হ্যাঁ তারা। দুপুরে তারা দেখা যায় না নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে কেমন বুঝতে পারল তারামণ্ডলে গিয়েছিলাম আমরা। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, রজত হলে মাথায় হাতুড়ি মেরে এইসব পেরেক বসাতে হতো। তবু রজত। ঘনশ্যামের প্রেম তো আমাকে সারাজীবনের গ্যারান্টি দিতে পারে না। তা সে যতই সাঁচ্চা হোক। তাই রজত। হোক শূন্য, কিন্তু সেটাই উত্তর। আমি উত্তরমালা দেখে নিয়ে অঙ্ক কষতে বসেছি।

কী হলো ওখানে বলো?
কী আবার হবে?
কিছুই হলো না? অত অন্ধকার।
হবে কী করে। মনে হলো এই প্রথম মুখ তুলে আকাশ দেখছে। তারা-ফারা বলতে চেনে শুধু চাঁদ আর সূর্য। শুকতারা যে শুক্রগ্রহ তাই জানে না। সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে স্ট্রেটলাইন টেনে লুব্ধক দেখাচ্ছি যখন...

দেখাচ্ছ যখন?
বহুক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল। শেষে একবার আমার হাতের ওপর হাতটা রাখল—
তারপর… তারপর? তুমি নিশ্চয়ই হাতটা টেনে নিলে?
সুযোগ পেলাম কই। রেখেই, যেন রাখতে চায়নি—হাতে হাত লেগে গেছে—সাৎ করে টেনে নিল হাতটা। বুঝতে পারি আমার কন্টাক্ট লেন্স সরে যাচ্ছে গভীর কটাক্ষে।
তোমার মতো নাকি সবাই? বিশ্বকর্মা পুজোর দিন প্রথম দেখা, সপ্তমীর দিন কিস। তাও কি শুধু ঠোটে ? অষ্টমীর দিনে ফার্স্ট অ্যাটেম্পট, কিছুতেই পারে না, নবমীর দিনে দুটো ট্রফি-ফার্স্ট হাফ অ্যাণ্ড সেকেন্ড হাফে দু-দুটো গোল।

সেদিন আমরা বসেছিলাম পুরনো নিউমার্কেটে চুরির ছোট দোকানটার দোতলায়। প্যাসেজের দিকটায় সিলিং পর্যন্ত গ্লাস-প্যানেল। সাদা-লাল টিউনিক পরা ওয়েটার। ঘনশ্যাম বলে, বেশ বিলেত বিলেত লাগে। বিলেত বলতে আমেরিকা। ও যেখানকার এমডি। ওখানে ছোট শহরের ড্রাগ স্টোরগুলো নাকি এরকম। অবশ্য ওখানে নাকি বই, কফি, সিগারেট, কোল্ডড্রিঙ্কস, কেক-প্যাস্ট্রি মায় প্যারগেটিভ, কনট্যাসপটিভ থেকে বার্ডস, বিয়ার—সব মিলিয়ে এক হরেক রকমবা।

শীতের সকালবেলা। ৯টা-ফটা হবে। সবে মার্কেট খুলেছে। লোকজন কম। তাছাড়া মার্কেটের শব্দ এ-দোকানে ঢোকে না। শীতাতপের সঙ্গে শব্দও এখানে নিয়ন্ত্রিত। এই সাতসকালে আমরা এখানে এসেছি চ্যাপলিনে ‘বাই বাই জ’ নামে ফেস্টিভ্যাল ফিল্মটা দেখব বলে। আমিই টিকিট কেটেছি। বেনারসি কেনা হয়েছে শুনলে যা ভেবেছিলাম; যা বোঝার তখুনি বুঝল।

দিন ঠিক হয়ে গেছে?
কাঁধ পর্যন্ত মাথা হেলিয়ে আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু ওর মুখ থেকে চোখ সরালাম না। যা আশা করেছিলাম। একপলক যেন অন্ধকার, কিন্তু তারপরেই পট করে আলো জ্বলে উঠল।
বাহ, ঘনশ্যাম বলল, কে পছন্দ করল? মা না-বৌদি?
পছন্দ আমিই করলাম। যদিও মা সঙ্গে ছিল।
কী-রঙ পছন্দ করলে?
সাদা। পাড়ে রুপোলি কাজ।
রজত সাদা পছন্দ করবে?
তুমি শুনলে অবাক হবে, আমিও তাই হয়েছিলাম, যখন শুনলাম রজতের সাদাই পছন্দ।

