শেরিফ আল সায়ারের গল্প ‘এক্সিট ডোর’
প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০১৯
আগে কখনো এমন হয়নি। বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে শহরজুড়ে তোলপাড় হওয়ার চিত্র বোধহয় এটাই প্রথম। এমন এক দগ্ধ সময়ে এ ধরনের বিজ্ঞাপনে পত্রিকার সম্পাদকের মাথার ঘাম ছুটিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা।
বিজ্ঞাপন নিয়ে একজন বিখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ফোন দিয়েছিলেন সম্পাদককে। বললেন, ‘এমন একটা বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য ভালো হলে ঠিক আছে কিন্তু না বুঝে-না শুনে এমন বিজ্ঞাপন ছাড়লেন কিভাবে আপনি?’
শুধু কি নারীবাদী নেত্রী? রাজনীতিবিদ, চারজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং স্বয়ং প্রকাশকও বিষয়টা নিয়ে বিব্রত। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা দাবি করছে, এই ফাঁদে পা দিয়ে অনেক নিরিহ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা তো মাথায় রাখা দরকার ছিল।
এসব ঝামেলায় অস্থির হয়ে মার্কেটিং বিভাগের প্রধানকে চাকরিচ্যুত করে দিয়েছেন সম্পাদক। শুধু তাই নয়, যার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনটি এসেছে তাকেও স্ট্যান্ড রিলিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ।
আপনারাই বলেন, পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন যাবে, সেটা কি সম্পাদকের দেখার সময় আছে? তার কাজ সংবাদ নিয়ে, বিজ্ঞাপন নিয়ে তো নয়। সে জন্য তো বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই টিমে আছে আরও ছয়/সাত জন। তারা কি ঘাস কাটে?
যখন বিজ্ঞাপন নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত সবাই, তখন বিজ্ঞাপনদাতাকে সত্তর অফিসেও আসতে বলা হয়েছে।
তার নাম জাফরুল্লাহ কাদীর। তিনিও দ্রুত চলে এলেন অফিসে। তিনি সেচ্ছায় তো এখানে আসেনি। সকালে পত্রিকার যুগ্ম বার্তা সম্পাদক মো. বেলায়েত তালুকদার ফোন দিয়ে বললেন, আ-প-নি, আপনি জাফরুল্লাহ সাহেব?
—জি বলছি।
—আমি দৈনিক সময়কালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক বেলায়েত তালুকদার।
—জি বলুন।
—আজ আপনার, মানে আপনি একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন আমাদের পত্রিকায়।
—জি।
—এটা নিয়ে আমরা একটু ঝামেলায় পড়েছি। আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের অফিসে একটু আসতেন, খুব ভালো হতো। আপনার সঙ্গে সম্পাদক কথা বলতে চান।
জাফরুল্লাহ’র ধারণা ছিল বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই এটাকে সহজভাবে নেবে না। মানসিকভাবে প্রস্তুতি তার ছিল। আর এজন্যই অফিস আসতেও তিনি দেরি করেননি। ফোন পেয়েই রওনা দিয়ে চলে এলেন।
অফিসের রিসিপশনে বসেও টের পেয়েছেন বিজ্ঞাপন নিয়ে সর্বত্র আলোচনা। রিসিপশনে আসা-যাওয়া করা প্রত্যেকের মুখে মুখে ফিসফাস তিনিও টের পাচ্ছেন। তবে ঘণ্টাখানেক তাকে বসে থাকতে হয়েছে। সম্পাদক সাহেব ব্যস্ত দফায় দফায় বৈঠক নিয়ে।
যাই-হোক। অবশেষে বেলার ১টার পর সম্পাদকের রুমে ঢোকার সুযোগ মিললো।
দৈনিক সময়কালের সম্পাদকের নাম মোস্তফা খান। তার রুমটা খুব পরিপাটি। বিরাট আকারে একটা টেবিল। সামনে অনেক কাগজপত্র। ঠিক ডান পাশে ছোট্ট একটা টেবিল আছে। সেখানে একটা ম্যাক কম্পিউটার। বাম পাশে রয়েছে বিশাল একটি বুক শেলফ। বইয়ে বইয়ে ভরপুর। সম্পাদকের চেয়ার বরাবর দুটি টেলিভিশন ওপরে দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো। দুটোর স্ক্রিনই বেশ বড় হবে বলেই মনে হয়। সম্ভবত ৪২ ইঞ্চির টিভি। একটিতে অফিসের সিসি ক্যামেরার আউটপুট দেখা যাচ্ছে, অন্যটিতে একটি দেশি টিভি চ্যানেল চলছে।
সম্পাদক মোস্তফা খান বসে আছেন চেয়ারে। তার গড়ন খুব ছোটখাটো। উচ্চতায় কত হবেন? মনে হয় পাঁচ ফিট চার কিংবা পাঁচ ইঞ্চি। গায়ের রঙ শ্যামলা। স্বাস্থ্যও খুব ভালো নয়। আলিশান চেয়ারটায় ছোটখাটো একজন মানুষ বসে আছেন। বয়সও সম্ভবত ৬০ হবে বা তার বেশিও হতে পারে। যদিও গড়ন দেখে বয়স বোঝা মুশকিল।
সম্পাদকের হাতে সিগারেট। খুব টেনশনে আছেন বোঝাই যাচ্ছে। জোরে জোরে সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, বসেন, বসেন। খুব টেনশনে আছি। বিপদে পড়েছি তো। আর এজন্য আপনাকে দায়ীও করতে পারছি না। সম্পাদক তো আমি, দায়টা আমার। আমার উচিত ছিল আগে থেকে দেখা।
এত কথা একসঙ্গে শুনতে শুনতে জাফরুল্লাহ বসে গেলেন সামনের চেয়ারে।
মোস্তফা সাহেব তার সিগারেটের ছাই টোকা দিয়ে স্ট্রেতে ফেললেন। এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন? এমন একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন বিশ্বে বোধ হয় প্রথম। এটা নেওয়ার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের এখনো হয়নি। আপনি বুঝতে পারছেন বিষয়টা? সারাদিন ধরে ফোন রিসিভ করতে করতে আমি অস্থির হয়ে গেছি।
জাফরুল্লাহ প্রথমবারের মতো বললেন, কী ধরনের ঝামেলা? আমি কি জানতে পারি?
—হ্যাঁ হ্যাঁ। অবশ্যই। এটা তো জানাতেই হবে। সকালে আমাদের প্রকাশক ফোন দিয়েছিলেন। তিনি আপনার একটা রিটেন স্টেটমেন্ট চেয়েছেন। কেন এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিলেন? মূল উদ্দেশ্য কী?
জাফরুল্লাহ বিষয়টাতে কিছুটা বিস্মিত হলেও চোখেমুখে সে ভাবটা দেখালেন না।
—আমি তো মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞাপনেই দিয়েছি। এর বেশি কী বলবো?
—না না, তবু কিছু একটা দেন। প্রকাশক যেহেতু চেয়েছেন…
জাফরুল্লাহ পাল্টা প্রশ্ন করলেন—আপনাদের পত্রিকায় তো অনেক পণ্যের বিজ্ঞাপন দেন। যেমন ধারা যাক,ওই ক্রিম মাখলে ফর্সা হয়ে যাবেন কিংবা ওমুক দুধ খেলে শরীরের শক্তি বাড়বে, ওমুক তেলই সেরা। এসব ক্ষেত্রে কি আপনাদের কোনও পলিসি আছে?
