
সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’
পর্ব ৫
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০২১
নরকের নাম করে আমাকে যে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটা আলাদা কিছু নয়। সুবিমল বাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, গতানুগতিক যা কিছু, তা সবই তো প্রেডিক্টেবল। আর একজন মানুষকে জোর করে এই বৃত্তের মধ্যে ঠেলে দিলে তার নরকদর্শনের কম কিছু হয় কি?
জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীরা এই যে মাদল বাজাচ্ছে, তাতে কি কিছুই নতুন নেই? জিজ্ঞেস করলাম।
না। মাদলটা ওদের বিদ্রোহ। কবে থেকে এটা এই সুরেই বেজে চলেছে জানো? যুদ্ধের মারপ্যাঁচ আগে থেকেই নির্ধারিত। কে জিতবে, কে হারবে আমরা জানি। এর চেয়ে বড় নরক কি হতে পারে? তুমি স্রেফ দেখে যাও...
আমি চুপ করে হেঁটে যেতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম, আমাদের পাশে গাছের মতো কিছু মানুষ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ বন্ধ। এদের মধ্যে প্রায় সকলকেই আমি চিনি। এরা সেইসব মানুষ যাদের সঙ্গে এক দুবার খুব ভালো কথোপকথন হয়েছিল আমার আর তারপর আমি অপেক্ষায় থেকেছি আবার কবে কথা হবে। কিন্তু আর কোনোদিন কথা এগোয়নি। পাথরের মতো নীল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
সুবিমল বাবু বললেন, এটা আপসোস পথ। এদের যত দেখবে তত নস্টালজিয়া পেয়ে বসবে তোমায় আর তুমি পুড়বে।
আমি একটা পাথরের মতো চোখ বন্ধ করা মেয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললাম, অদ্রিজা... তোমাকে আমি চিনতাম। শান্তিনিকেতনের একটা চায়ের দোকানে আমাদের দেখা হয়েছিল। খুব সুন্দর একটা কথার সন্ধ্যা কেটেছিল। তুমি আমার নম্বর নিয়েছিলে, আর যোগযোগ করোনি কখনও। কেন, বলো তো?
আমাকে অবাক করে অদ্রিজা সেই চোখ বন্ধ করেই শুধু ঠোঁট নেড়ে বলল, আমার বিয়ে, সামনেই। এসো কিন্তু।
আমি সরে এলাম ওর থেকে। সুবিমল মিশ্র আবার আমার হাত ধরে বললেন, সামনে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ওটায় উঠে পড়ো। ওটা তোমায় পাহাড়ে নিয়ে যাবে।
আমি সামনে দেখলাম, একটা ছোট দু’কামরার ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। আমি গিয়ে সেটায় চড়ে বসলাম। আর কেউ নেই আমি বাদে। ট্রেনটা হুইসিল দিয়ে ছেড়ে দিল।
এ পাহাড় দুঃখ জমে জমে তৈরি হয়েছে। চল, আমরা মাঝপথে ন্যাংটা চরে নেমে যাবো। পারবি না?
আমি পেছন ফিরে দেখি, রতনদা বসে আছেন শেষের সিটে। আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। রতনদার হাতে একটা বই ধরা, জেমস জয়েসের ফিনিগানস ওয়েক। চলবে