চোখের সাদা ধূসর কনট্যাক্ট মণি ওর প্রতি অকম্পিত রেখে আমি হেসে বললাম, এই যা, রজতের কথা ওঠার তো কথা ছিল না।

ওর একটা বড়সড় প্রশ্বাস পড়ছে দেখে আমি অবাক। এমনও তো কথা ছিল না। তা, সব কথাই কি আর অক্ষরে অক্ষরে রাখা যায়, না মানুষ রাখতে পারে।
আমি আস্তে আস্তে হাতদুটো ধরে জানতে চাইলাম এই, তুমি কি জেলাস হয়ে পড়ছ?
উত্তরে ঘনশ্যাম কী বলল আমার শোনা হলো না। কেননা, এইসময় সদ্যখোলা নাহুমের মধ্যে কেক কিনছিল এক মৌন দম্পতি, লাল পশমে মোড়া ওদের ফুটফুটে বাচ্চাটা, টলোমলো পায়ে কাচের দরজাটা ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়াল। মা-বাবা এখনও জানে না কিছুই। একি, একি, সে যে এই দিকেই আসছে। এখনও বেশি দোকান বন্ধ আর প্যাসেজেও কেউ নেই। কেউ যদি তুলে নেয়? মেয়ে-বাচ্চা বলে কথা! আরব কানট্রিজে চালান দিতে পারে!
না, ওই যে নাহুম-এর থলথলে মোটা ইহুদি মালিক নিজেই উঠে যাচ্ছেন বিচ্ছটাকে ধরে আনতে।
আগাগো মাস্টার শটে এক সাইলেন্ট পিকচার যেন।

উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমি বসে পড়ি। অবশ্য বেনারসি কিনেই যে সিদ্ধান্ত নিলাম, তা না-ও হতে পারে। বেনারসি কেনা হলো আমার কৈফিয়ত, বরফের ওপর রক্তের ফোঁটার অনেকখানি জুড়ে বরং সেখানেই পড়ে আছে।

একদিন রজত আর একদিন ঘনশ্যাম; এমন-কি একই দিনে রজত সেরে তারপর ঘনশ্যাম—এ জিনিস করতে করতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। রজতের সঙ্গে ব্যাপারটা ছিল বরং অনেক স্বস্তির আর সহজ। সে তো ঘনশ্যামের অস্তিত্বের কথা জানেই না। স্বস্তিকর বলেই মিলেমিশেও যাচ্ছিলাম অনেক সহজে। ওর জন্য দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে, টের পাচ্ছিলাম, আহা, বাচ্চা ছেলে! আমার চেয়ে হিসেবমতো সে বছর দুই ছোট, জানাতে বোকা হাবাটা বললে কিনা, তাহলে ওদিকে দু’বছর পুষিয়ে দিও।

শুনে আমি যা বোঝার বুঝেও ওর মুখে শুনতে চাই, আর তাই ওর মতোই, বোকাহাবা মুখে তাকাই, আর যেই বলেছি, মানে? —অমনি খপ করে হাতটা চেপে ধরে। তাহলে দু’বছর পরে রিটায়ার করবে। আমি তখনও ন্যাকা সেজে যেই না বলেছি, চাকরি?— অর্থাৎ আমার—অমনি পিপিং রেস্তোঁরায় ঢাকা কেবিনের মধ্যে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিয়ে যা-যা করল—বন্ধ ঘর হলে সেদিনই শেষ দেখে ছাড়ত। সেদিনই তখন ঘনশ্যাম বসে আছে, আমারই জন্য সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফিহাউসে। ওখানে ওর বন্ধুবান্ধব আছে, সময় কেটে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বসে তো আছে আমারই জন্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি হলো পৌঁছতে।

এমনটা যাতে না-হয় সেই চেষ্টাই করি। কিন্তু রজতের সঙ্গে উঠতি সম্পর্ক আর সে যদি অফিসে হঠাৎ ফোন করে পীড়াপীড়ি করে যে আজই’—‘না’ বলতে পারি না। তাছাড়া তার ওপরেই বাকি জীবনের বাজি ধরেছি। কিন্তু সেদিন ঘনশ্যামকেও বলা ছিল আর তখন তা ক্যানসেল করারও উপায় নেই। ঘনশ্যামের কাছে পৌছলে সে কতটা বুঝতে পারছে—আদৌ পারছে কি না সেটা অবশ্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

