শিমুল বাশারের গল্প ‘কনফেস’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০

তিনদিন পর তরি মারা গেল। এখন পর্যন্ত দুনিয়াতে আমি ছাড়া আর কেউ জানে না তরীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ।

কোনো এক বসন্তের ভোরে সবাই যখন ঘর থেকে বের হয়ে এলো, তখন মিহি বৃষ্টির সাথে চারপাশে ফাল্গুনের মধু ঝরে পড়ছে। গণভবনের দেয়াল ভেদ করে আমাদের কোয়াটারে আম আর সজনে ফুলের ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। জাফরিন, শাহরিনদের বাড়ির সামনের দিকটায় বিরাট বড় গর্ত খোড়া হচ্ছে হাসপাতালের নতুন ভবন করার জন্য। গর্তের ভেতর লাল মাটি। সাপের ল্যাজের মতো জীবন্ত গাছের শেকড় বেরিয়ে কিলবিল করছে। প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে তরি এ জায়গাটাতেই খেলতে আসতো। এ পাড়ায় তরিকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। এটা সবাই জানে এবং দেখেছে। সেদিন তরি জাগছে না দেখে উঁকি মারলাম তাদের ঘরের ভেতরে। আধো অন্ধকারে তরি মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে। আমি আলগোছে তার শরীরে হাত রাখলাম।

তরির সাথে আর যারা থাকতো তারা রোজকার মতো সেদিনও ঘর থেকে বের হয়ে যে যার গন্তব্যে চলে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা নিজেদের মতো করেই ঘুরে বেড়াতো আর আমি সারাক্ষণ লেগে থাকতাম তরির পেছনে। কসম করে বলছি, তরিকে আমি খুব ভালোবাসতাম। চোখের আড়াল হতে দিতাম না। কখনো যদি নিজের ব্যস্ততায় ভুলে যেতাম, তরির কথা পরে মনে পড়লেই তারে আমি এদিক-সেদিক খুঁজতে থাকতাম। তরি ছোট থেকেই আমার ছিল। আমাকে আর তরিকে যারা চিনতো তারা সবাই জানতো এবং মানতো যে, তরি আমার। তরিকে সবাই খুব আদর করতো। আমি ভাবতাম, তরি আমার বলেই হয়তো সবার বাড়তি যত্ন পাচ্ছে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তরিকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে যখন হয়রান, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তরি একটা গাছের ডালে বসে আমার দিকে কেমন মিষ্টি করে তাকিয়ে আছে। আমার শিশুমন তখন তরিকে প্রথমবারের মতো গাছের ডালে বসা দেখে চমকে ওঠে। আমি ভেবে পাই না, তরি গাছে ওঠা শিখলো কিভাবে? দূর থেকে অপেক্ষায় থাকি, কখন সে নামবে! একা একা সে কিভাবে গাছে উঠলো আর নামবেই বা কিভাবে? নিজ মনের এই জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে আমি যে ঠিক কতটা সময় আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম, তা আর এখন মনে করতে পারি না।

বেলা গড়িয়ে যায়। আমার চোখও ঢুলু ঢুলু। ক্ষুধাও লেগেছে। হঠাৎ পরির মতো তরি নেমে এলো গাছ থেকে। লুকিয়ে লুকিয়ে তরির এই উড়তে শেখাটা আমাকে বিমোহিত করলো। আমি গোপনে তার ওই বীরঙ্গনা কৌশল রপ্ত করার সহযোগিতার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে থাকলাম। আমার মনে হলো, তরি আসলে উড়তে জানে। এটা ছিল তরি বিষয়ক একান্ত এক বিরাট আবিষ্কার। আমার মনে হলো, তরি হয়তো কিছুটা অলস প্রকৃতির আর অতিরিক্ত আদরের কারণে জেনেও আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে না। উড়লে কতই না ভালো হতো! আসলে বিপদে না পড়লে এই দুনিয়ায় কে আর পরিশ্রম করে! শিশু মনের এই উপলব্ধি আমাকে আরো অগ্রসর হবার সাহস জুগালো। সিদ্ধান্ত নিলাম, তরিকে যেহেতু আমি ভালোবাসি তাই তাকে সাহায্য করা উচিত।

পরিকল্পনা অনুযায়ী তরির গায়ের শক্তি বাড়াতে ভালো খাবার দাবারের পাশাপাশি আমি তাকে ব্যায়াম করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। খু্ব ভোরে ঘুম থেকে তুলে আমার তত্ত্বাবধানে চলতো কয়েক ঘণ্টার ওয়ার্মআপ। দুই পা যতটা সম্ভব টেনে ছড়াতাম, আবার ভাঁজ করতাম। এভাবে মাসখানেক চললো। আমি অপেক্ষায় আছি চূড়ান্ত মুহূর্তের। মাথায় সারাক্ষণ তরিকে নিয়ে চিন্তা। তাকে ফিট করতে নতুন নতুন আইডিয়া বের করা।