—এটা কেমন কথা হলো ভাই? আপনি তো কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন দেননি।
—তা আমি দেইনি। কিন্তু আমার বিজ্ঞাপনটা স্ট্রেইট অ্যান্ড সিম্পল। কোনো জড়তা নেই। কোনো মিথ্যা কিংবা ভঙ্গিতা নেই।
সম্পাদকের সিগারেটটা শেষ পর্যায়ে। হুট করেই তিনি বললেন—আপনি সিগারেট খান?
জাফরুল্লাহ এক সময় সিগারেট খেতেন। তবে ছেড়ে দিয়েছেন বছর দুইয়েক হবে। সম্পাদক তার স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এজন্য সিগারেটের মাধ্যমে স্ট্রেস রিলিফ করার চেষ্টা করছেন। তবু কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। জাফরুল্লাহ নিজের প্রকাশ ভঙ্গিতে চিন্তার ভাঁজ না আনলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই চাপ অনুভব করছেন। তাই ভাবলেন, চাপ থেকে রিলিফের জন্য একটা সিগারেট ধরানো যেতেই পারে।
—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড তাহলে আপনার অফারটা আমি নিতে পারি।
মোস্তফা খান সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট থেকে একটা বেনসন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—না ঠিকাছে, টেক ইট ইজি। এমনিতে অফিসের ভেতরে আমি সিগারেট এলাউ করি না। আজ এত চাপবোধ করছি যে পারছি না। আমিও দুঃখিত। অফিসে সিগারেট ধরানোটা অনুচিত। যাইহোক, আপনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেটা ভ্যালিড। তবে আপনার বিজ্ঞাপনটাতে কী যেন ছিল?
এই বলে আজকের পত্রিকাটি তিনি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
প্রথমেই বড় করে লেখা—আপনি কি ধর্ষক? যদি ধর্ষক হয়ে থাকেন,তাহলে একটি গবেষণায় আপনার সাক্ষাৎকার নিতে আমি আগ্রহী। আপনার পরিচয় কখনো প্রকাশ করা হবে না¬। এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি। স্বেচ্ছায় ফোন দিয়ে একটি পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করুন। ফোন দিন। তারপর ফোন নম্বর দিয়ে বলেছেন ঠিক এক মাস পর ফোন দিতে। এটা কেমন বিজ্ঞাপন? আমি কখনো এমন বিজ্ঞাপন দেখিনি।
এবার জাফরুল্লাহ একটু মুচকি হাসলেন—আসলে আপনি হয়তো জানেন না, এমন বিজ্ঞাপন আগেও এসেছে।
—এই দেশে? অসম্ভব।
—না না। এই দেশে না। ১৯৭৬ সালে ক্লেরমন্ট গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটির একজন পিএইচডি গবেষক লস এঞ্জেলসের পত্রিকায় ঠিক এমনই একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। আমার আইডিয়াটা আসলে সেখান থেকেই নেওয়া।
কথাটা শুনে মনে হলো মোস্তফা খান অবাক হলেন। বললেন—আপনি কি পিএইচডি গবেষক?
—না পিএইচডি করিনি। তবে করবো বলে ভাবছি। তার আগে নিজে থেকেই একটা বড় গবেষণা করতে চাই।
মোস্তফা খান জিজ্ঞেস করলেন—আপনি কী করেন? শিক্ষকতা?
—হ্যাঁ, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। ক্যারিয়ার স্যাটেল করতে করতে পিএইচডি আর করা হয়নি। ভাবলাম, একটা বড় গবেষণা করে তারপর নিজেকে তৈরি করে নেই।
সম্পাদক মোস্তফা খান মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছেন। জাফরুল্লাহও বুঝতে পারছে বিষয়টা।
মোস্তফা খান শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমন বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়লো? সেটা কি জানতে পারি?
জাফরুল্লাহ তখন হেসে দিয়ে বললেন—অবশ্যই। আনডিটেকটেড রেপিস্টদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু গবেষণা হয়েছে। তবে আমাদের দেশে এমন কোনো কাজ হয়েছে কি না, সেটা এখনো জানি না। আমিও খুঁজে দেখছি। লিটারেচার রিভিউয়ের জন্য আমার সেই গবেষণাগুলো পাওয়া খুব প্রয়োজন। ধর্ষণ নিয়ে আমাদের কাছে যে পরিমাণ তথ্য আসে তা সংখ্যায় অনেক কম বলেই আমার মনে হয়। এজন্য আমি একটা সার্ভেও করেছিলাম। সার্ভেতে দেখলাম ধর্ষণ হওয়ার বিষয়টা অধিকাংশই স্বীকার করে না। পরে আরেকটা সার্ভে করলাম। সেখানে দেখার চেষ্টা করলাম নিজে ধর্ষক হওয়ার বিষয়ে কেউ স্বীকার করে কি না। তার ফলেও আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তাই ভাবলাম, যদি ফ্লোরটা উন্মুক্ত করে দিয়ে বলি, আপনারা কে ধর্ষক? এটাই আমার আনডিটেকটেড রেপিস্টদের ওপর গবেষণা করার আইডিয়া। অর্থাৎ যেসব ধর্ষণের কথা আমরা জানি না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে। আমি সেসব নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের ধর্ষক পরিচয়টা আমার কাছে রিভিল করে, তাহলে আমি তার মনোজগৎটা বোঝার চেষ্টা করবো। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করে দেখা যেতে পারে, এরা কেন ধর্ষণ করলো? একইসঙ্গে এদের মধ্যে কোনও অপরাধবোধ তৈরি হয়েছে কি না। অনেকের কাছে এটা একটা ট্রমাও। ধরা যাক, আপনি কাউকে ধর্ষণ করেছেন। কিন্তু আপনি ধর্ষক হওয়ার কথা না। তবু অপরাধটা আপনি করে ফেলেছেন। এই অপরাধ কেউ জানে না আপনি এবং ভিকটিম ছাড়া। ভিকটিও ওত শক্তিশালী নয় যে এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। শাস্তিও পেলেন না। কিন্তু আপনি বিরাট একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে আপনি কারও সঙ্গে আলাপও করতে পারছেন না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এমনও তো হতে পারে, আপনার একটা এক্সিট ডোর প্রয়োজন। অর্থাৎ আমি দেখবো, এই এক্সিট ডোরটা কেউ ব্যবহার করে কি না। আমার রিসার্চ অবজেকটিভ আপাতত এটাই। তবে ডাটা পেলে বোঝা যাবে আর কোনও অ্যাঙ্গেল বের হয় কি না।
মোস্তফা খান গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি মোটামুটি সন্তুষ্ট। গবেষণার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া কোনও অপরাধ নয়। তিনি বলেও ফেললেন—একসিলেন্ট আপনার গবেষণার বিষয়টা। যদিও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কাজটা কঠিন হবে।
জাফরুল্লাহও হেসে দিলেন। তিনি বললেন—অবশ্যই কঠিন হবে। আমি সহজ কোনো গবেষণা করতে চাইনি। চেয়েছি কঠিন কিছু করতে। যেন সত্যিকার অর্থে একটা সমাধানের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া যায়।
মোস্তফা খান তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করলেন—আপনার সব কথাই বুঝলাম। কিন্তু বিজ্ঞাপনে মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন এক মাস পর। কেন?
