শৈশবের স্বপ্ন-কল্পনার আনন্দপুরী ‘কিশলয়’

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২৪

শিশুদের মানসজগৎ আনন্দের সরোবর। প্রতিমুহূর্তে সেখানে সৌন্দর্যের পাপড়ি মেলে ফোটে কল্পনার মানসপদ্ম। আর তাই, আনন্দের ভেতর দিয়েই তাদেরকে জীবন ও জগৎ চেনানো উচিত। শিশুকে যেভাবে আপনি পৃথিবী চেনাবেন, সেভাবেই সে চিনবে। এক্ষেত্রে কবিতা একটি চমৎকার মাধ্যম। কারণ, কবিতার ছন্দ, চিত্রকল্প ও বিষয় শিশুর মানসগঠনে বিশেষ প্রভাব রাখতে পারে। কবিতার ছন্দে-আনন্দে দুলতে দুলতে তৈরি হয় তাদের কল্পনার জগৎ। তবে সেসব কবিতা হতে হবে সহজ, সরল ও শিক্ষামূলক। কবিতার চিত্রকল্প হতে হবে আয়নার মতো ঝকঝকে। এসব কবিতা পড়তে পড়তে চিত্রকল্পকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে খুদে পাঠক আনন্দে দুলবে। এরই সাথে তৈরি হতে থাকবে তার মানসিক জগৎ।

শিশুদের কল্পনাশক্তি খুবই প্রখর। তারা নিজেদের ভেতর এক ধরনের স্বপ্নের জগৎ তৈরি করে নেয়। সেই জগতেই তারা আনন্দ-আয়োজনে মেতে থাকে। ফলে, তাদের আবেগও বেশি। বড়দের সামান্য বিরোধিতায় তাদের আবেগ আহত হয়। বড়দের বাস্তবতা তাদের জটিল লাগে। ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। তারা চোখের সামনে বড়দেরকে নানা অপকর্ম করতে দেখছে। বড়রা কী সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলছেন। সামান্য বিষয় নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করছেন। অথচ তাকে বলা হচ্ছে, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। ঝগড়া করবে না। শিশুসাহিত্য পড়ে শিশু যে নৈতিকতা অর্জন করে, বড়দের বাস্তবতায় শিশু সেই নৈতিকতা খুঁজে পায় না।

সে দ্যাখে, বড়দের প্রত্যেকের পকেটে লুকনো রয়েছে নানা আকৃতির ও বর্ণের অদৃশ্য এক-একটি মুখোশ। সময় ও সুযোগ বুঝে ব্যক্তিগত স্বার্থ-উদ্ধারে বড়রা সুবিধামতো কোনো একটি মুখোশ পকেট থেকে বের করে টুপ করে মুখে পরে নিচ্ছে। ওই মুখোশকে ওই মানুষের মুখ মনে করছে শিশুটি। কিন্তু আরেকবার সে দেখছে, ওই মানুষের মুখে আরেকটি বর্ণের মুখোশ। ছলচাতুরির এই বাস্তবতা বুঝতে বুঝতে তারা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব। মানুষ যখন শৈশব পেরিয়ে আসে, তখন আসলে সে তার জীবনকে পেরিয়ে আসে। এরপর সামাজিক মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা, তাদের মতো করে সবকিছু করা, এভাবেই মানুষ ক্লান্ত হতে হতে একটা সময়ে বুড়িয়ে যায়। এরপর মরে যায়।

শৈশবেই যদি আমাদের সন্তানদের ভেতর সুস্থ রুচি ও নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে দেয়া যায়, তাহলে বড় হয়ে তারা আরসব মানুষের মতো একপাল গাধা হয়ে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করবে না। তাদের মুখ থাকবে, কিন্তু পকেটে অদৃশ্য মুখোশ থাকবে না। তাদের জীবন হয়ে উঠবে নৈতিকতার মহত্ত্বে দীপ্তিমান। তবেই তৈরি হবে আগামীর সুখি ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, “আপনার পরিকল্পনা যদি এক বছরের জন্য হয় তাহলে ধানগাছ রোপণ করুন। আপনার পরিকল্পনা যদি দশ বছরের জন্য হয় তাহলে গাছ লাগান। আপনার পরিকল্পনা যদি একশো বছরের জন্য হয় তাহলে শিশুকে শিক্ষা দিন।” আজকের সমাজে কোন অভিভাবক এই কর্তব্য পালন করছেন? আমরা এখন বরং গাছ কেটে ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশনার লাগাচ্ছি। শিশুদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়ে নেমে পড়েছি টাকা উপার্জনে। খাচ্ছি, দাচ্ছি, আর ঘুমোচ্ছি। আর ভাবছি, যা-কিছু শেখাশিখির ব্যাপার সেসব স্কুল-কলেজে গিয়েই শিখবে। আমাদের ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু আমাদের স্কুল-কলেজ কী শেখাচ্ছে, কতটুকু শেখাচ্ছে― সে বিষয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।

