শ্রেয়া চক্রবর্তীর তিনটি খুদে গল্প

প্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০

অপার

নিখিল বাবুর আট বছরের ছেলে রণ দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত। দু`মাস হলো ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলেটা জানলা দিয়ে শুধু আকাশ দ্যাখে।

নিখিল বাবুর স্ত্রী সুশীলা খুবই সংস্কারী। ঈশ্বরে তার বিশ্বাস ও ভক্তি অগাধ। বিয়ের পর নিখিল তাকে বলেছিল, আমার ওসবে বিশ্বাস নেই। তবে তুমি চাইলে করতে পারো।

সুশীলা খুব মন দিয়ে পুজো করে। এমনকি ছেলের অসুখ ধরা পড়ার পরেও তার ভক্তি বা বিশ্বাস কিছুমাত্র কমেনি। বরং থানে থানে সে মানত রেখেছে। কোথাও কোনো সাধু বা পুণ্যাত্মা এসেছে শুনলেই ছুটে গিয়ে কেঁদে পড়েছে তার পায়ের ওপর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

সুশীলা অনেক অনুরোধ করেছে নিখিলকে, একটিবার হলেও আমার সাথে বসো। ফুলটুকু দাও। যদি ছেলেটার ভালো হয়। কিন্তু নিখিল মানেনি। তার স্পষ্ট কথা, আমার বিশ্বাস নেই। ছেলে বাঁচার হলে ডাক্তার তাকে বাঁচাবে।

বাঁচার যে আশা প্রায় নেই ডাক্তার তা বলে দিয়েছে। একমাত্র সন্তানকে হারানোর আশঙ্কায় ভেঙে পড়েছে সুশীলা। কিন্তু পুজোয় ছেদ পড়েনি। নিখিল শক্ত আছে বাইরে থেকে, যেন প্রস্তুত হচ্ছে সেই চরম মুহূর্তের জন্য।

সেদিন রাতে খুব জ্বর এলো রণর। জ্বরের ঘোরে একসময় নিথর হয়ে পড়লো তার দেহটা। সুশীলা অনেক করে ডাকলো, বাবু... বাবু... কিন্তু বাবু কোনো সাড়া দিলো না। ডাক্তার এসে বললেন, রণ আর নেই!

যে সুশীলা রাতের পর রাত কাঁদতো সে মুহূর্তে কেমন পাথর হয়ে গেল। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল বের হলো না। ঠাঁয় বসে রইলো সন্তানের নিষ্প্রাণ দেহটার সামনে। তারপর হঠাৎই উঠে গেল। দুহাতে তুলে আছাড় মেরে ভাঙলো তার আরাধ্য দেবতার মূর্তি। তছনছ করে দিলো পূজার সব উপচার।

আর নিখিল হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো, হায় ভগবান! এ তুমি কী করলে! তার চোখের জল আর কোনো বাধা মানলো না। মেঝেতে শুয়ে সে কার চরণে মাথা কুটতে লাগলো, কে জানে!

ট্রেন কিনতে চাই

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছি। হাওড়া স্টেশন ভিড়ে গিজগিজ। ব্যান্ডেল লোকালের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়েছে জাস্ট। স্কুল কলেজ অফিস মিল বাজার-হাট ফিরতি ব্যাগ বোচকা কাঁধে যে যেখানে ছিল মহিলার দল পিলপিল করে এগুতে লাগলো যেখানে ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্ট এসে দাঁড়ায়, সেদিকটায়। আমিও তাদের দলে।

ভিড়ের ভেতর এক মহিলার চাপা কণ্ঠস্বর কানে এলো, বউটাকে হেব্বি মেরেছে ওর স্বামী। আহা নিরীহ মেয়েটা... পিছনে ঘুরেই দেখি, বক্তা পাশের মহিলাকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, একটু দূরে দাঁড়ানো আরেক মহিলাকে। যাকে দেখাচ্ছে তার হাতে একটা ডাসা পেয়ারা, লবণ লাগিয়ে আরাম করে খাচ্ছে। আর এদিক ওদিক দেখছে।

এর মধ্যে যেইনা ট্রেন ঢুকতে দেখা গেছে স্টেশনে, মোশন যথারীতি স্লো, মহিলার দল ব্যাগ বোচকা ঝুড়ি পুটুলি যার যা ছিল শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। অ্যাটেনশন মুড। পৃথিবীতে সব কিছু ছাড়া গেলেও, বিনা যোধে নাহি দিব সূচাগ্র সিট! যেই না ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে অমনি হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো বীরাঙ্গনার দল।

