সজীব দে’র গল্প ‘সুবর্ণা যখন কবিতা হয়ে ওঠে মাঝরাতে’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
আজকের রাতটি সুবর্ণার। কেননা... ও বিকেলে যে কবিতার আশ্রয়ে কাটিয়েছে, আমি বলবো এমন আশ্রয় একদা আসে। ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে যে টানেলে কল্পনার বিস্তারে ডুবেছিল, তা হয়তো সে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পেতে পারতো।
আমরা ঘরে তিনজন। সুবর্ণা বাদে আছে আজমল। ও বাঁশি বাজায়। সুবর্ণা সিবাশ রিগ্যালের ছিপি খোলে।
আজমল বলে, আমি আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে রে। এই বলে সে বাঁশিতে সুর ধরে। শচিন কর্তার। ধোঁয়া হয়ে যায় সুরে আমাদের ঘর।
সুবর্ণার কথায় আসি। ও কবিতা লেখে। কারও কাছে হয়তো ভালো লাগবে না। কারও আবার রক্তের শিরায় ভায়োলিন বাজাবে। বিয়ে করেনি। একা থাকে। বিয়ে হয়তো করবে। আপাতত আমরা এখানে থাকি।
সুবর্ণা দেখতে সুন্দরী। আমি আর আজমলসহ অনেক বন্ধু ওর প্রেমে পড়ে আছি। ও সেটা জানে। এতে আমাদের সম্পর্কের কখনও ভাটা পড়েনি।
হ্যাঁ যে কথা বলতে চাচ্ছি, ও আজ আমাদের একটা কবিতা শুনাবে বলে এত আয়োজন।
আজমল বলে, মালটা ধরেছে বেশ। হুজুরে শাহেন শাহ আপনার দরবারে আজ উপস্থিত থেকে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
সুবর্ণা হাসে। আমাদের কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে যায়। কিন্তু সুবর্ণা কোনো কবিতা আমাদের শোনায় না। আমাদের নেশা চরম তুঙ্গে।
আমি বলে বসি, হিসেব করে করে দিন গুজরান করেছি
হিসেব মিলেনি কোনোদিন
আজ ফয়সালা হবে
হিসেবের বাড়ি হবে বেহুলার বাসর!
সুবর্ণা মুচকি হেসে উঠে যায়। আজমল বলে, বাহ্ দোস্ত বাহ্!
আমরা দুজন আরও এক পেগ করে মেরে দেই। এরপরও অনেক সময় কেটে যায়। সুবর্ণার দেখা নেই। তার একটু পর সে আসে। দেখে চিনতে পারি না। কেমন জানি দুজন করে দেখছি। আবার একজন। সুবর্ণা নাইটি পরে আমাদের সামনে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবছা আবছা বুঝতে পারছি। ওর ভেতর কোনো অন্তর্বাস নেই। সুঢৌল হয়ে ফুটে আসে স্তনযুগল। আমাদের চোখ আর চোখ নেই। হয়ে উঠেছে কোনো পেইন্টারের চোখ। আমি আজমলকে জিগেশ করি, আজ রাতে কি আমি গঁগ্যা?
আজমলও জিগেশ করে, আর আমি?
বলতে পারবো না।
আজমলের মন খারাপ হয়।
এবার সুবর্ণা নড়েচড়ে ওঠে। সুবর্ণা তার গাউনটা খুলে ফেলে আমাদের চোখের সামনে। এটাই কি সুবর্ণার কবিতা?
সুবর্ণা বলে, আজ আমরা তিনজন একসাথে নগ্ন হয়ে শোবো। কেউ কারো ওপর জোর জবরদস্তি করবে না। কারো যদি শরীর সাড়া দেয়, আমি না করবো না। আবার আমার যদি শরীর সাড়া দেয় কারো ওপর সেও, না করতে পারবে না।
রাত অনেক হয়ে গেছে। পালানোর উপায় নেই। আমরা মেনে নেই। এক এক করে আমি আর আজমল নগ্ন হই। সুবর্ণা দেয়াল থেকে আমার কাছে এসে বসে। ও আমাদের মাঝে বসে আছে। আজমল বাঁশিতে সুর তোলে। কোনো ভিনদেশি সুর। শুনে মনে হলো, লাতিন কোনো গানের সুর।
জানালা দিয়ে বাঁকা হয়ে ঘরে চাঁদের আলো পড়েছে। ওই আলো সুবর্ণার দুই স্তনের মাঝদিয়ে কেটে বের হয়ে গেছে। আমার মনে হলো, ওর স্তন বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। আমি রক্ত আটকাতে চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। সুবর্ণা হাসতে থাকে। ঘর কেঁপে ওঠে।
আমার অদ্ভুত কাণ্ড দেখে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। আজমল এবার নিরোর বাঁশি বাজায়। ভোর হতে আরও ঘণ্টা দুই বাকি। নিরো বাঁশি থামায়। ও কী করবে বুঝতে পারে না। কিন্তু সুবর্ণা বোঝে। ও তখন আজমলকেও তার একপাশে নিয়ে শুয়ে পড়ে।
আমরা তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি ভোর অব্দি। সুবর্ণার কানে কাকের ডাক আসতে আমাদের মাঝখান থেকে ওঠে পড়ে। আমরা তখন দুজন শুয়ে থাকি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি আমরা দুজন, বুঝতে পারি না। সকালে উঠে দেখি, সুবর্ণা ঘরে নেই। ওকে ফোন করি। সুইচ অফ।
অনেক দিন পরে আবার একবার ফোন করি দেখি, ফোন খোলা। অপর পাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে। আমি চিনতে পারি না। আমি বলি, আপনি কি সুর্বণা বলছেন?
হুম।
আমি রাতুল। চিনতে পেরেছিস?
না। রাতুল নামে আমার পরিচিত কেউ নেই। সরি, আপনি হয়তো রং নম্বরে ফোন করেছেন। রাখি।
সে ফোন রেখে দেয়। এরপর আর চেষ্টা করিনি। এভাবে আমাদের পনের বছর কেটে যায়। আমি বা আজমল কেউ বিয়ে করিনি। আমাদের বয়স এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আমরা একটা কবিতা শুনতে পেয়েছি, যে কবিতা লেখা যায় না।