মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
সংখ্যালঘু প্রশ্নে জিন্নাহর রাজনীতির বিভ্রান্তি
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯
জিন্নাহ কংগ্রেস ছাড়লেন, রাজনীতি ছাড়লেন না। মুসলিম লীগের সদস্য তো তিনি ছিলেনই, কংগ্রেসের পুরানো নেতাদের নিয়ে নতুন করে দল গঠন করতে চাইলেন ন্যাশনালিস্ট পার্টি। কিন্তু তেমন সাড়া পেলেন না। তিনি কংগ্রেস ছাড়ার পর সে দলটা গান্ধীর একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে পরিণত হলো। গান্ধীর চেলা হিসেবে তখন দলের তরুণ নেতা জওহরলাল, আজাদ, প্যাটেল, সুভাষ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ। খিলাফত আর অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে গান্ধী তখন জনপ্রিয়তার চরম শিখরে, জিন্নাহ পিছনে পড়ে আছেন। খিলাফত আন্দোলনে বেশ ক’জন মুসলমান নেতা ছিলেন, যারা খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা আর স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলে বসলেন।
খিলাফত আন্দোলনকে ব্রিটিশ শাসকরা প্রথম প্রথম সামান্য বাধা দেয়নি। কিন্তু স্বায়ত্বশাসনের দাবি, ব্রিটিশকে তাড়ানোর দাবি সরকারের পছন্দ হলো না। স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলে এবং স্বাধীনতার শ্লোগান তুললে, গান্ধীর সঙ্গে খিলাফত নেতাদের দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। খিলাফত আর অসহযোগ আন্দোলন গান্ধীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। কারণ কৃষকরা জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ল। সরকার এবার দমন পীড়ন আরম্ভ করলো। পুলিশের গুলিতে কৃষক মারা পড়লে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে থানায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলে। পুলিশের গুলিতে কৃষক মারা গেলে গান্ধীর কিছু যায় আসে না। কিন্তু ক্ষুব্ধ কৃষকরা কেন থানায় আগুন দিয়ে হিংসার প্রকাশ ঘটালো, সে অজুহাতে গান্ধী একক সিদ্ধান্তে আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন।
সুভাষসহ কংগ্রেসের নেতারা ক্ষুব্ধ হলেন এ ঘটনায়। কিন্তু গান্ধী আন্দোলন থামালেন এ বিবেচনায় যে, তা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলে। ক্রমাগত সেটা সরকার বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হচ্ছিলে। জিন্নাহ খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন না করলেও জনগণের সরকার বিরোধী এ আন্দোলনকে পরে প্রশংসা করেছেন। গান্ধী হঠাৎ আন্দোলন বন্ধ করে দেয়ায়, খিলাফতের মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হলো, নানা ঘটনায় তারপর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা লেগে গেল। জিন্নাহ গান্ধীর খিলাফত আর অসহযোগ সম্পর্কে প্রথম থেকে এ আশঙ্কা করতেন আর সে কথা প্রকাশ্যে বলেও ছিলেন। বাস্তবে তাই ঘটলো। জিন্নাহ কিন্তু এ সময়ে গান্ধী বা কারো দোষ না ধরে পুনরায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের কথা বলতে থাকলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের সাহসের প্রশংসা করলেন। তিনি জনগণের ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভকে ইতিবাচকভাবে দেখলেন। কিন্তু গান্ধী বললেন, জনগণ আন্দোলন করার জন্য উপযুক্ত হয়নি, তাদের মানসিকতা আন্দোলন করার জন্য নয়। কারণ তারা অহিংস থাকতে পারেনি। জনগণকে তিনি অহিংস হবার নিদান দিতে থাকলেন।
গান্ধী এ সময়ে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে থাকেন কংগ্রেসে। মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে এ নিয়ে কঠিন বিরোধ হয়। মতিলাল, চিত্তরঞ্জন প্রমুখ গঠন করেন স্বরাজ্য দল। গান্ধী বুঝতে পারেন এদের সঙ্গে বিরোধ করার ফল ভালো হবে না, তাই সাময়িক একটা মিটমাট করে নেন। চিত্তরঞ্জন পঁচিশ সালে মারা গেলে মতিলাল আবার গান্ধীর সঙ্গে আঁতাত করেন। নিজের ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। গান্ধী এ সময় অসাম্প্রদায়িকতার আড়ালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে থাকেন কংগ্রেসের ভিতরে এবং বাইরে। গান্ধী এ সময়ে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা, গোরক্ষা, হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলতে থাকেন, সঙ্গে চরকাকে মনে করেন ভারতের উন্নতির চাবিকাঠি। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর চরকা নিয়ে বাড়াবাড়িকে লিখিতভাবে সমালোচনা করলেন। কংগ্রেসের অর্থদাতা তখন টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কারা। হিন্দু মহসভার বড় নেতারা সকলে তখন কংগ্রেসের সদস্য। হিন্দু মহাসভা এ সময়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলতে থাকেন। বাংলা আর পাঞ্জাবে তখন মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। লালা লাজপত এ সময়ে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি লেখা লেখেন হিন্দুত্বের পক্ষে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাংলা আর পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করার কথা বলেন। মানে হিন্দু পাঞ্জাব আর মুসলমান পাঞ্জাব আর হিন্দু বাংলা আর মুসলমান বাংলার কথা বলেন। তিনি মনে করেন, বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ না করা হলে, হিন্দুরা ভালো থাকবে না। কংগ্রেস বা গান্ধী এর বিরুদ্ধে কিছু বললেন না।
জিন্নাহ এসব দেখেও ইতিবাচক রাজনীতির কথা বলতে থাকেন। তখন তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি। সেজন্য তিনি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেন। জিন্নাহ মনে করতেন, হিন্দু মুসলমান এক না হলে ইংরেজকে হটানো কঠিন। কিন্তু কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা বা গান্ধী জিন্নার এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেননি। মুসলমান তখন এক চতুর্থংশ। কংগ্রেস, গান্ধী, জওহরলাল সকলে মনে করলো, জিন্নাহকে পাত্তা দেয়ার কী আছে। পঁচাত্তর শতাংশ হিন্দুরাই ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট, পঁচিশ শতাংশ মুসলিমদের পাত্তা দেয়ার বা তাদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কিছু নেই। জিন্নাহ কিন্তু বললেন, জাতীয় সংহতির জন্য একটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। বিশ্বের সকল দেশেই সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে আলাদাভাবে দেখা হয়। সবদেশেই পশ্চাদপদ সংখ্যালঘুদের অগ্রগতির জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু গান্ধী, জওহরলাল, প্যাটেল, আজাদ প্রমুখ বা কংগ্রেস সে কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে জিন্নাহকে সাম্প্রদায়িক বলতে থাকলেন। কারণ তিনি পশ্চাদপদ মুসলমানদের পক্ষে অাসন সংরক্ষণ করার কথা বলছেন, সেজন্য তিনি তাদের চোখে সাম্প্রদায়িক। জিন্নাহর মতো ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ব্যক্তির উপর এভাবে মিথ্যা সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু যখন দলিতরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলেন, তখন তাদের সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি। শিখরা বা আম্বেদকার, ভেঙ্কটাপ্পা রামস্বামী যখন তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংরক্ষিত আসন দাবি করেন, তখন তাদের সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি। জিন্নাহর উপর সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে দেয়া হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই। দলিত নেতা কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী রামস্বামী কংগ্রেস করতেন, কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে মিল না হলে তিনি বের হয়ে আসেন। তিনি কংগ্রেসকে বলতেন হিন্দু ব্রাহ্মণদের দল। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি বলতেন, আমি আমার সম্প্রদায়ের স্বার্থে রাজনীতি করি, কংগ্রেসের মতো হিন্দু ব্রাহ্মণদের স্বার্থে রাজনীতি করি না। হ্যা, আমি আমার সম্প্রদায়ের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য, আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করি। তিনি স্পষ্ট করেই কথাটা বলতেন। কিন্তু তবুও তাঁকে কিন্তু সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হয়নি। রামস্বামী কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন বেদ আর মনুর বিধানের বিরুদ্ধে সরব। কোনো দেবদেবী মানতেন না। সনাতন ধর্মের লোকদের বলতেন ভণ্ড, হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে আর তাদের দেবদেবী, সকল অনুষ্ঠান, নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন রামস্বামী। নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন খুব আধুনিক। কিন্তু যখন তাঁরা নিজের সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ চাইলেন, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন তখন তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি। তাহলে জিন্নাহ বা মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক বলা হলো কেন? উদ্দেশ্যটা কি ছিলে?
জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেননি। কিন্তু তাকে দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক বলা হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্য জিন্নাহকে দায়ী করা হয়। অথচ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা প্রথম বলেছে হিন্দু মহাসভা। বলেছে লালা লাজপত রায়। জিন্নাহ যখন হিন্দু মুসলমান ঐক্য চাইছেন, হিন্দু মহাসভা বলছে ভারতে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। বলা হলো, ভারতে থাকতে হলে মুসলমানদের অতিথি হিসেবে থাকতে হবে। পরে আবার বলা হলো, মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে হিন্দু ধর্মে পুনরায় ফিরে আসতে হবে। হিন্দু মহাসভার এসব ব্যক্তিরা কিন্তু কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন। কংগ্রেস কিন্তু এসব বক্তব্যের বিরোধিতা করেনি। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাহলে কারা করেছে? জিন্নাহ না গান্ধী? মুসলিম লীগ নাকি কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা? ধর্মীয় বিদ্বেষ কারা ছড়িয়েছে? মুসলিম লীগ নাকি কংগ্রেস? রামরাজত্ব, গোরক্ষা, মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক; কারা বলেছে এসব কথা। বাংলা পাঞ্জাব কারা ভাগ করতে চেয়েছে প্রথম? বা পরে?
জিন্নাহ এসব কিছুর পরেও ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করতে চেয়েছেন কংগ্রেসের সঙ্গে, হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির জন্য। কংগ্রেসের অনেক উদার নেতারা জিন্নাহকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। কিন্তু গান্ধী, জওহরলাল, আজাদ প্রমুখরা তা সফল হতে দেননি। মনে করেছেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য পঁচিশ শতাংশ মুসলমানদের পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। তাঁদের দৃষ্টিতে জিন্নাহ আর মুসলিম লীগ, এরা কি কখনো আলোচনার ব্যাপার! পঁচাত্তর শতাংশ হিন্দুদের দয়া নিয়ে যাদের চলতে হবে, ভারতে থাকতে হলে হিন্দুদের দয়ায় যাদের বাঁচতে হবে তাদের সঙ্গে কীসের আলোচনা, কীসের আপস! কিন্তু ভাবনাটা ভুল ছিল তাদের। ইংরেজ শাসকরা আর যাই হোক, পঁচিশ শতাংশ জনগণের ক্ষমতাটা বুঝতো। এটাও জানতো দলিতরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে। আর ছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অধীনে স্বায়ত্ব শাসিত পাঁচশোর অধিক রাজ্য, ভারত ভূখণ্ডের চল্লিশ শতাংশ তাদের দখলে। স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে জিন্নাহর সম্পর্ক ভালো ছিলে, জিন্নাহকে সম্মান করতো তারা। ফলে বিপদে পড়ে জিন্নাহকে পাত্তা দিয়েছে কংগ্রেস। গান্ধী জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে। কংগ্রেস পরে টের পেয়েছে, পঁচাত্তর শতাংশ হিন্দুরা সকলে তার সঙ্গে নেই। কৃষক প্রশিকরা তার সঙ্গে নেই, দলিতরা তার সঙ্গে নেই। সাম্যবাদীরাও পরে তার সঙ্গে ছিলো না; শ্রমিক কৃষকরা না থাকলে তারা কী করে থাকে?