জাফরুল্লাহ’র পানির পিপাসা পেয়েছে—আমি কি এক গ্লাস পানি খেতে পারি?
মোস্তফা খান তখন একটু লজ্জা পেলেন—খুবই লজ্জার বিষয়। আপনাকে শুরুতেই চায়ের অফার দেওয়া উচিত ছিল।
—না না। এক গ্লাস পানি দিলেই হবে। কথাটা শেষ না করতেই মোস্তফা খান বেলে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন পিয়ন ঢুকলো রুমে। তাকে নাস্তা-পানি ও চা দিতে বললেন সম্পাদক।
মোস্তফা খান আবার তার প্রশ্নটা মনে করিয়ে দিতেই জফরুল্লাহ বললেন—ও হ্যাঁ। এখানে অনেক বিষয় আমি চিন্তা করেছি। প্রথমত, এই নম্বরে আজকে প্রচুর লোক ফোন দিয়ে শুধু গালিগালাজ করবে। আমি পাজেলড হয়ে যাব এসব গালিতে। দ্বিতীয়ত, প্রচুর অহেতুক ফোন আসতে পারে। যাদের ধর্ষণের গল্প আমি শুনতে চাই না, সেসবও শুনতে হবে। তৃতীয়ত, এক মাস পর পর্যন্ত যারা অপেক্ষা করে আমাকে ফোন দেবে– তারাই আমার টার্গেট স্যাম্পল।
—শুধু তারাই কেন?
—প্রত্যেকটা গবেষণার উদ্দেশ্য থাকে। আমার উদ্দেশ্য তো অব্যশ্যই কেস স্ট্যাডি করে একটা সমাপ্তিতে আসা। একই সঙ্গে একটা সমাধানে পৌঁছানো।
জফরুল্লাহকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। গোছানো উত্তর, গবেষণার টার্গেট, বিষয়—সবকিছুতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
—আমি আসলে সকাল থেকে খুব স্ট্রেসের মধ্যে যাচ্ছিলাম। এত ফোন পেয়েছি বলার বাইরে। তখন এত কিছু চিন্তা করিনি। আমাদের প্রকাশকও বিষয়টা ভালো মতো নেননি। তিনি তো বলেছেন, এমন একটি বিজ্ঞাপনের জন্য কালকের পত্রিকায় ক্ষমা চাইতে। একইসঙ্গে অনলাইনের ইপেপার থেকে বিজ্ঞাপনের অংশটুকু সরিয়ে দিতেও বলেছেন। এতে আপনার তো কোনও আপত্তি নেই নাকি? আপনি তো দুটির জন্যই পেমেন্ট দিয়েছেন।
রুমে তখন বিস্কিট চা পানি প্রবেশ করেছে। জাফরুল্লাহ গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানি খেলেন। মোস্তফা খান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জাফরুল্লাহ’র দিকে। জাফরুল্লাহ খুব ধীর স্থির। ধীরে ধীরে কথা বলেন। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। খুব পরিপাটি ব্যক্তিত্ব। উচ্চতায় ছয়ফুটের কাছাকাছি হবেন। হালকা সবুজ রঙের শার্ট আর প্যান্ট ইন করা। পায়ে কী পরেছেন তা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
জাফরুল্লাহ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন—আপনাদের অফিশিয়াল সিদ্ধান্তে আমার কিছু বলার নেই। আপনাকে যারা ফোন দিচ্ছেন তাদের মূল আপত্তিগুলো কি জানা যাবে?
—মানবাধিকারকর্মীরা ফোন দিচ্ছেন এখানে একটা সিকিউরিটি ইস্যু আছে। ধরেন আপনার ফোন যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ট্র্যাক করে। তারপর সেটা ধরে যারা আপনাকে ফোন দেবে তাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে তো বড় একটা ঝামেলা হতে পারে। যদি সঠিক অপরাধে কাউকে ধরে তাতে কোনো আপত্তি আমাদের নেই। কিন্তু সমস্যাটা বোঝেনই তো। টাকা পয়সার লেনদেন হতেও তো পারে। আর তাছাড়া কেউ আপনার গবেষণার স্যাম্পল হতে গিয়ে যদি নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যায়, সেটাও তো অনুচিত হবে। এছাড়া বাকিদেরটা সকালে খুব সিরিয়াস মনে হলেও এখন আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপন আগে কেউ দেখেনি তো। তাই।
জাফরুল্লাহ তখন দাঁড়িয়ে গেছেন। অনুমতি নিচ্ছেন চলে যাওয়ার—আমি তাহলে আজ যেতে পারি? যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ করবো। আপনি দয়া করে বিবেচনা করে দেখবেন।
মোস্তফা খান মাথা নেড়ে বলার ইঙ্গিত দিলেন।
—আপনাদের মার্কেটিংয়ের দুজনকে চাকরিচ্যুত করেছেন। তার মধ্যে যে ছেলেটা বিজ্ঞাপনটা এনেছে ও’র নাম মাসুদ। সম্ভবত আপনাদের সেলস এক্সিকিউটিভ। ছেলেটার বয়স কম। আমাকে আজ ফোন দিয়ে অঝোরে কাঁদছিল। তার গতকাল রাতে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। আমার অনুরোধ ছেলেটাকে চাকরিতে ফিরিয়ে নেবেন। সে কোনো অপরাধ করেনি। এমনকি মার্কেটিং বিভাগের প্রধানও কোনো অপরাধ করেননি। দু’জনের চাকরির বিষয়টা যদি পুনর্বিবেচনা করে দেখেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
মোস্তফা খানের প্রতিষ্ঠানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা এবং তাকে চাকরিতে বহাল রাখার সম্পূর্ণ ক্ষমতা তার নিজস্ব। চাইলেই তাদের চাকরিতে বহাল করতে পারেন। কিন্তু এখন বিষয়টাতে প্রকাশক জড়িয়ে গেছেন। তবু মাসুদের সন্তান হয়েছে শুনে তার মনটা নরম হয়ে গেলো। এমন একটা দিনে চাকরি হারানোর বেদনা অনেক। এটা আনন্দের দিন।
এসব ভাবতেই আবার তিনি বেলে চাপ দিলেন। পিয়ন ছেলেটা এলো। তাকে বলা হলো মাসুদের নম্বরটা নিয়ে আসতে।
এবার মোস্তফা খানও দাঁড়িয়ে গেলেন—আপনার বিজ্ঞাপন ইপেপার থেকে সরবে না। প্রকাশক ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। ভালো মতো গবেষণা করে অবশ্যই আমাকে জানাবেন।
জাফরুল্লাহ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন জাফরুল্লাহ।
তার যাওয়ার পর মোস্তফা খান ফোন দিলেন মাসুদকে—মাসুদ তোমার চাকরিচ্যুত বিষয়টা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। তবে ১৫ দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি নাও। আর হ্যাঁ, তোমাকে শুভেচ্ছা, তুমি বাবা হয়েছো। মা-মেয়ের যত্ন নেবে।
ওপারে মাসুদ হতবিহবল হয়ে শুনছিল। শুধু বলল—ধন্যবাদ স্যার।
সম্ভবত ছেলেটা কাঁদছিল। এটা আন্দাজ করেছেন মোস্তফা খান। তবে একাজটা করে তিনি খুব স্ট্রেস ফ্রি অনুভব করছেন। তার হঠাৎ ভালো লাগাও শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর কারও সঙ্গে এত ডিটেইলে তিনি আলাপ করেছেন। সম্পাদক হওয়ার পর প্রশাসনিক কাজে তিনি এত ব্যস্ত থাকেন যে, সাংবাদিকতাই করা হয় না। তিনি ভাবলেন, এই ইস্যুটা নিয়ে ভালো একটা কলাম লেখা যেতে পারে।
দুই.
