শ্রেয়া চক্রবর্তী
শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘আমি কান পেতে রই’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০২২
টানা দালান। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছেন বিভূতিবাবু। চোখে কালো চশমা। হাতের লাঠিটা পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। সামনের ছোট টেবিলে পেতলের গেলাসে জল, ছোট একটি রেডিও।
বছর পাঁচেক হলো, গ্লুকোমার কারণে চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রস্ব হতে হতে প্রায় পুরোটাই হারিয়েছেন। সকাল বেলার কাগজখানা পড়তে বৌমার সাহায্য লাগে। আরতি সকালের চা দিতে এসে শ্বশুর মশাইকে প্রধান খবরগুলো পড়ে শোনায়। ওর আবার রান্না চাপানোর তাড়াহুড়ো থাকে। বিভূতিবাবুর একমাত্র ছেলে সন্দীপ অফিস বেরোয়। বছর পাঁচেকের নাতি শোভন যায় স্কুলে। তাকে তৈরি করতে হবে। সব একা হাতেই সামলায় আরতি। এসবের মাঝে বিভূতিবাবুর চা আর জল খাবার।
বড় ঘড়িতে এগারোটা বাজার ঢং ঢং শব্দ হলে বিভূতিবাবু লাঠিটা নিয়ে দালানের আরাম কেদারায় এসে বসেন। বিভূতিবাবু আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর হালকা করে রেডিওটা চালিয়ে দেন। আজকেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। হালকা করে রেডিওটা চালিয়ে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসেছেন বিভূতিবাবু। এমন সময় বিভূতিবাবুর নাতি শোভন চুপিচুপি প্রায় নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বোধহয় সদ্য স্কুল থেকে ফিরেছে। একগাল হাসি নিয়ে সে কী যেন পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
কি করছো খোকন? হঠাৎ শোনা যায় বিভূতিবাবুর জলদগম্ভীর কণ্ঠ। আস্তে করে রেডিওটা বন্ধ করেন হাত বাড়িয়ে।
খোকন অবাক। সে তো পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়েছে। দাদু তো দেখতেই পায় না। তবে বুঝতে পারলো কি করে?
দাদাই, তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ পাচ্ছি বৈকি। আমি কিন্তু সব দেখতে পাই। স্মিত হেসে উত্তর দেন বিভূতিবাবু।
দাদুর উত্তরে সন্দিহান হয় শিশুপুত্র। মা যে বলে, দাদাই চোখে আজকাল একদমই দেখতে পাচ্ছে না রে খোকন। বাবা কত বড় বড় ডাক্তার দেখালো। কী যে হবে মানুষটার! তাহলে কি মা ভুল বলে? সন্দেহের নিরসন ঘটাতে সে প্রশ্ন করেই ফেলে, কিন্তু মা বলে তুমি কিছু দেখতে পাও না। আচ্ছা বলো দেখি, তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন বৃদ্ধ। এক উদাস নির্লিপ্ততার মধ্যে কিছুক্ষণ ডুবে থেকে বলে ওঠেন, আকাশে কেমন মেঘ করে এসেছে তুমি দেখেছ খোকন? আজ খুব বৃষ্টি হবে। আমি বৃষ্টি দেখবো। ওই গাছটা দেখেছো? ওর খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে আজ। তুমি জানো?
শোভন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে বলে ওঠে, আর কি দেখতে পাচ্ছ তুমি?
বিভূতিবাবুর মুখে স্মিত হাসি খেলা করে।
শোভন অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হলো? বলো?
বৃদ্ধ এবার বলেন, খোকন, ওই যে রান্নাঘরে একটা বেড়াল ঢুকলো। তোমার মা কিন্তু এখনো দেখতে পায়নি। দুধের বাটিতে মুখ দিলো বলে।
শোভন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে একছুটে ভেতরে চলে যায়। বিভূতিবাবুর কণ্ঠে গুনগুন গান। পুনর্বার বিভূতিবাবুর গান থামে শোভনের কণ্ঠে, দাদাই বলো তো, তুমি আর কি কি দেখতে পাও?
তোমার ওয়ার্ড বুকের নিচে ওটা কি খোকন? টিনটিন? লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছো? এসো না, আমরা একসাথে পড়ি। বলেই হা হা করে হেসে ওঠেন বৃদ্ধ।
শোভন এক দৌড়ে ঘরের দিকে যায়। রেডিও অন করেন বৃদ্ধ, চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে...
নীরবে খোকন এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, জানেন তিনি। স্মিত হেসে বলেন, গানটা শোন খোকন।
ধুর দাদাই, তুমি কী বোকা! আচমকা বলে ওঠে খোকন। বিভূতিবাবু ভীষণ অবাক হয়ে রেডিওর আওয়াজটা কম করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন? আমি আবার কী করলাম!
আমি তো গান শুনি না। আমি গান দেখি ইউটিউবে। তুমি গান দেখতে পাও না?
এবার একেবারে বিভূতিবাবুকে মোক্ষম প্রশ্নের সামনে ফেলা গেছে। দাদাই তো জানেই না যে, গানটা একেবারেই শোনার জিনিস নয়। গান হলো দেখার জিনিস।
বিভূতিবাবু কিছুক্ষণ থেমে থাকেন। আপনমনে কী যেন ভাবেন। তারপর বলেন, দেখতে পাই বৈকি। আমিও গান দেখতে পাই খোকন। চোখ বন্ধ করে দেখি। ওই দূরে বৃষ্টির গান আর পাতাঝরার গান কেমন করে মিলেমিশে এক হয়ে গেল।
ধুর, সব মিথ্যা কথা। তুমি আসলে কিছুই দেখতে পাও না। খিলখিল করে হেসে ওঠে শোভন। যেন এতক্ষণ ধরে যে সত্য সে যাচাই করে দেখতে চাইছিল, এবার সেটা জানা হয়ে গেছে।
খিলখিল হাসির শব্দ ম্লান হতে হতে দূরগত হয়। লাঠি হাতে সচকিতে উঠে দাঁড়ান বিভূতিবাবু, কি হলো খোকন? তুমি চলে গেলে? বিশ্বাস করো, আমি দেখতে পাই... আমি সব দেখতে পাই...
হতাশ হয়ে বসে পড়েন বৃদ্ধ। রেডিওতে বাজতে থাকে:
আমি কান পেতে রই
ও আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে
বারে বারে কান পেতে রই...