এই বাংলাদেশে একদা আমাদেরও শৈশব ছিল। স্বপ্ন-কল্পনার আনন্দ ছিল। স্কুলের বাংলা বইয়ের পাতায় পড়তাম কী অসাধারণ সব কবিতা! সাথে থাকতো আরও অসাধারণ অলঙ্করণ। সেসব কবিতা পড়ে আর ছবি দেখে আমাদের কল্পনার পাখি আনন্দে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে দিতো। এরপর উড়াল দিতো ইচ্ছেমতো। আজকে আমরা বড় হয়ে গেছি। জীবিকার তাড়নায় ভিড় করেছি শহরে। শহরের প্রতি-ইঞ্চিতে ফাঁদ পাতা রয়েছে। যে যার ধান্দায় ছুটতে ছুটতে প্রতিমুহূর্তেই আমাদের কেউ না কেউ সেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি। আর, কপাল চাপড়াচ্ছি। এই দৃশ্য দেখে ফাঁদের পাশ দিয়ে ছুটতে থাকা আরসব মানুষ ভাবছে, ভাগ্যিস, আমি এখনো ফাঁদে পড়িনি! পরমুহূর্তেই তাদেরই কেউ না কেউ পা হড়কে পড়ে যাচ্ছে ফাঁদে। ফাঁদে আটকে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে। আর ওপরের দিকে চেয়ে দেখছে, মানুষ ছুটছে। এইভাবে ছুটতে থাকা আজকের আমরা ভুলে গেছি আমাদের শৈশবের বিস্ময়গুলো। কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত হয়ে সন্ধের পর ফিরে আসি মুরগির খোপের মতো ফ্ল্যাটে। এরপর সারাদিনের অবসাদে গা এলিয়ে দিই বিছানায়। ভোরবেলা আবার কাজে ছুটতে হবে যে!

এরই কোনো এক অবসরে আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমাদের সন্তানরা কিভাবে বেড়ে উঠছে? আজকে প্রতিটা শিশুর হাতে স্মার্টফোন। কার্টুন দেখার সাথে সাথে তারা দেখছে টিকটক, শর্ট-ভিডিও ও গেমসসহ নানা রকমের ভাইরাল কনটেন্ট। যে কনটেন্ট যত বেশি অরুচিকর সেই কনটেন্ট তত বেশি ভাইরাল। কিশোরদের দেখি, রাস্তাঘাটে, বাড়িতে, যানবাহনে হাতে স্মার্টফোন নিয়ে এসবই দেখছে। কেউ কেউ ফিকফিক করে একা-একা হাসছে। এভাবেই তাদের মানসজগৎ যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকের ভেতর অস্থিরতা। নিজের ভেতর স্বপ্ন-কল্পনার আনন্দপুরী আজকের শিশুরা তৈরি করতে পারছে না। সেই সমাজ ও পরিবেশ আমরা তাদের দিতে পারছি না।