এক মাস পর মোবাইল অন করার সঙ্গে সঙ্গে পনেরোটা ফোনকল রিসিভ করা হয়ে গেছে জাফরুল্লাহ’র। প্রথম ফোনটা করেছিল একটা ছেলে। বয়স বললো, ষোলো।
মোটামুটি অনেক ছোট। তার কণ্ঠ শুনে রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ।
জাফরুল্লাহকে আংকেল বলে ডাকছিল। গবেষণার সততা অনুযায়ী কাউকেই জাফরুল্লাহ নাম জিজ্ঞেস করেননি। এমনকি কোথা থেকে ফোন করেছে, সেটাও জিজ্ঞেস করেননি। তবে পরে মনে হলো, এটা রাখলে ভালো হতো। এরিয়া ভেদে সাইকোল্যাজিক্যাল স্ট্যান্ডটা ডিফাইন করা যেতো। অর্থাৎ আরবান-রুরাল আলাদা করা যেতো। যাই-হোক, যেহেতু আইডিয়াটা পরে এসেছে, তাই এ নিয়ে আর ভাবলেন না।
ছেলেটার গল্পই বলা যাক। ছেলেটা তাদের বাসার গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করেছে বলে জাফরুল্লাহকে জানিয়েছে। জাফরুল্লাহ তাকে প্রশ্ন করেছে, কেন করলেন এ কাজটা?
ছেলেটা উত্তরে বললো–স্কুলে তার বন্ধুরা সেক্স নিয়ে অনেক আলাপ করে। এটা থেকে তার মধ্যে একটা কিউরিসিটি তৈরি হয়। সেক্স নিয়ে মোবাইলে ইউটিউবে সে বেশ কয়েকটা ভিডিও দেখে ফেলে। এরপর সে কিউরিসিটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তার বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে। একদিন সুযোগ পেয়ে সে জোর করে গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করে।
জাফরুল্লাহ তার কথা শুনে নির্বাক হয়ে পড়েন। এতটুকু বাচ্চা ছেলে বলে কী!
—আপনাদের গৃহকর্মীর বয়স কত?
—জি, আমার মতোই হবে।
আরও জানতে চাইলেন—বাসার কেউ বিষয়টা জানে কি না!
ছেলেটা তখন বলে—সেদিনই মেয়েটা আম্মুকে বলে দিয়েছিল। আম্মু সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিছু টাকা দিয়ে আর না আসার জন্য বলে দেয়।
জাফরুল্লাহ কতদিন আগের ঘটনা সেটা জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটা বলল—এই তো দুই আড়াই মাস হবে।
ফোনটা রেখে জাফরুল্লাহ বিষয়টা নোট করলেন।
এখানে বেশকিছু বিষয় আছে। বন্ধুদের মধ্যে আলাপ কিউরিসিটি উসকে যায়। সেখান থেকে অপরাধ করার প্রবণতা তৈরি হয়। ইন্টারনেট অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি একটা বিগ ফ্যাক্টর। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, একজন নারী আরেকজন নারীকে টাকা দিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে দিলেন।
তবু ছেলেটার কণ্ঠ মনে করার চেষ্টা করছেন জাফরুল্লাহ। ষোলো বছরের একটা ছেলে ফোন দিয়ে তার ধর্ষক হওয়ার কথা বললো কী অবলীলায়। এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবু হলো তো!
ছেলেটা এক মাস অপেক্ষা করেছে তার অভিজ্ঞতা বলার জন্য। যেখানে এ বিষয়টা ভয়েই তার চেপে যাওয়ার কথা।
এখন পর্যন্ত একটি কেসই তার কাছে ভিন্ন স্ট্যাডি করার মতো মনে হয়েছে। বাদবাকি গল্পগুলো প্রায়ই পত্রিকার পাতায় আসে। একজন ফোন দিয়ে বলেছেন, তিনি তার শালীকে ধর্ষণ করেছেন। আবার একজন ফোন দিয়ে বললেন, প্রেমিকাকে ধর্ষণ করেছে।
কেন করলেন এমন কাজ? এই প্রশ্নটা সবাইকেই তিনি করেছেন। সবার উত্তরই কাছাকাছি ছিল। যেমন, রাগে করেছি, হঠাৎ সেক্স করতে ইচ্ছে হলো, ভালো লাগতো কিন্তু পাত্তা দিতো না তাই করেছি, নিজেকে আটকাতে পারিনি, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হতো তাই রাগ দেখাতে গিয়ে আরেকজনকে ধর্ষণ করেছি–সবই এ ধরনের উত্তর।
এগুলোকে তিনি আলাদা করছেন। কারণ এরা আনডিটেকটেড রেপিস্ট। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে আইনত কোনো অভিযোগ আসেনি। আরেকটা বিষয় খুব লক্ষণীয়, এদের অধিকাংশের অপরাধবোধ নেই। তারা অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। যেমন, শালীকে যে ধর্ষণ করেছে, সে দাবি করছে তার শালীই তাকে প্রোভোক করেছে। কিংবা এক ছেলে বলল, আমি ওই মেয়েটাকে এত ভালোবাসতাম, সে কেন বাসতো না? তাই শিক্ষা দিতে ধর্ষণ করেছি। অর্থাৎ এরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। নারীদের এরা শিক্ষা দিতে চায়। তাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ধর্ষণ করতে চায়। কী অদ্ভুত! এই সমাজ একটা অসুস্থ সমাজ।
তবে তিনি কাঙ্ক্ষিত ফোনকল এখনো পাননি। এসব ভাবতে ভাবতেই ১৬ নম্বর ফোনটি এলো একজন পুরুষের। বয়স ৩৩।
নাম জিজ্ঞেস করা হবে না। এমনকি স্থানও। লোকটি ফোন দিয়ে ধীর কণ্ঠে কথা বলা শুরু করলেন।
লোকটি প্রথমেই গবেষণার উদ্দেশ্যটা জানতে চাইলেন। এই প্রশ্ন এবারই প্রথম কেউ করলেন। আগে কেউ করেননি। জাফরুল্লাহ বিস্তারিত বললেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা অত্যন্ত শিক্ষিত।
তিনি নিজ থেকেই বললেন—খুব ভালো গবেষণা। এমন কাজ হওয়া উচিত। এজন্যই নিজের অভিজ্ঞতা বলতে আপনাকে ফোন দিয়েছি।
জাফরুল্লাহ মোবাইলটা কানে দিয়েই বললেন—আপনাকে ধন্যবাদ। বলুন। আমি শুনছি।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, সে সুবাদে আমরা থাকতাম কলোনিতে। আমাদের কলোনিতে সবার সঙ্গে সবার খুব আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আসা-যাওয়াও ছিল। আমাদের দুই তিন বাসা পরে ছিল আব্দুল আংকেলের বাসা। তার স্ত্রীর ছোটবোন ডাক্তারি পড়তো। একবার এক ছুটিতে তিনি লম্বা সময় ওই বাসাতে ছিলেন। আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। বায়োলজিতে ছিলাম খুব উইক। পড়তেই চাইতাম না। একদিন আম্মা আব্দুল আংকেলদের বাসায় গিয়ে ওই আন্টিকে বললেন, তুমি যেহেতু ডাক্তারি পড়ো, তো আমার ছেলেটাকে কয়দিন বায়োলজি দেখিয়ে দেবে? খুব ভালো হয়।