জিন্নাহ বহুদিন পর্যন্ত ভাবতেন, ভারতের সকল হিন্দু মুসলমানরা মিলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করবে। কিন্তু চল্লিশের দশকে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার অচরণে বিরক্ত হয়ে ভিন্ন পথ ধরলেন। তিনি সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নতুন পথে পা বাড়ালেন। ভারতের বিভক্তি তিনি চাইলেন না। কিন্তু বুঝলেন, ভারতের শিক্ষিত হিন্দুরা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করবে না, মুসলমানদের সম্মান দেখাবে না। তিনি ঠিক ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি তার রাজনীতির মস্ত বড় ভুলটা করলেন এখানে। তিনি মনে করলেন, হিন্দুরা সংখ্যাগুরু আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু। জিন্নাহ মারাত্মক ভুল করলেন এরকম হিসেব করতে গিয়ে। হয়তো জিন্নাহ যা বলতে চেয়েছেন, আপাতভাবে তা সত্য হলেও, আসলে সেটা সঠিক ছিলে না। জিন্নাহ বহু কিছুই, সঠিক বলেছেন। গণতান্ত্রিক মানসিকতার লোক ছিলেন। ভারত ভাগ করতে চাননি; বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ করার বিরুদ্ধে ছিলেন, সকল প্রদেশের স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ছিলেন। সবই ঠিক ছিলে, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর হিসাবটা তিনি ঠিক মতো মিলাতে পারেননি। কেন পারেননি, চিন্তার কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য। তিনি খুব সঠিক রাজনীতি করেছেন, সীমাবদ্ধ একটা গণ্ডির ভিতরে। ফলে ভারতের রাজনীতিতে ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবচেয়ে উদার, সবচেয়ে গণতান্ত্রিক, সবচেয়ে দেশপ্রেমিক হয়েও মারাত্মক ভুল করে গেলেন। যা তিনি দিতে পারতেন ভারতকে, তা শেষ পর্যন্ত দিতে পারলেন না। ভারতের মানুষের মুক্তি তিনি ঘটাতে পারলেন না।
জিন্নাহ জনগণের আন্দোলনে ছিলেন না। জিন্নাহ অবশ্যই হোমরুল লীগ যখন করেন, গণ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। পরে কখনো সেরকম আন্দোলনে জড়াননি। গান্ধী বা কংগ্রেস যে কাজটি করেছেন, আন্দোলনের নামে জনগণকে রাস্তায় নামিয়েছেন, পুলিশের গুলির মুখে পাঠিয়েছেন। বহু মানুষ প্রাণ দেয়ার পর সরকারের সঙ্গে আপস করে নিজেদের সুবিধামতো আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। পরে দেখা গেছে এসব আন্দোলনের ফলাফল জনগণের জন্য শূন্য। কিন্তু জনগণ অনেক রক্ত দিয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কারা ভোগ করেছে। জনগণকে ব্যবহার করা হয়েছে ভদ্রলোকদের আন্দোলনে। কিন্তু সুবিধা নিয়েছে কংগ্রেসের নেতারা। জিন্নাহ কখনো তার রাজনীতির স্বার্থে জনগণকে পুলিশের বন্দুকের সামনে পাঠাননি। জিন্নাহর স্মরণ ছিল, জালিয়ানওয়ালাবাগে কী ঘটেছিল। জনগণ প্রাণ দেবার পর গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করেন, সরকারের সঙ্গে আপস করেন। পরের প্রতিটা আন্দোলনে কংগ্রেস তাই করেছে। জিন্নাহ কংগ্রেসে থাকার শেষ দিনগুলিতে গান্ধী এবং অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলেছিলেন, জনগণকে এখনি রাস্তায় নামাবার সময় হয়েছে কি না আমাদের ভাবতে হবে। সরকারের প্রশাসনের বিরাট শক্তির সঙ্গে তারা দীর্ঘদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারবে কি না সেটা আন্দোলনে নামার আগে ভেবে দেখা দরকার। জিন্নাহ বলতে চেয়েছেন, আন্দোলন যেন হটকারিতায় পরিণত না হয়।