আজকাল যত দেরিই হোক ঘনশ্যাম অপেক্ষা করে। কফিহাউস বন্ধ হয়ে গেলেও বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকে। আজকাল একটা পাঁচিল উঠছে দুজনের মাঝখানে। আগে সব বলতাম। আজকাল ও কখনও জানতে চায় না, এত দেরি হলাে কেন। আমিও তো বলি না। বিয়ের দিনের মতো এটাও যেন বলা বারণ, রজতের সঙ্গে অ্যাপো থাকলে সাজগোজ আমাকে একটু বেশিই করতে হয়। আজকাল তো ঠোঁটে রঙ লাগাই, অবশ্য সেটা শুধু রজত যেদিন।

ঘনশ্যামের দিন একদম দরকার করে না। ঘনশ্যাম পুরনো চাল, ভাতে এমনই বাড়ে। অথচ যেদিন পিপিং কাণ্ড, লেডিজ রুমে গিয়ে যতই ঠিকঠাক করে এসে থাকি, বেশ বুঝতে পারছিলাম অন্তত ঠোটটা বেশ লাল হয়ে ফুলে থাকারই কথা—এবং আছে—যা রজত সেদিন টানতে টানতে প্রায় তার কণ্ঠনালি অবধি টেনে নিয়ে গিয়েছিল, আর আমিও ছাড়ছিলাম যতটা পারি। আমার ঠোটে এখনও একটুও মাংস লাগেনি। এখনও সেই বেলুনের চামড়ার মতো পাতলা। সেই সাল বছরে যেমনটি ছিল।

কিন্তু, এভাবে আমি আর পেরে উঠছিলাম না যেন। আর এই আত্মগ্লানি আর দোটানা, যা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে দিনের পর দিন, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ঘনশ্যাম যে শুধু এটা বুঝেও বুঝতে চাইছে না, তা নয়—দোটানার মাঝখানে দুলতে তার বেশ ভালই লাগছে। তার দোটানা বলতে আমি আর ওর স্ত্রী সুপ্রভা। ওর স্ত্রী সুপ্রভা সম্বন্ধে আমি যা জানি—সে তো একটা খড়ের কাঠামো। রক্তমাংস নেই। বিছানা-যোগ্যতা যেটুকু ছিল, আমি আসার পর সেটুকুও সে হারিয়ে বেঁচেছে। মাঝে দু-একবার ঘনশ্যামের ট্রাউজারের পকেটে কনস্ট্রাসেপটিভ পেয়েও একটা কথা বলেনি। সে, কে, কী, কেন, কবে, কোথায়—বলবে যে, সে-মুরোদ কোথায়! করুণাই করি আমি তাকে। আমার বিছানাযোগ্যতা প্রমাণিত এবং পাঁচ বছর ধরে যতবার, ততবার ঘনশ্যাম মুখে না-বলেও আমাকে বুঝিয়ে গেছে, যদিও দুই সন্তানের বাবা নারী-শরীর বলতে যা, সে-অভিজ্ঞতা ওর জীবনে এই প্রথম। ওর বৌ তো শুনলাম, জামাকাপড়ই সব খোলে না। আর আমি? লজ্জা-শরম খুলে তবে খাটে উঠি। এদিকে থেকে আমি করুণাই করে এসেছি ওর স্ত্রীকে, বরাবর। হিজড়ে, নান ও অযৌন স্ত্রী আমার কাছে একই। কারণ তিনজনেই প্রকৃতির ইচ্ছার বিরোধিতা করছে। তিনজনেই প্রতিবন্ধী।