রেহনুমা ছিল ওনার নাম। তো রেহনুমা আন্টি নিয়মিত আমাদের বাসায় এসে আমাকে বায়োলজি পড়াতেন। আন্টি অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। সবসময় সেলোয়ার কামিজ পরতেন ও কপালে মোটা টিপ লাগাতেন। দেখতে খুব আকর্ষণীয় ছিলেন। আমাকে খুব সুন্দর করে পড়াতেন, বোঝাতেনও ভালো। বায়োলজি পড়তে পড়তে আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্কও হয়ে গেলো। বন্ধুর মতো সম্পর্ক। আমার ব্যক্তিগত অনেক কথা আন্টির সঙ্গে শেয়ার করতাম। আন্টিও তার ব্যক্তিগত অনেক কিছু আমার সঙ্গে বলতেন। আমার তখন কিছুই ভালো লাগতো না। সারাদিন আন্টির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হতো। আন্টিও সময় পেলেই আমাদের বাসায় চলে আসতেন, হয় পড়াতেন না হয় গল্প করতেন।
দেখা গেলো গল্প করতে করতেই আন্টি আমার পিঠে হাত দিলেন। আমি ভেতরে ভেতরে তখন অসম্ভব শিহরণ অনুভব করতাম। কখনো কখনো তিনি আদর করে আমার গালে চুমুও দিতেন। বিষয়টা আমার ভেতর অন্যরকম শিহরণ জাগাতো। এখন বুঝি ওই বয়সটা খুব খারাপ। খুব সহজে ফ্যাসিনেশন তৈরি হয়।
এতটুকু বলেই লোকটা চুপ করে রইলেন। জাফরুল্লাহ বুঝতে পারছেন, লোকটি কাঁদছেন। নীরব কান্না। আর কোনও কথা বলতে পারছেন না।
তবু জাফরুল্লাহ বললেন—আপনি বলতে না চাইলে আর বলবেন না। বিষয়টা একদমই আপনার ইচ্ছের ভেতর।
লোকটি তখন নাক টান দিতে দিতে বললেন—না না। আই শুড গিভ ইউ দ্য ফুল স্টোরি। একটা মানুষ কতদিন একটা গল্প চাপা দিয়ে রাখতে পারে? অনেক বছর হলো এখনো আমি বিষয়টা ভুলতে পারি না।
জাফরুল্লাহ চুপ করে শুনছেন।
—একদিন খবর এলো আমাদের এক আত্মীয় ভীষণ অসুস্থ। তখন আম্মা যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, উনি যাওয়ার সময় রেহনুমা আন্টিকে আমাদের বাসায় কিছু সময় থাকতে বলবেন। আম্মা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই রেহনুমা আন্টি বাসায় এলেন। তখন দুপুরবেলা ছিল। হঠাৎ করে মেঘ কালো করে বৃষ্টি এলো। ওপরে টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ। দুপুরে প্রচণ্ড ঘুমও আসছিল আমার। আমি রেহনুমা আন্টিকে বললাম, আন্টি আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো। আন্টিও বললেন, ঠিকাছে ঘুমাও।
আমি গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম রেহনুমা আন্টিও একই বিছানার এক পাশে বসে বসে বই পড়ছেন। হঠাৎ করে আমার যেন কী হলো। আমি ওনার হাত ধরে টান দিলাম। অ্যান্ড…অ্যান্ড…আফটার দ্যাট…
বলেই লোকটি অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে থাকলেন, আই রেইপড হার, আই রেইপড হার।
বেশ কিছুক্ষণ শুধু কান্নার আওয়াজই পাচ্ছিলেন জাফরুল্লাহ। অনেকক্ষণ পর জাফরুল্লাহ প্রশ্ন করলেন—এরপর?
লোকটি কাঁদতে কাঁদতেই বললেন—এরপরের দিন তিনি তার কলেজে চলে গেলেন। আর কখনো দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আন্টির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই। কিন্তু পারি না। সাহসে কুলায় না। আপনি জানেন আমি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছে, মরে গেলেই কি সমাধান হয়?
জাফরুল্লাহ একটু শক্ত হয়ে বললেন—আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। তবে বলবো, আপনি আপনার আন্টির কাছে যান। তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন।
সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটি কেটে দিলেন। জাফরুল্লাহ দীর্ঘ সময় শুধু লোকটির গল্প নিয়েই ভাবতে থাকলেন। মনে মনে বললেন, ১৬টি ফোন কলের মধ্যে ২টি কেস ব্যতিক্রম হয়েছে। প্রথমটা হলো বাচ্চা ছেলে মাত্র দুই মাস আগের ঘটনা বলে দিয়েছে। তার বিষয় অস্বাভাবিক। আর দ্বিতীয় কেসটাও বলতে গেলে শিশু বয়সের। গল্পটা অনেক বছর আগের। অর্থাৎ ক্লাস নাইনের একটা ছেলের বয়স এখন ৩৩ হয়েছে। তারটাও ভিন্ন এই কারণে যে তিনি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছেন।
এই অপরাধবোধ তিনি প্রথমবার দেখতে পেলেন। অর্থাৎ ধর্ষণ করার পর একজন ধর্ষক দীর্ঘসময় ধরে ট্রমার মধ্যে আছে। তার গবেষণার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো এক্সিটডোর ওপেন করা। অর্থাৎ সেই এক্সিটডোর একজন ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হলো তার।
যাই-হোক, জাফরুল্লাহ’র টাইমফ্রেম ছিল সাত দিন। এই সাতদিনের মধ্যে তিনি স্যাম্পল নেবেন। এরপর আবার ফোন বন্ধ করে দেবেন। শেষ দিন পর্যন্ত ফোনকল পেয়েছেন ৩৯টি। কিন্তু ব্যতিক্রম স্যাম্পল পাচ্ছেন না। তবু মোট ১০টি ভিন্ন কেস আইডেনটিফাই করেছেন। শেষদিন যখন সিদ্ধান্ত নিলেন ফোনটা বন্ধ করবেন ঠিক ওই সময়েই ফোনটা বেজে উঠলো। একবার ভাবলেন কলটা ধরবেন না। পরে মনে মনে বললেন, ঠিক আছে,শেষ স্যাম্পল।
ফোনটা ধরতেই আকাশ ভেঙে পড়লো জাফরুল্লাহ’র। কণ্ঠটা একজন নারীর। খুব ভরাট কণ্ঠ। কণ্ঠটা শুরুতে একটু কাঁপছিল। সম্বোধন করছিল, মিস্টার জাফরুল্লাহ বলে।
জাফরুল্লাহও ব্যক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠের কারণে ম্যাডাম সম্বোধন করা শুরু করলেন। বললেন—বলুন ম্যাডাম। প্লিজ শেয়ার ইওর স্টোরি। আমি নোট নিচ্ছি। শুরুতে আপনার বয়সটা বলে নেবেন দয়া করে। আর কোনও ব্যক্তিগত তথ্য না দিলেও হবে।
—আইএম থার্টি এইট। বয়স আটত্রিশ বছর। আসলে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। অস্বস্তি লাগছে।