এসব লড়াইয়ে আমি বরাবরই লেফ্ট আউট। যা পড়ে থাকবে তাই দিয়ে চালাবো। দরকার হলে দাঁড়িয়েই থাকবো। হঠাৎ সামনে দেখি ওই মহিলা, যাকে `নিরীহ` বলে সম্বোধন করছিল আরেকজন, পাশের মহিলার চুলের মুঠি ধরে টেনে দিলো এক ঝটকা। তারপর সামনের পারঙ্গম যত ঢেউ তাদের পদচ্যুত করে উঠে গেল ট্রেনে। উঠেই জানলার ধারের সিট।

যাকে ঝটকা মেরেছিলো সেও দমবার পাত্র নয়। সেও ততক্ষণে ঝটকা সামলে উঠে পড়েছে। ওই মহিলারই উল্টোদিকের সিটে বসেছে এবং দুজন দুজনের সাথে হেসে হেসে বাক্য বিনিময় করছে! যেন দুই বীর সৈনিক, আজকের মতো যুদ্ধে জয়ী, অতঃপর ভুলে যেতে চায় কে কাকে ভূপতিত করেছিল।

এই মহিলা স্বামীর হাতে মার খায়? দুটো যুদ্ধ আলাদা বটে। তবু বিশ্বাস হলো না। ভাবনার ঘোরে সন্দিগ্ধ মন নিয়ে ট্রেনে উঠতে যাব তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ঘামতে ঘামতে ছুটছি। আর ঠিক তখন কালঘাম দিয়ে ঘুমটা ভাঙলো। ভাঙতেই মনে পড়লো, উফ কতদিন ইউনিভার্সিটি যাইনি। কবে যে লক ডাউন উঠবে। ভাবতে ভাবতে ফেসবুকটা খুললাম। খুলতেই চোখে পড়লো কে যেন একটা গ্রুপের ইনভিটিশন দিয়ে রেখেছে।

হারজিত

কিছুদিন হলো গিটার শেখা শুরু করেছে শ্রী। রোজ সন্ধ্যাবেলা বসে প্র্যাকটিসে। আজও বসেছে যথারীতি। সবে গিটারটা নিয়ে টুং টাং শুরু করেছে, ছুটতে ছুটতে এসে হাজির শ্রীর একমাত্র মেয়ে বছর চারেকের রুহি, হাতে ওর লাল রঙের ব্যাটারি চালিত খেলনা গিটারটা।

মাম্মা আমিও বাজাবো, বলেই সে গিটারের সুইচ যেই না টিপেছে অমনি বাজতে শুরু করলো খেলনায় সেট করা মিউজিক, তু রু তু রু প্যা প্যা পো পো...

শ্রী ভাবলো, এ তো মহা জ্বালা। কী আর করবে! বললে তো মানবেও না, বাচ্চা মানুষ। এই ভেবে সে বেস স্ট্রিংয়ে মন দিলো। কিন্তু ওই প্যা প্যা পো পোর ঠেলায় তো তার গিটারের মিহি সুর কোন্ তলানিতে। তার ওপর কিছুক্ষণ বাদে বাদেই রুহি বলছে, মাম্মা আমি জিতে গেছি জিতে গেছি...

বোঝো ঠ্যালা। প্রথম কিছুক্ষণ তো শ্রী ব্যাপারটা ইগনোরই করছিল। বাচ্চা মানুষ। কী জানি কি বলছে আপন মনে। কিন্তু রুহি সেই এক, কিছু সময় পর পরই দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে, মাম্মা আমি জিতে গেছি জিতে গেছি... সাথে তার খেলনা গিটারের তু রু রু রু রু...

ব্যাপারটা কি হচ্ছে বোঝার জন্য শ্রী এবার বলেই বসলো, কিসে জিতে গেছো রুহি? কার সাথে লড়াই? রুহি তার সরলতা মাখা একগাল হাসি নিয়ে বললো, তোমার সাথে।

হা হা করে হেসে উঠলো শ্রী, ও আচ্ছা। এই ব্যাপার। মায়ের সাথে গিটারের কম্পিটিশন? তাহলে তো তুমি জিতেই গেছো।
কেন জিতে গেছি? রুহির বিস্ময় মাখানো প্রশ্ন।
রুহির গালটা টিপে দিয়ে শ্রী বলে, কারণ তুমি আমার মেয়ে। তুমি বারবার জেতো সোনা। জিতে যাও। মা তো তোমার কাছে হারতেই চায়।

রুহি কী বোঝে, কে জানে। গিটারটা রেখে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।