অথচ, স্ত্রী সুপ্রভাকে একটু তাচ্ছিল্য করলেই কত শক্ত হয়ে যায় তার চেয়াল। মুখচ্ছবিই যায় বদলে। ওর স্ত্রী ওর কাছ থেকে যেটা পেয়েছে সেটা আমি কিছুতেই পাচ্ছি না। আমি পদে পদে টের পেয়েছি। ও যখন আমার বিছানা-যোগ্যতার প্রশংসায় মুখর (সে কথায় বা কাজে যাই হোক)—আমার মনে হতে শুরু করল, এ যেন এক রয়াল বেঙ্গলের মধ্যাহ্নভোজন—আমার দুই উরু-নিতম্ব, রবার গাছের কাণ্ডের মতো পিচ্ছিল উরুদ্বয়, বেদীর মতো তলপেট, তথা পাকাপোনার পেটির মতো যোনি (অলংকরণ ঘনশ্যামের)—এ সবই ওর স্ত্রীর মধ্যে কেন পায়নি—কেন পায় না—এটাই যেন ওর আসল আক্ষেপ। এইসব গেঁড়িগুগলি ও-ঘাটে পেলে আর এ-ঘাটে ঘাই দিত না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো, এটাই যেন আমাদের যৌন সম্পর্কের মর্মবাণী—ওর দিক থেকে। আবার এ-ও ঠিক যে, ওর স্ত্রী আর আমি যেন দুদিক থেকে আসা সমুদ্রের দুটি ঢেউ—আর ও চাইছিল এ-ভাবেই দুই ঢেউ-এর দোলায় যতদিন সম্ভব দুলে যেতে। ওর এই আত্মপ্রসাদ, এই নার্সিসাস-সুখে বাধা দিতেই আমি খেলাচ্ছলে মঞ্চে ডেকে আনি রজতকে।

অবশেষে যেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে মনে হলো, আজ আবার কার সঙ্গে রজত না ঘনশ্যাম, ৬টার সময় আমি আজ কোথায় যাব—পিপিং না কফি হাউস—কিছুতেই মনে করতে পারলাম না যে কে,—সেদিন কান্না পেল। সেদিন ঘেন্না হলাে। মনে হলো আমি পাগল হয়ে যাব। বা, গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আমার সামনে কোনও পথ নেই।

ঠিক করলাম পিপিং-এই যাই। যদি দেখি রজত বসে আছে, তাহলে ওকে ঘনশ্যামের অস্তিত্বের কথা আজ বলব। লতাতন্তুময় জালের কেন্দ্রে যে বসে আছে, যাকে মারতে গেলেই দেখছি, তার বদলে আমি বসে আছি কেন্দ্রে। আমি পারছি না। রজত এগিয়ে আসুক। ছিড়ে ফেলুক জাল। বাঁচাক আমাকে। আমাকে অর্জন করুক। নাটকে, সিনেমায় এর চেয়ে অনেক কম কারণে খুনোখুনি হয়। নাটক, সিনেমা এসব তো মানুষের কল্পনা, আর্ট। আসলে ব্যাপারটা তো জন্তু-জানোয়ার লেভেলের। বলশালী কুকুর এসে যেভাবে অনুসরণকারী নেড়িদের হটায় ও কাঙিক্ষতকে অধিগত করে, সে সেভাবে আমার কাছে আসুক। ঘনশ্যামকে সে পাড়া-ছাড়া করুক।

হায়রে, সেদিন রজতের দিন নয়। একঘন্টা কেবিনে বসে থেকে, একপ্লেট চপ সুয়ে খেয়ে ভরা পেটে কফি হাউসে গিয়ে দেখি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যাম সিগারেট খাচ্ছে। শীতের রাত। সে ছাড়া গলিতে কেউ নেই।

ঘনশ্যাম,
যদিও তুমি জানাতে বারণ করেছিলে, ১৩ নভেম্বর রজতের সঙ্গে আমার বিয়ে। সঙ্গে নিমন্ত্রণপত্র। এখনও দিন-পনের দেরি। নিমন্ত্রণপত্রে রজতের ঠিকানা রয়েছে। ওই ঠিকানায় তুমি, পত্রপাঠ, আমার ২/১ টা নুড ছবি পাঠিয়ে দাও, তুমি একদিন শখ করে তুলেছিল। তারপর যা হবার তা হবে। আমি কাল সারারাত জেগে বসেছিলাম। যতদূর ভাবা সম্ভব ভেবে দেখলাম। ভেবে দেখলাম, লোকাল অ্যানাসথেসিয়া করে নিজের হাতে নাকের পাটা ফুটো করে তোমার জুয়েলার বন্ধু বি. সরকারের দোকানে নিয়ে গিয়ে যে-হীরের নাকছাবি তুমি পরিয়ে দিয়েছ, তা খুলে ফেলার সাধ্য আমার নেই। আমার সামনে এখন দুটো রাস্তা। এক: সারাজীবন রজতের কাছে তোমার কথা লুকনো। অথবা… রজতের কাছে যাবজ্জীবন জেল খাটার তুলনায়, তোমার দেওয়া রজ্জ্ব গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করাটাই আমার কিছুটা সম্রান্ত বিকল্প বলে মনে হলো। তোমার দাসী, বাঁদি, অথবা রক্ষিতা কণিকা।