জাফরুল্লাহ এবার তাকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য বললেন—টেক ইওর টাইম ম্যাডাম। আপনি সময় নিন। যদি বেশি অস্বস্তি বোধ করেন, তাহলে বলারও দরকার নেই।
—নো নো ইটস ওকে। বলছি। আসলে আই এম অ্যা ডক্টর। আমি যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ি তখন আমার বোনের বাসায় গিয়েছিলাম ছুটিতে। তার হাজবেন্ড সরকারি চাকরি করতেন। সো দে’ লিভড ইন গভর্মেন্ট কলোনি। সেখানে দুলা ভাইয়ের একজন কলিগের ছেলে স্কুলে পড়তো। তার মা একদিন আমাকে এসে বললেন, যেহেতু আমি ডাক্তারি পড়ছি সেহেতু তার ছেলেকে যেন একটু বায়োলজি দেখিয়ে দেই। আই টুক দ্যাট অফার। কারণ বাসায় সারাদিন বোর হতাম। ভাবলাম, বায়োলজি পড়াতেও দোষ কোথায়? দ্য কিড ওয়াজ সো কিউট অ্যান্ড ফ্রেন্ডলি। আমি তাকে পড়াতাম। হি ওয়াজ সো ব্রিলিয়ান্ট। খুব চট করে ধরে ফেলতো পড়া। তবে একটু ফাঁকিবাজ ছিল। আমি দেখলাম ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো করে মিশে পড়া আদায় করা যাবে। তাই সেভাবে পড়াতাম। অনেক গল্প করতাম। ছুটিটা ছিল আমার দুই মাসের। তার মধ্যে ২০-২৫ দিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। ওর সঙ্গে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমার যতটুকু মনে হতো সেও নিশ্চয়ই পছন্দ করতো। তবে দ্য প্রবলেম ইজ একটা কম বয়সী ছেলে আমাকে সব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমি যা বলি তা শুনছে। যখনই আমার গল্প করতে ইচ্ছে হি ওয়াজ দেয়ার ফর মি–এ বিষয়গুলো আমার খুব ভালো লাগতো। হোয়েন আই টাচড হিম আই ফিলড সো এক্সাইটেড। এটা আগে কখনো আমার হয়নি। আমার অনেক হতাশার কথাও ওর সঙ্গে শেয়ার করতাম। কখনো কখনো কেঁদেও দিতাম। সে তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। আমার খুব ভালো লাগতো। আমি ইচ্ছে করেই আমার শরীরের সঙ্গে তার শরীরের স্পর্শ করাতাম। বিকজ আমি খুব প্লেইজার ফিল করতাম। আমি তাকে প্রায়ই গালে চুমু দিতাম। আমিও হয়তো তার কাছ থেকেও কিছু ফিডব্যাক চাইতাম। কিন্তু তেমন কিছু ফিরতি আসতো না। আমিও তার স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাবোধ করতাম। দেখা যেত বিষয়গুলো একপাক্ষিক হতো। কখনো কখনো রাগও হতো। একদিন তার বাবা-মা বাসায় ছিল না। সম্ভবত তাদের কোনও আত্মীয় অসুস্থ ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার আগে আমাকে বললেন–তাদের বাসায় গিয়ে রকির সঙ্গে থাকতে। কারণ সে একা। কলোনিতে প্রচুর চুরি হতো তখন। বিশেষ করে দুপুর ও রাতে চোরের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। এজন্য আমার বোনও বললো, ঠিক আছে গিয়ে কিছুক্ষণ রকির সঙ্গে থেকে আয়। আমি যখন যাই তার কিছুক্ষণ পর অসম্ভব বৃষ্টি শুরু হলো। আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড দ্যাট টাইম। এমন ঘন কালো হয়ে পড়া প্রকৃতি শরীরেও যে শিহরণ জাগাতে পারে সেটা সেদিন আমি অনুভব করি। ইন দ্য মিন টাইম রকি ঘুমাচ্ছিল। আমি তার পাশে গিয়ে বসে বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে আটকে রাখছিলাম। হঠাৎ দেখলাম রকি টাচড মাই হ্যান্ড। দ্যান…’
ঠিক একইভাবে কান্নার শব্দ। জাফরুল্লাহ নীরব হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন। আর ভাবছিলেন এটাই তো তার সেই কাঙ্ক্ষিত ফোনকল। দুটি কেসকে পাশাপাশি রেখে স্ট্যাডি করা যাবে। দুজনই ভিকটিম ও একই সঙ্গে নিপীড়ক। হয়তো! কিংবা দুজনের কনসেন্টেই কাজটা হয়েছে। কিন্তু এরা বুঝতে পারছে না। ফলে এক দীর্ঘ ট্রমায় আছে। এটাও দেখতে হবে ভালো মতো।
কিন্তু নারী কণ্ঠ থেকে আর কোনো শব্দ ভেসে আসছে না।
জাফরুল্লাহ তবু বললেন, এখানে আপনার দোষ কোথায়? এটা তো তাহলে দুই পক্ষের কনসেন্ট ছিল বলে মনে হচ্ছে।
—নো নো। ইটস নট। আই প্রভোকড হিম। আমি তাকে প্রভোক করেছি। অবশ্যই এটা ধর্ষণের মতোই ঘটনা। প্রভোকেশনও কাইন্ড অব ক্রাইম। আমি বছরের পর বছর অপরাধবোধে ভুগছি। প্রায় রাতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি রকিকে স্বপ্ন দেখি। দেখি সে উন্মাদ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলছে, ইউ প্রভোকড মি। ইউ প্রভোকড মি। আমি এখনো সেই কলোনিতে আটকে আছি। রিলিফ হতে পারছিলাম না। আমি কারও সঙ্গে এই ঘটনা শেয়ার করতে পারিনি। কার সঙ্গে করবো? কে বুঝবে আমাকে? কেউ তো এটা বুঝবে না। আই ডিড ক্রাইম উইথ দ্যাট কিড। হয়তো এখনো সে আমাকে ক্ষমা করেনি। হয়তো এজন্যই আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না। আমার হাজব্যান্ডও প্রায়ই বলে, আমি নাকি ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ি। আমি নাকি ঘুমের মধ্যে রকি’র নাম বলে চিৎকার করি। হু ইজ রকি? এই প্রশ্ন বহুবার করেছে। আমি তাকেও বলতে পারিনি।
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই লাইনটা কেটে যায়।
জাফরুল্লাহ আর ফিরতি ফোন দেননি। এছাড়া ফোনও আসেনি আর। তবে জাফরুল্লাহ এক অদ্ভুত উন্মাদনায় পড়ে যান। এখানে কে ধর্ষক আর কে ভিকটিম? ছেলেটা ভাবছে সে ধর্ষক, মেয়েটা ভাবছে সে ধর্ষক। এভাবেই জাফরুল্লাহ’র আনডিটেকটেড রেপিস্ট গবেষণার জন্য চমৎকার স্যাম্পল পেয়ে যায়। চালিয়ে যায় তার গবেষণা। স্যাম্পাল সাইজ ১১ জনে এসে ঠেকেছে। আর রকি ও রেহনুমার কেসটার জন্য সে আলাদা চ্যাপ্টার ভেবে রেখেছে। যার নাম দেবে ‘হু ইজ রেপিস্ট?’
তিন.