হটকারিতায় সরকারের লাভ হবে। তিনি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার আগে জনতাকে বলেছিলেন, যদি আমরা আন্দোলন শুরু করি তাহলে থামা যাবে না। যদি আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে খাড়া থাকতে পারি তাহলেই বিজয় আসবে। না হলে হেরে যাবে। সকলকে কুচক্ওয়াজ শুরু করার আগে ভেবে দেখতে বলেছিলেন। তখন উন্মত্ত জনতা বলেছিলেন, আমরা বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত খাড়া থাকবো। কিন্তু তা যে হয়নি ইতিহাস তার সাক্ষী, গান্ধী আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলেন। জওহরলাল তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সম্পূর্ণ বিজয় লাভের জন্য আসলে কৃষকদের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলে না। জিন্নাহ যা আন্দোলনের আগে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, জওহরলাল বহু অভিজ্ঞতার পর সত্যটা স্বীকার করলেন। ভারত মূল্যায়ন করতে পারলো না, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম করার জন্য জিন্নাজর মতো কতো বড় মাপের একজন নেতা তারা পেয়েছিলেন।
জিন্নাহ যুক্তিসঙ্গতভাবে গণসংগ্রামে জড়াননি। ভদ্রলোকদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে তিনি সাধারণ মানুষের রক্ত নিয়ে খেলা করতে চাননি। কিন্তু জিন্নাহ যদি ভদ্রলোকদের জায়গাটা ছেড়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পাল্টাবার লড়াইয়ে অংশ নিতেন, নতুন সব অভিজ্ঞতা লাভ করতেন। জিন্নাহ রাজনীতির নোংরামি দেখে ত্রিশের দশকের শুরুতে রাজনীতি ছেড়ে চলে যান লণ্ডনে। মুসলিম লীগ তাকে আবার ডেকে এনে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেললেন। যদি সাম্যবাদীরা এ সময়ে জিন্নাহকে তাদের সঙ্গে জড়াতে পারতেন, জিন্নাহ নতুন চেতনা লাভ করতেন। কিন্তু সাম্যবাদীরা তখন পর্যন্ত ছিলেন রক্ষণশীল, কংগ্রেসকে নিয়ে তাঁরা বিপ্লব করার কথা ভাবতেন। ফলে জিন্নাহর প্রতি আগ্রহ দেখাবার কারণ তাদের ছিল না। জিন্নাহর দৃষ্টি তাই বৃহত্তর মানুষের রাজনীতির উপর পড়েনি। তিনি তাই মনে করেছেন, কংগ্রেস বা হিন্দুরা সংখ্যাগুরু। তিনি যদি খুব গভীরভাবে চোখ মেলে দেখতেন, তাহলে দেখতে পেতেন কংগ্রেসের হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো না। বরং কংগ্রেসের সুবিধাভোগী শিক্ষিত হিন্দুরা ছিলেন সংখ্যালঘু। জিন্নাহ যদি তখনকার সঠিক রাজনীতিটা ধরতে পারতেন, তাহলে তিনি ভিন্ন এক রাজনীতির স্রষ্টা হতেন। তিনি যদি পশ্চাদপদ সংখ্যালঘু মুসলমানদের, যদি পশ্চাদপদ হিন্দু কৃষকদের, ভারতের সকল শ্রমিকদের, আর দলিতদের নিয়ে কংগ্রেসের বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতেন; ভারতের শোষিত হিন্দু মুসলমানরা তাহলে মিলিতভাবে গান্ধীর বর্ণবাদী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হতো। জিন্নাহর সঙ্গে যেসকল মুসলমান জমিদারদের মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ছিলো, তারাও তখন কেটে পড়তেন। জিন্নাহ নেতৃত্ব দিতেন ভারতের সকল পশ্চাতপদ সংখ্যালঘুদের মিলিত শক্তিকে; সকলে মিলে তারাই তখন হতো বিরাট সংখ্যগুরু। শোষিত হিন্দুরা লড়তো শোষক হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বৃহৎ মুসলমানরা লড়তো কতিপয় মুসলমানের বিরুদ্ধে। ভারতের রাজনীতিতে সে লড়াইটা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে হতো না, হতো বর্ণবাদী হিন্দুদের সঙ্গে সাধারণ হিন্দুদের; আশরাফ মুসলমানদের সঙ্গে আতরাফ মুসলমানদের।