শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘লাশ’
প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০২২
লাশটা এসেছে কাল ভোররাতে। সুইসাইড কেস। মর্গের ডোম হ্যাবলা স্ট্রেচারে করে এনে লকারে রেখেছিল। কিছুক্ষণ হলো বের করে টেবিলে দিয়েছে। সাদা চাদরে মোড়া একটা পাতলা শরীর। মুখটুকু বেরিয়ে আছে। ফিনফিনে ত্বক এখন কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।
পোস্ট মর্টেম করবেন ডক্টর প্রসাদ। এতক্ষণ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগ্রেটে টান দিচ্ছিলেন। পরপর অনেকগুলো লাশ কাটা হলো। ক্লান্ত লাগছে। কেন কে জানে, নভেম্বরের শুরুর দিকে কুয়াশা পড়া শুরু হলেই একের পর এক বডি আসতে থাকে। সব সুইসাইড কেস। ঠাণ্ডায় কি কোমর্বিডিটির সাথে বিষণ্ণতাও বাড়ে?
ঘরে ঢুকলেন প্রসাদ। টেবিলের ওপর শরীরটা এলানো। বোঝাই যাচ্ছে ফুটফুটে মেয়ের শরীর। সাদা চাদরটা টেনে সরিয়ে দিলেন প্রসাদ। তারপর নগ্ন শরীরটা আপাদমস্তক ভালো করে দেখলেন। পুরুষের চোখ দিয়ে নয়, একজন অভিজ্ঞ ফরেন্সিক ডাক্তারের চোখ দিয়ে। যুবতীর মৃত শরীর দেখলে মনের ভেতর কেমন এক সন্ন্যাসী মেঘ জমে। এই বয়সেই আত্মপ্রবন্চনা?
শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। দুটো চোখ বন্ধ, মুখ ভাবলেশ হীন। পাতলা শরীর। গায়ের রং ফর্সা। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে ট্রে-র দিকে হাত বাড়ালেন প্রসাদ। একাধিক কাঁচি আর ছুরি পাশাপাশি রাখা। দক্ষ হাতে শরীরের মাঝ বরাবর পথ কাটতে শুরু করলেন ডক্টর। ওই পথ দিয়ে তিনি ভেতরের দিকে যাবেন এবার।
পথ কাটতে কাটতে ঝর্ণার মতো বেরিয়ে আসতে থাকলো রক্ত। ঠিক যেন লাল আঙুরের রসের মতো পুরু। রক্তের ধারার দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভুত অনুভব হলো প্রসাদের। জীবনে রক্তপ্রবাহ তো কম দেখেননি। দ্রুত হাতে সব পরিষ্কার করে আরও ভেতরের দিকে হাত চালালেন ডক্টর। যত ভেতরে ঢুকছেন তত আবিষ্ট হচ্ছেন তিনি। আহা, কী টুকটুকে একটা লিভার! আর অন্ত্রের আকৃতি কী নিপুণ! বিষ খেয়ে মরেছে মেয়েটা। লিভারে আছে ওরাল সাসপেনশন।
গর্ভাশয় অনিষিক্ত ফুলের মতো ফুটে আছে। অক্ষত যোনী। আরেকটু ওপরের দিকে, আহা হৃদযন্ত্রের জালিকায় যেন সূর্যাস্তের রং লেগে আজে। কী টাটকা একটা হৃদয় লাবডুব করতে করতে থেমে গেছে অকারণ। প্রেমিক মানুষের হৃদপিণ্ডটি ঠিক এমনই তো হবে। পাঁজরার হাড়ের গঠন কি সুন্দর। কোথাও এতটুকু খুঁত নেই।
নিজেকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে ডক্টর প্রসাদের। এম.বি.বি.এস পাস করার পর ফরেন্সিক নিয়ে পড়েছেন প্রসাদ। এত বছর ধরে এত মৃত শরীর ঘেঁটেছেন তিনি। খুঁজে খুঁজে বের করেছেন মৃত্যুর কারণ। কিন্তু কোনো শরীরকে ভেতর থেকে দেখে এত আবিষ্ট হননি। কিন্তু আজ কি এমন হলো?
দু’ভাগ হয়ে যাওয়া শরীরটা সেলাই করার আগে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রসাদ। স্কুল লাইফে এক একটা সোনা ব্যাঙের শরীরে মাঝবরাবর কাঁচি চালিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করার পর এমনই একটা আবেশ অনুভব করতেন প্রসাদ। ফুলের মতো ফুটে থাকা হৃদযন্ত্র বৃক্ক মূত্রাশয়ের পাতা সরিয়ে দেখতেন। ফর্মালিনের গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতো। কিন্তু কোনো মানুষের শরীর দেখে এই আবেশ প্রথম। মানুষ নাকি মানবী?
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফুটফুটে মেয়েটাকে আরও একবার ভালো করে দেখলেন ডক্টর প্রসাদ। নাহ্, তার এই মুগ্ধতায় কোনো যৌনদাগ নেই। মানুষের শরীরের বাইরেরটুকু খোলস মাত্র। কিন্তু আসল রহস্য তো ভেতরের কর্মশালায়। ডাক্তারি পড়ার সময় অ্যানাটমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন তিনি। একটি মানুষের শরীর ভেতর থেকে যতটা পারফেক্ট হতে পারে, এই মেয়েটিরও তেমন। ভেতরের কর্মশালার এই নিখুঁত সৌন্দর্যই তাকে মুগ্ধ করেছে। একটি অসাধারণ কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেমন উত্তীর্ণ হবে, এ শরীর যেন তাই।
এত সুন্দর একটা শরীরকে অকালে কালযমুনায় বইয়ে দিলো মেয়েটি। কাল এই শরীর জ্বলে খাক হবে। পড়ে থাকবে এক মুঠো ছাই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাদা কাগজে খসখস করে রিপোর্ট লেখা শুরু করলেন প্রসাদ। ঠিক সেসময় ঘরে এসে ঢুকলো হ্যাবলা। প্রসাদের কাছে এসে টেবিলের ওপর শুয়ে থাকা বডির দিকে তাকিয়ে বললো, কী সুন্দর, না?
হ্যাবলার ঘোলাটে চোখের ভেতর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ফেলে প্রসাদ বললেন, তুই সুন্দরের কি বুঝিস ছাই!
হ্যাবলা বললো, বুঝি বুঝি। জানেন ডাক্তার কাল ভোররাতে মেয়েটার লাশ নিয়ে এয়েছে মেয়ের বাপ। সে কী কান্না। কাঁদতে কাঁদতে কইছিল মেয়ে নাকি কবি। কবিতে লিখতো আর সেই তার কাল হলো। লোকে নাকি তার কবিতে শুনে বলতো, মেয়েটার ভেতরটা খুব সুন্দর। সে তো সুন্দর হবেই বলেন ডাক্তার। আর্টিস মানুষ। এক শ্বাসে সব কথা বলে হ্যাবলা হ্যাল হ্যাল করে বডির দিকে তাকিয়ে রইলো।
ডক্টর প্রসাদ রিপোর্ট লিখতে লিখতে কলম থামিয়ে হ্যাবলার দিকে চেয়ে রইলেন।