এই ঘটনার প্রায় তিন চারবছর পর ডাক্তার দেখানোর জন্য দৈনিক সময়কালের সম্পাদক মোস্তফা খান ভারত যাবেন। ফ্লাইটে তিনিই শেষ যাত্রী। রাস্তার ট্রাফিকে আটকে থেকে দৌড়ে ইমিগ্রেশন ক্রস করে বিমান পর্যন্ত পৌঁছেছেন সবার শেষে। তিন সিটের মাঝের সিটটা তার। মাঝে বসেই জানালার পাশে বসা লোকটাকে দেখে চেনা চেনা লাগলো।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই লোকটি নিজ থেকেই বললো—কেমন আছেন মোস্তফা ভাই? চিনতে পেরেছেন? আমি জাফরুল্লাহ।
মোস্তফা খান হেসে দিয়ে বললেন—আরে ভাই আপনাকে কি ভোলা যায় নাকি? আমার অফিস একদিনের জন্য কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
তারপর দুজনই হেসে দিলেন। এরপর নানান বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। জাফরুল্লাহ জানালেন তিনি পরিবার নিয়ে চেন্নাই যাচ্ছেন। পেছনের সিটেই রয়েছে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান।
মোস্তফা খান আগ বাড়িয়ে সেই আগের গবেষণার কথা জিজ্ঞেস করে বললেন—কী অবস্থা? গবেষণাটা হয়েছিল? পিএইচডি অ্যাডমিশন নিয়েছেন?
জাফরুল্লাহ হেসে দিলেন—নট ইয়েট। গবেষণাটার মাত্র ৪০ ভাগ শেষ করেছি।
মোস্তফা খান অবাক হয়ে বললেন—এটা কেমন কথা? মাত্র ৪০ ভাগ? তারমানে পিএইচডিতে এখনো ভর্তি হননি? বুড়ো হয়ে যাবেন তো। হা হা হা।
—তা তো হয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে আগে এই কাজটা শেষ করতে হবে। তার আগে সম্ভব হবে না। হয়তো পিএইচডি করাই হবে না।
মোস্তফা খান এরপর ফোনকল পেয়েছিলেন কি না সেসব নিয়ে আলাপ শুরু করলেন।
জাফরুল্লাহ বললেন—অসংখ্য পেয়েছি।
এরপর বেশ কয়েকটা কেস নিয়ে গল্প শুরু করে দিলেন দুজন। সেই আলাপে রকি-রেহনুমার প্রসঙ্গও চলে এলো। তারা পুরোটা যাত্রা পথেই এসব নিয়ে আলাপ করতে থাকলেন।
মোস্তফা খান বললেন—বিষয়টা চমৎকার। দুজনই নিজেকে মনে করছেন রেপিস্ট। দুজনেই মনে করছেন অন্যজন ভিকটিম। দুজনই দুজনের ভিন্ন জায়গা থেকে আপনাকে গল্প বলেছেন। আপনার তো অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো।
—তা ঠিকই বলেছেন।
—কিন্তু আপনি তাদের সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করতে পারতেন। তাদের ট্রমা থেকে রিলিজ দিতে পারতেন।
জাফরুল্লাহ হেসে দিয়ে বললেন—না, না। আমি তো সোশ্যাল সার্ভিস করতে আসিনি। আমার কাজ তথ্য নেওয়া। আর ওই যে বলেছিলাম না? একটা এক্সিট ডোরও হচ্ছে এই গবেষণা। কেউ নিজের কথা বলে এক্সিটডোরটা ব্যবহার করতে চায় নাকি। তো এখানে দেখবেন রকি ও রেহনুমা দুজনই এক্সিট ডোরটা ব্যবহার করেছেন। আর তাছাড়া আপনারা সাংবাদিকরা যেমন কাউকে পেটাতে গেলে বাঁচাবেন না। ছবি তুলবেন। ঠিক তেমনি আমি শুনলাম। এই হলো কাজ। হা হা হা হা।
মোস্তফা খানও কথাটা শুনে হেসে যাচ্ছেন।
মোস্তফা খান জিজ্ঞেস করলেন—এছাড়া গবেষণাটা করতে গিয়ে আপনার কী কী মনে হলো?
—মনে হলো মেথডটা আরও ডিফাইন হলে ভালো হতো। যেমন, আমি বয়স রেখেছি কিন্তু তাদের স্থান ও পেশা রাখিনি। এটা আমাকে ভোগাচ্ছে। এটা রাখলে আমি একটা ক্লাসকে ডিফাইন করতে পারতাম। যদিও আমি ধরে নিতে পারি এরা শিক্ষিত শ্রেণী। কারণ পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে এক মাস অপেক্ষা করা চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়া আমি ইন-ডেপথ ইন্টারভিউ টার্গেট করিনি। জাস্ট গিভ দেম স্পেস টু টেল দেয়ার স্টোরি। এতে করে অধিকাংশই কোনোমতে গল্প বলেই ফোনলাইনটা কেটে দিয়েছে। আর আমার কাছে এখন মনে হয় ফলোআপ ইন্টারভিউ করলে আরও ভালো হতো। স্টোরিগুলোর সত্যতা যাচাই করা যেতো। অনেকে তো বানিয়ে বানিয়েও বলতে পারে!
—তারমানে কোনো সমাধান কি আসবে গবেষণা থেকে?
—সমাধান কী হতে পারে, এখনো জানি না। তবে ফাইন্ডিংস তো অবশ্যই থাকবে। রকি ও রেহনুমার কেসে কিন্তু একটা ফাইন্ডিংস আছে। যখন কেউ দীর্ঘ ট্রমার মধ্যে থাকে এবং ক্রমাগত অপরাধবোধে ভুগতে থাকে, তখন সে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না। যেমন, দুজনই কিন্তু দুজনের নাম অবচেতন মনে বলে দিয়েছে। অন্য কেউ কিন্তু এই ভুলটা করেনি। তারা করেছে। আর সমাধান কী হবে জানি না। আমাদের দেশে সমাধান তো মাথাব্যথা হলে মাথা ফেলে দাও। আশা রাখি তেমন কিছু সমাধান দেব না।
—একটা উদাহরণ দেন তো। বুঝিনি।
—এই ধরেন, আমাদের এখন সবাই বলে থাকেন, বাচ্চাদের হাতে মোবাইলফোন দেবেন না। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেবেন না। ওই যে ষোলো বছরের ছেলেটা কিন্তু সেক্স নিয়ে প্রভোকড হয়েছে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করেই। কিন্তু এর জন্য আমাদের অন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য তাদের মোবাইল ও ইন্টারনেট বঞ্চিত করার পক্ষে আমি নই। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো, মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট হলো এযুগের আবিষ্কার। সুতরাং যুগ অনুযায়ী সে সেটা অবশ্যই পাবে। আমাদের উচিত কনটেন্ট বানানো। সেক্স এডুকেশন নিয়ে কনটেন্ট। সেটা না করে আমরা মাইক বাজিয়ে বলছি, বাচ্চাদের হাতে মোবাইলফোন দেবেন না। আমি মনে করি, অবশ্যই দেওয়া উচিত। সে যদি ভালো কনটেন্ট পায়, শিক্ষণীয় কনটেন্ট পায় দেখার মতো সে অবশ্যই দেখবে। তবে অধিকমাত্রায় যেন ব্যবহার না করে সেসব নিয়ে সচেতনতা বাবা-মা এমনকি বাচ্চাদের মধ্যেও তৈরি করতে হবে। এই সচেতনতা নিয়েও বাচ্চাদের জন্য কনটেন্ট তৈরি করা উচিত।
মোস্তফা খান শেষে জিজ্ঞেস করলেন—আপনিও চেন্নাই কেন এলেন সেটা তো জানা হলো না।
জাফরুল্লাহ বললেন—আমার স্ত্রী একটা কনফারেন্সে এসেছেন। তাই ভাবলাম এক ফাঁকে চেন্নাই শহরটা ঘুরেও যাই। এজন্যই পরিবার নিয়ে আসা।
চেন্নাই এয়ারপোর্ট অসাধারণ সুন্দর। ভারতের অনন্য সুন্দর এয়ারপোর্টগুলোর একটি। চারিদিকে কাচের দেয়াল। উজ্জল আলোয় ভরপুর। মানুষগুলোকে দেখলে বাংলাদেশিদের মতোই মনে হবে।
যাই-হোক, ইমিগ্রেশন ক্রস করে মোস্তফা খান ও জাফরুল্লাহ’র পরিবার লাগেজের জন্য বেল্টের কাছাকাছি গেলো। লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জাফরুল্লাহ তার স্ত্রীকে ডেকে মোস্তফা খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
মোস্তফা খান বললেন—ভাবী একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে সংসার করছেন। আপনাকে স্যাল্যুট।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে দিলো।
মোস্তফা খান জিজ্ঞেস করলেন—ভাবী কোথায় চাকরি করছেন?
