শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’
পর্ব ১৭
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২১
বেহেস্তে ফিরে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে যাই। লাইব্রেরির কাজ খুব মন দিয়ে করি। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ, মিশ্মির দেখভাল করি। কিন্তু সুজানের কথাগুলো বারবার ফিরে আসে মনে, ভাবায়। কে নেই? কার সাথে দেখা হবে অনতিবিলম্বে? কে সেই আমার নিয়তি। ভেবে রোমাঞ্চিত হই।
সুজানের লেখা চিরকুট হাতে নিয়ে বসে থাকি বহুক্ষণ। তারপর সাবধানে রেখে দেই ডায়েরির ভাঁজে। রাত্রিবেলা মিশ্মি যখন অকাতরে ঘুমায়, চোখ বন্ধ করে আমি পৌঁছে যাই মেরুহা পর্বতের চূড়ায় সুজানের বরফে মোড়া কাঠের বাড়িতে। কিংবা সেই রডোডেনড্রনের বাগিচায়। সাদা পোশাকে সুজানকে মনে হয় যেন এই পৃথিবীর কেউ নন। যেন পারাবত, শান্তির দুটি ডানা মেলে এইমাত্র উড়ে যাবেন আকাশে। খসে পড়বে পাপড়ি তার উড়ে যাওয়ার পথে। হাঁটু মুড়ে বসি তার সামনে। সুজান মাথায় হাত রাখেন।
এমন কল্পনায় কাটে রাতের পর রাত। এই কল্পনার ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়ি। বড় হালকা লাগে নিজেকে। বুঝি না সুজানের প্রতি এ আমার কেমন প্রেম! যা কোনো লৌকিক চাওয়া পাওয়ার অধীন নয়। এমন সমর্পিত আমি আগে কখনো ছিলাম কি কারো কাছে? জুমেরান কিংবা ক্রিস্তভের কাছে? এদের প্রতি প্রেম আমাকে বন্ধনে বেঁধেছে আর সুজানের প্রতি এই যে প্রেম তা আমাকে দিয়েছে মুক্তি।
ঘুমের ভেতর একদিন স্বপ্ন দেখি। দেখি, ফ্রিতি নদীর সেতুর ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে জুমেরান। এ প্রান্তে আমি। জুমেরান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কুয়াশার ভেতর সে মাঝে মাঝেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জুমেরান আমার একেবারে নিকটে। তার মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তার দুচোখ বেয়ে বইছে জলধারা। দুহাতে সে আমাকে টেনে নিচ্ছে তার বুকের ভেতর। আমার ওষ্ঠ তার চিবুকে শুষে নিচ্ছে জল। আমি তার ওম স্পষ্ট অনুভব করছি, ঠিক এমন সময় দুলে উঠলো সেতু।
কারা যেন আমার বুক থেকে অন্ধকারের ভেতর জুমেরানকে ছিনিয়ে নিলো, যেমন দুরন্ত বাজপাখি এসে তুলে নেয় পক্ষীশাবক। চারদিকে দাউদাউ জ্বলছে আগুন। আর আমি ছুটছি। সমস্ত বাধা পার করে ছুটছি। ছুটতে ছুটতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। বুকের ভেতর তখনও দেখি লেগে আছে জুমেরানের গন্ধ। আমি মিশ্মিকে আঁকড়ে ধরি বুকের ভেতর।
পরের দিন ভোরে হঠাৎ কেউ জোরে দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে দেখি দাঁড়িয়ে আছে আমার পুরনো বন্ধু রুবি। বেহেস্তে ওই একমাত্র মানুষ যার সাথে ফ্রিতির যোগাযোগ। রুবি বলে ফ্রিতির একজন লোক ওকে খবর দিয়েছে বাবুজী ভীষণ অসুস্থ। শেষবারের মতো আমাকে দেখতে চায়।
আমি বেহেস্তে এসেছি বহুদিন হলো। ফ্রিতির কোনো মানুষের সাথেই যোগাযোগ রাখিনি। বাবুজীর সাথে তো নয়ই। যে পিতা নিজের সন্তানকেও বিকিয়ে দিতে দ্বিধান্বিত হয়নি তার সাথে সম্পর্ক রাখব কোন্ গৌরবে? এসব অতীত বিস্মৃত হয়ে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমার সাথে ফ্রিতির একমাত্র যোগসূত্র ছিল জুমেরান, তাকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা, যদিও এই দীর্ঘ সময়ে সেই আশ্বাসও স্তিমিত হয়ে এসেছিল, তবে ফুরায়নি।
রুবি বলে, বাবুজী জানিয়েছে তার আমাকে কিছু কথা বলার আছে। কী কথা তার আমার সাথে এতদিন পর? তার কথা ভেবে আমার মন আর বিচলিত হয় না, তবুও জন্মের দাগ কোথাও একটা প্রশ্নচিহ্ন রেখেই যায়, যা সহজে মেটার নয়।
বারবার মনে ভাবি, যাব কি যাব না। বহুদিন ফ্রিতির কাছে যাইনি। বাবুজীর কিছু বলার থাক বা নাই থাক, ফ্রিতিকে অনেক কথা বলার আছে আমার। তার জন্য আমার মন কেমন করে ওঠে। অনেক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নিজের অস্তিত্বটুকু মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম একদিন যে স্থান থেকে আজ আবার সেই বড় গভীর করে ডাকে।
লাইব্রেরি থেকে একমাসের ছুটি নিই। মিশ্মিকে সান্দ্রার কাছে রেখে রওনা হই ফ্রিতির উদ্দেশ্যে। একটা অনুচ্চারিত প্রশ্ন মনকে দ্বিধান্বিত করেই রাখে... জুমেরানের দেখা কি পাব? সে কি এসে দাঁড়াবে কাঠের ব্রিজে ঠিক স্বপ্নের মতো?
সাথে নিই সুজানের বই... হুইচ ক্যান নট বি সিন... এ যাত্রায় এই বই-ই আমার সঙ্গী... যে আমাকে শক্তি দেবে। চলবে