শৈশবে আমরা দেখেছি, সমাজের মানুষগুলো কত সহজ আর মানবিক ছিল। বেশির ভাগ মানুষের ভেতর নীতি-নৈতিকতা ছিল। ঈদ-উৎসবে প্রাণের চাঞ্চল্য জেগে উঠতো। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বাড়িতে যেতাম। ভ্রাতৃত্ব আর মমতার সেই সোনালি দিন এখন হারিয়ে গেছে। আজকের প্রজন্ম যান্ত্রিক। অস্থির এই শিশু-কিশোররা আমাদেরই সন্তান। আমাদেরকেই দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে তৈরি করতে হবে।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির রূপরসগন্ধে প্রতিমুহূর্তে মানুষের জৈবিক রসায়ন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রকৃতির নানা উপাদানের সাথে মানুষের রয়েছে হৃদ্য সম্পর্ক। মহাবিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম মেনে। সেই নিয়মের সূত্রটি পাওয়া যায় জ্ঞান থেকে। মুশকিল হচ্ছে, প্রকৃতির প্রাণের স্পন্দন আমাদের সন্তানদের মানসজগতে এখন আর ঢেউ তোলে না। প্রকৃতির নিবিড় ঐকতানও তারা শুনতে পায় না। প্রকৃতির রহস্য বিষয়ে তারা উদাসীন। অজানাকে জানার কোনো ইচ্ছাই তাদের মধ্যে দেখা যায় না। তাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বপ্ন-কল্পনাকে রাঙিয়ে দেয়া এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য আমাদের শৈশবের স্কুলপাঠ্য কবিতাগুলো তাদের পড়ানো দরকার। প্রতিটা কবিতার সঙ্গে থাকবে সেই অলঙ্করণগুলো।

এই ইচ্ছে থেকেই গোছাতে শুরু করলাম সঙ্কলনটি। সহজ ও মিষ্টি ভাষায় প্রতিটা কবিতার পাঠ-পরিচয় লিখতে চেষ্টা করলাম। কবিতা পড়ে খুদে পাঠক কী শিখলো, সেই পাঠ পরীক্ষা করতে তৈরি করলাম পাঠ-পরীক্ষা। সঙ্কলনের প্রতিটা কবিতাই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এসব কবিতা যখন লেখা হয় সেই সমাজ থেকে আজকের সমাজ অনেক জটিল। সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মানুষও হয়ে উঠেছে জটিল। ফলে, মানুষের ভেতর থেকে হারিয়ে গেছে মানবিক বোধ। ভালো-মন্দ বোঝার জ্ঞানও এখন মানুষের নেই। এই বিবেচনা থেকে বর্তমানের উপযোগী করে কবিতাগুলোর পাঠ-পরিচিতি লিখেছি।

অতীতের সমাজে কেউ কারো ক্ষতি করলে তাকে ক্ষমা করে দিলে ক্ষমাকারীর মানবিক মহত্ত্ব মানুষ বুঝতো। আজকের সমাজে ক্ষমাকারীকে মানুষ মনে করে দুর্বল। নয়তো বোকা। মানুষটি যে মহত্ত্ব দেখিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিলেন, এটা বোঝার মতো বোধ এখন আর কারো নেই। আজকের সমাজে কারো উপকার করতে গেলে দশবার ভেবে নিতে হয়। না-হলে নিজেই মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে হয়। উপদেশমূলক কবিতার পাঠ-আলোচনায় আজকের এই সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরেছি। এর ফলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের সন্তানরা জটিল ও কুটিল এই সমাজে বুঝেশুনে চলতে শিখবে।

এরই পাশাপাশি তাদের ভেতর নৈতিক জীবনবোধ জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ, প্রতিদিনের কোনো একটুকরো অবসরে আপনার শিশুকে সাথে নিয়ে বসুন। বইটা তুলে দিন তার হাতে। পড়ে শোনান। খুদেটাকেও পড়তে দিন। এরপর পাঠ-পরীক্ষা থেকে তার পাঠের পরীক্ষা নিন। খাতায় প্রশ্ন লিখে তাকে লিখতে দিন উত্তরগুলো। প্রথমদিকে কাজটি মোটেও সহজ হবে না। দস্যিটা স্মার্টফোন ছেড়ে বইটা ধরবে না। কিন্তু আপনার উচিত, ধৈর্য ধরা। ধীরে-ধীরে একটা সময়ে গিয়ে দেখবেন, আপনার সন্তানের ভেতর থেকে প্রকৃতির সুর শোনা যাচ্ছে।

‘কিশলয়’ সঙ্কলনের ভূমিকা

প্রকাশক: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রচ্ছদ: মূল বই অবলম্বনে রহমান মিঠু
দাম: ৩৩৫ টাকা

একুশে বইমেলা ২০১৮