শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১৫

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০২১

বেহেস্ত থেকে ত্রিশ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পৌঁছতে হয় মেরুহা পর্বতের পাদদেশে। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ উঠে গেছে উপরের দিকে। এই পাহাড়ের উপত্যকায় রয়েছে এক নিরালা গ্রাম। সেখানেই থাকেন সুজান। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে দূরে একাকী। শুনেছি, শহরে আছে তার পরিবার। কিন্তু সচেতনভাবেই সেই সবকিছুর থেকে দূরে নিজেকে রেখেছেন তিনি তার সৃজন ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য। এই দুইই তার তপস্যা।  দিনের বেলা স্থানীয় বালকদের জন্য একটি স্কুল চালান তিনি। গ্রামের মানুষ আসে তার কাছে। পার্থিব অপার্থিব সকল বিষয়েই তিনি তাদের উপদেশ দেন সাধ্যমতো। কারো চিকিৎসার প্রয়োজন হলে শহরের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বাকি সময়টা থাকেন নিজের সৃষ্টিতে মগ্ন। স্থানীয় লোকজন তাকে দেবতার মতো সম্মান করে। তার অন্যতম কারণ তাদের বিশ্বাস, সুজান ভবিষ্যৎ দেখতে পান। ভবিতব্য তার গোপন প্রকল্প তার কাছে মেলে ধরে।

পাহাড়ি রাস্তা বরাবর উঠতে থাকি সুজানের গ্রামের দিকে। রাস্তার একপাশে ঢালু নেমে গেছে খাদ। অন্যপাশে সোজা উঠে গেছে পার্বত্য বৃক্ষের সারি। পথ, পথের পাশে অরণ্য যতদূর দৃষ্টি যায় তুষারাবৃত। ঘন তুষারের আস্তরণ ঠেলে কোনোক্রমে এগোয় গাড়ি। নির্দিষ্ট দূরত্বের পর গাড়ি আর এগোবে না। অরণ্যের ভেতর দিয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে হেঁটেই এগিয়ে যাই উপত্যকার দিকে। একটি মানুষের সঙ্গ লাভের এই যে সুদীর্ঘ যাত্রাপথ তা কষ্টসাধ্য হলেও মধুর লাগে, কারণ এ নিছক কোনো প্রেম নয়, জৈবিক তাড়না নয়, যেন কোনো আলোর টানে চলা।

গ্রামে যখন পৌঁছাই তখন সূর্য অস্তগামী। তুষারের ওপর অস্তগামী সূর্যের আলো লেগে এক অদ্ভুত বিভা চারদিকে। একটি দশ-বারো বছরের ছেলেকে সুজানের নাম বলতেই সে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। এসে দাঁড়াই একটি কাঠের বাড়ির সামনে। ছেলেটি আমাকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে যায়। আমি দেখি, তুষার মাথায় করে কেমন নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট বাড়িটি, যেন ডুবে আছে ধ্যানে। বাড়ির লাগোয়া ছোট বাগান। সেখানে নানারকম ফুল আর সবজির সমারোহ। বাড়ির সদর দরজায় ছোট স্টিলের নেইম প্লেটের ওপর লেখা, সুমিথি।

বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। দরজা খুলে স্বয়ং এসে দাঁড়ান সুজান। মুখে সেই ঈশ্বরসুলভ হাসি। যেন এই দেখা হওয়া পূর্বপরিকল্পিত এমনই তার ভাব। আমাকে ভেতরে আসতে বলেন সুজান। আমি তাকে অনুসরণ করি। দরজার ডানদিকে যে ঘর সেখানে একটি বিরাট বড় ফায়ার প্লেস। অনেকগুলি চেয়ার আর একটি বিরাট বড় সেন্টার টেবিল। সেখানে একপ্রান্তে আমাকে বসার ইঙ্গিত করেন সুজান। নিজে বসেন টেবিলের অপর প্রান্তে। তার ভঙ্গি এমন যেন ধ্যানস্থ। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু মৃদু হাসি।

আমি বলি, আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনাকে না জানিয়েই...
ফায়ার প্লেসের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায় সেই বালক। বড় কাচের জানালাটি বন্ধ করে ভারি পর্দা টেনে দেয়। তারপর একটি গোল কাচের পাত্র এনে রাখে টেবিলে আমার সামনে। পাত্রে গরম স্যুপ থেকে ধোঁয়া ওঠে। সুজান প্রণামের ভঙ্গিতে বলেন আমাকে তা গ্রহণ করতে। ভক্ত তার গুরুকে সেবাদান করে শুনেছি, কিন্তু একজন ঈশ্বরতুল্য মানুষ একজন হঠাৎ এসে পড়া অতিথির আচরণে বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে তাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা দেন, আগে তা শুনিনি। কেন জানি না, আমার চোখ বেয়ে জল নামে। সুজানের চোখ বন্ধ। আমি চোখ মুছে স্যুপ খেতে থাকি। এই তীব্র শীতে উষ্ণ বোধ হতে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে বালকটি আসে। আমাকে একটি অন্য ঘর দেখিয়ে বলে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। বলে, তোমার খুব ঘুম পেয়েছে। একটু আরাম করে।

ছেলেটি কী করে বুঝলো জানি না, আমার দুচোখ ভেঙে আসছে তখন ঘুমে। এত ঘুম যেন বহুদিন আসেনি আমার জীবনে। এতদিন কেবল ক্লান্ত ছিলাম। আজ আমি শ্রান্ত। কাউচে গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই আমি ঘুমের সমুদ্রে ডুবে যাই।

ঘুম যখন ভাঙে তখন গভীর রাত। সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ। এ যেন উপত্যকা নয়, যেন বিশাল এক সমুদ্র। সেখানে নিজেকে বুদবুদের চেয়েও হালকা মনে হয়। এত নির্ভার লাগেনি বিগত বহু বছরে। এই ঘুম যেন আমাকে পুনর্জীবিত করেছে। যত যন্ত্রণার স্মৃতির পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছি এযাবৎ নিজের ভেতর, তা যেন মেঘের মতো উড়ে গেছে। মনে করতে থাকি, জুমেরানের কথা, ক্রিস্তভের কথা। স্মৃতির ভেতর হাতড়াতে থাকি সব কিছু। কে আমি, এখানে কেন এলাম! শুধু এক নির্ভার ভেসে চলা ছাড়া আর কিছুই বিশেষ ছুঁতে পারি না অনুভবের ভেতর। আমি কি কোনো ঘোরের ভেতর আছি? সুজান কোথায়?

ঘর থেকে বেরিয়ে সামনেই একটি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে চিলেকোঠায় একটি ঘর। সেখানে একটি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখে চলেছেন সুজান। নীরব রজনীতে পৃষ্ঠার সাথে তার কলমের কথোপকথনের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে যেন। আমি দাঁড়াই তার দরজার সামনে। সুজান পিছনে না ঘুরে তার কলম চালাতে চালাতেই বলে ওঠেন, ভেতরে এসো।

আমি ঘরে ঢুকি। মেঝেতে একটি বিরাট আসন পাতা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ি। কলম হাতে সুজানকে ম্যাজিশিয়নের মতো লাগে। তার চোখ খোলা। অথচ যেন তিনি ধ্যানস্থ। তিনি নিজের ভেতর কোথাও নেই। অথচ নিজের ভেতরেই সম্পূর্ণভাবে সমাহিত। আমি মুগ্ধ হয়ে সুজানকে দেখি, যেমন করে মানুষ আকাশ দেখে সমুদ্র দেখে অরণ্য দেখে, ঠিক সেভাবেই। চলবে