জাফরুল্লাহ’র স্ত্রী ব্যাগ থেকে নিজের একটা ভিডিটিং কার্ড বের করে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন—আমি ডাক্তার। মেডিসিনের। আপনি যখন চান চেম্বারে চলে আসবেন ফোন দিয়ে। ভারতের থেকে ভালো ট্রিটমেন্ট করবো।
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার সবাই হেসে দিলো। এই ফাঁকে বেল্ট চালু হয়ে গেলে সবার লাগেজ আসা শুরু করলো। মোস্তফা খানের লাগেজ তখনো আসেনি। তবে জাফরুল্লাহ’রটা চলে এসেছে। জাফরুল্লাহ খেয়াল করলেন, মোস্তফা খান সাইডে বসে একটা কাগজে কী কী যেন লিখছেন।
জাফরুল্লাহ এগিয়ে গিয়ে বললেন—মোস্তফা ভাই কিভাবে যাবেন? আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে বাইরে। চাইলে নামিয়ে দিয়ে আসি?
মোস্তফা খান বললেন—না না। আমি অ্যাপোলোতে দেখাবো তো। ওরা ইন্টারন্যাশনাল পেশেন্টদের কম্পলিমেন্টারি পিক করে। ওদের ট্যাক্সি থাকবে বাইরে। আমি চলে যাবো। ভালো থাকুন।
দুজনেই হাত মেলালেন। তখনই একটা খাম জাফরুল্লাহ’র দিকে এগিয়ে দিলেন মোস্তফা খান।
‘এটা কী?’ জিজ্ঞেস করেন জাফরুল্লাহ।
–ভেতরে একটা নোট আছে। আপনার গবেষণায় কাজে দিতে পারে।
এরপর চলে আসেন জাফরুল্লাহ। বের হয়ে নিজেদের গাড়িতে উঠে বসেন। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে ক্লাস জাফরুল্লাহ। কথার ঘোরে পানিও খাওয়া হয়নি। কিছুটা মাথাও ঝিমঝিম করছে। ইচ্ছে করছে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেয়ে একটা সিগারেট ধরাতে। এই অভ্যাস তিনি ত্যাগ করেছেন বহুদিন হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রায়ই এই নেশাটা তাকে পেয়ে বসে। চেষ্টা করেন আটকে রাখতে। ভাবলেন, এই নেশা এখনও আটকাতে হবে। অন্য কোনও চিন্তায় বুঁদ হয়ে যেতে চাইছেন।
ভাবলেন, মোস্তফা খান তাকে একটা খাম দিয়েছেন। সেটার দিকে নজর দিলে ভাবনাটা হয়তো বদলে যাবে। পকেট থেকে খামটা বের করে দেখলেন ভেতরে একটা চিঠি। সম্ভবত এটা তিনি এয়ারপোর্টে বসেই লিখেছেন।
প্রিয় জাফরুল্লাহ সাহেব,
আপনার সঙ্গে প্লেনের পুরো সময়টা অসাধারণ কাটলো। আপনার গবেষণার গল্পটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মানুষ কত ধরনের, কতভাবে চিন্তা করে। মানুষের জীবনের গভীরের গল্পটা কত আবেদনময়ী। কত রহস্য সেখানে লুকিয়ে থাকে। এত রহস্য ভেদ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। আপনি কত সৌভাগ্যবান– সেসব রহস্যের কিছু ছোঁয়া পেয়ে যান। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আরেকটা ধন্যবাদও আপনার প্রাপ্য। সেটা কেন? বলছি।
আমার স্ত্রী অসংখ্য রাতে রকি বলে চিৎকার করে ওঠে। আমার স্ত্রীর নাম ড. রেহনুমা খান। সে একজন ডাক্তার। তার জীবনের এই রহস্য আমি কখনো জিজ্ঞেস করেও বের করতে পারিনি। আমাকে বলেনি। মজার বিষয় কী জানেন? হুট করেই তার ঘুম অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি সে খুব গম্ভীর। হুট করেই দেখছি সে খুব উচ্ছল হয়ে উঠেছে। সে আগে ঠিকমতো আমার সঙ্গে কথাও বলতো না। হুট করেই ঘরের সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ধারণা করতে পারি, আপনার কাছে যে রেহনুমা ফোন দিয়েছিল, সে আমারই স্ত্রী। ধারণা করতে পারি, সে আপনার এক্সিট ডোরটা ব্যবহার করে নিজেকে একটা ট্রমা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই অদ্ভুত রমাঞ্চকর পৃথিবীতে মানুষের জীবনে কত কী ঘটে যায়। মানুষের জীবনটা কত ছোট্ট, অথচ তাদের জীবনের গল্পটা মনে হয় এক সমুদ্রের চাইতেও বড়। যেখানে ক্রমাগত মগ্ন হয়ে হারিয়ে যায় মানুষ। মানুষের ভেতরের গল্পগুলো খুব মর্মান্তিক। এতই মর্মান্তিক যে, তাদের বলার কোনো জায়গাও নেই। আমরা মানুষরা শেষ পর্যন্ত কত অসহায়। এই যে দেখুন, আপনার এই গবেষণায় আমার স্ত্রীও যে রয়েছে, এটাও তো আমার জীবনের গল্পের অংশ। অথচ কাউকে কখনো বলতে পারবো না। আপনাকে বলে দিলাম। কারণ আমি নরমচিত্তের মানুষ। দীর্ঘসময় কোনো ট্রমায় থাকতে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। তাই সেচ্ছায় আপনার এক্সিট ডোরটা আমিও ব্যবহার করলাম।
ভালো থাকবেন
মোস্তফা খান
সম্পাদক, দৈনিক সময়কাল
চিঠিটা পড়া শেষ করে জাফরুল্লাহ’র মাথাব্যথা আরও ঘন হয়ে উঠেছে, চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তিনি টের পেলেন তার চোখও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। এমন সময় তার স্ত্রী পাশ থেকে বলছে, কী হয়েছে এত ঘামছ কেন? এটুকুই শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন জাফরুল্লাহ। শেষে শুধু বললেন, আমাকে ঠাণ্ডা পানি দাও।