শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘প্রমীলা দেবী’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২২

নিজের যা কিছু, তা নিয়ে প্রমীলা দেবীর দম্ভ ছিল ভারি। আমার বাড়ি, আমার রান্নাঘর, আমার শাড়ি, আমার গয়না, আমার বাগান, আমার ছেলে। আমি ও আমার, এই তার অহরহ উচ্চকিত উচ্চারণে বাড়ির সকলেই ছিল তটস্থ।

ছেলের বউ যেদিন থেকে বাড়িতে পা রাখল সেদিন থেকেই তার `আমার আমার` গেল বেড়ে। মনীষের ডাকনাম রনি। কিন্তু সচরাচর প্রমীলা দেবী ছেলেকে রনি বলে ডাকতেন না। ‘আমার ছেলে কই? ডেকে দাও।’ এমনই ছিল তার সম্ভাষণ।

বউমা পুষ্পিতা দাঁড়িয়েছিল রান্নাঘরের চৌকাঠে। বাড়ির কাজের সহায়ক বহুদিনের পুরনো মালতী আমতা আমতা করে বলেছিল, মাসিমা, বউমণির কিছু লাগবে মনে হয়।

রন্ধনরতা প্রমীলা দেবী কড়াইতে মাছের টুকরো ছাড়তে ছাড়তে বলেছিলেন, রান্নাঘর আমার। ওকে বলে দাও এখানে কার কী লাগবে না-লাগবে, আমি ঠিক করি।

চুপ করে সরে গিয়েছিল পুষ্পিতা।

মালতী ঝাঁটা হাতে বাড়ি পরিষ্কারে লেগেছে হয়তো। কোথাও একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রমীলা দেবী ঝংকার দিয়ে উঠতেন, এটা আমার বাড়ি। যেভাবে বলছি ঠিক সেভাবেই করো।

বাড়ির সামনে অনেকটা জমি নিয়ে বাগান। আম গাছ, লিচু গাছ, পেয়ারা গাছ, আর হরেক ফুল গাছ। দুপুরবেলা কোনো বালকের হয়তো সাধ হলো, একটা ডাসা পেয়ারা পেড়ে খাবে বেশ করে নুন মাখিয়ে, পাঁচিল টপকে সবে বাগানে পা রেখেছে, প্রমীলা দেবী দেখতে পেলেই গর্জে উঠতেন, এটা আমার বাগান! কোন্ সাহসে ঢুকেছিস রে হতচ্ছাড়া? দূর হ এক্ষুণি।

সেই প্রমীলা দেবীও একদিন ‘আমি ও আমার’ মায়া ত্যাগ করে রওনা দিলেন খই ওড়ানো পথে অন্তিম যাত্রায়। নিয়ে যেতে পারলেন না কিছুই। সবই পড়ে রইল যেমন তেমন। এভাবেই কাটল ক‘দিন।

একদিন দুপুরবেলা পাঁচিল টপকে ঢুকল সেই বালক। সে বোধহয় খবর পেয়েছিল বুড়ি আর নেই। পুষ্পিতা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। ছেলেটি কোচরে ভরে নিল পেয়ারা আর লিচু। পুষ্পিতা আনমনে হাসল। মালতীও ঝাঁটা হাতে বাড়ি পরিষ্কার করতে লাগল গান গেয়ে গেয়ে।

সেদিন সংসারের ফর্দ বানাতে বসেছিল পুষ্পিতা। মালতী রুটি বেলতে বেলতে বলল, বৌদিমণি একটা কথা বলব? খুব লজ্জা করছে।
বল, পুষ্পিতা কলম থামিয়ে মালতীর দিকে তাকালো।

বলছি মাসিমার তো দেরাজভর্তি শাড়ি। ওই লালপেড়ে সাদা একখানা থান ছিল... মাসিমার সধবা কালের... দেখে দিও না আমায় ... বড় পছন্দ ছিল শাড়িখান... আমার তো আর কেনার সাধ্যি নেই।

হঠাৎ পুষ্পিতা খেয়াল করল, তার হাতের কলম ফর্দের ওপর জোরে জোরে কী যেন লিখে চলেছে! এ কী আশ্চর্য। নিজের হাতের ওপর যেন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই পুষ্পিতার। কে যেন তাকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে পুষ্পিতা দেখল, সাদা কাগজের ওপর পুষ্পিতার কলম রুদ্ধশ্বাসে খসখস করে লিখে চলেছে, আমার... আমার... আমার... আমার... আমার... আমার... আমার...