একদিন ওয়ার্মআপ শেষে দু‘হাতে তরিকে বুকের কাছে নিয়ে কিছুটা আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরে শূন্যে ছেড়ে দিলাম। তরি খুব সাবলীল ঢংয়ে মাটিতে নেমে এলো। আমিতো তরির এই উন্নতিতে মুগ্ধ! বুকে চেপে ধরে চুমু খেলাম কয়েকটা। এভাবে কয়েকদিন চলার পর তরিকে আকাশের দিকে ইষৎ ছুড়ে দেয়াও শুরু করলাম। এভাবে তরির শক্তির পাশাপাশি আমারো সক্ষমতা বাড়তে থাকলো।

তরি ছিল আমার কাছে পরির মতো। আমার সেই পরির মৃত্যুর রহস্য শুধু আমি জানি। পৃথিবীর আর কেউ এ রহস্য জানতে পারেনি এখনো। তরি মারা যাবার আগে অসুস্থ হয়ে যায়। হয়তো তার অসুস্থার সময় আমাকে সে অভিশাপ দিয়েছিল, যেকারণে আমি আর এ জীবনে ভালোবাসা পাইনি। ভালোবাসা আমার কাছে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক এক অভিজ্ঞতার নাম। তরির মৃত্যু নিয়ে অনেকের অনেকরকম ধারণা জন্মেছিল। অনেকে ভেবেছিল, তরিকে বিষাক্ত সাপে কেটেছিল। অনেকে তরির দু’পায়ের ফাঁকে ফুলে ওঠা অংশটা দেখে ভেবেছিল, কেউ তাকে এখানে আঘাত করেছিল হয়তো। কিন্তু আমি জানি, তার এই মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমাকে আপনারা ক্ষমা করে দিয়েন। অতিরিক্ত ভালোবাসা কখনো কখনো মৃত্যু ডেকে আনে।

এটি গল্প নয়। গল্প লেখার দায় আমার নেই। তাহলে হয়তো এতদিনে গল্পের বই বের হয়ে যেত। সত্যি বলছি, আমি সোমবার সন্ধ্যা থেকে বইমেলার পামগাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে আছি। এ বছর বইমেলায় যেতে চাইনি। সব দোষ রবিদার! উনি আমাকে জোর করে নিয়ে গেছেন। এত মানুষ! এত ভালোবাসাবাসি! উফ, অসহ্য! এত লেখক! কতরকম বই! কত অগল্প গল্পের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে আর কত গল্প অলেখা রয়ে যাচ্ছে এ জগতে, আহা! আমি এক সময় লিখতাম বলে আমাকে বিয়ে করা নারীটি ছেড়ে চলে গেছে সেই কবেই! মনে আছে, আমি তরির কথা লিখবো বলে লেখার ঘোর নিয়ে সারারাত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতাম। ছটফট করতাম! সে ছিল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। বানান ঠিক করতে দেয়ার অজুহাতে আমি আসলে তাকে সারারাত ধরে লেখা গল্পটা পড়তে দিতাম। বানান ঠিক করে দিয়ে সে একটা সৌজন্যের হাসি দিতো। পরে একদিন শুনেছি, সে তার এক বন্ধুকে বলেছে, ‘শিমুলের আসলে লেখাটেখা কিছু হয় না। এত বানান ভুল নিয়ে তো গল্পকার হওয়া যায় না।’

এসবের জন্য একজীবনে আমি নাকি তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছি। অপূর্ণতায় ভরে দিয়েছি তার সমগ্র জীবন ও যৌবন।

আমার শরীর কাঁপছে। আমি গত দু‘দিন ধরে গল্প পুনরায় লেখার ঘোরের ভেতর বইমেলার পামগাছের নিচে দাঁড়ায়ে আছি নূরিনের দিকে তাকিয়ে। নূরিন জানে, আমি এ জীবনে কারোর প্রকৃত ভালোবাসা পাইনি। হয়তো একারণেই তাকে বউ ডাকার পরও হজম করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। নিজের বয়সের প্রতি সম্মান দেখাতে পারছি না জেনেও সে আমার এ ভালোবাসাকে ভীমরতি না বলার উদারতা দেখিয়ে যাচ্ছে কিংবা সেও তার জীবনকে যাপন করার মহৎ প্রকল্প নিয়ে বইমেলার পামগাছের নিচে আমাকে কাঁপতে দেখে একা একা হাসছে।

বইমেলার এত এত বইয়ের ভাঁজে সত্যিই আমার কোনো গল্প নেই। আমি কেউ না। কারো ভালোতেও নেই, মন্দতেও। ক্ষতি করার মতো ক্ষতের জায়গা আসলে আমার নেই। আমার হাত পা কাঁপছে ভয়ঙ্কর! আমার তরির মৃত মুখ মনে পড়ছে। আমি পামগাছের নিচে দাঁড়ায়ে আছি যেন কোনো শিশুর হাত থেকে উড়ে যাওয়া এক গ্যাস বেলুন। নূরিনের বুকের স্পর্শে আজ চুপসে গেছি। একারণেই হয়তো আমার ভালোবাসাহীনতার সাথে মজা নেয় সূচনা, ইরা, রোদসী, অন্তরা, লামিয়া— আরো কতজন! ওরা জানে, আমার আসলে কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি নারীর ভালোবাসার জন্য অনেক কেঁদেছি। আমি জানি, আমি হ্যান্ডসাম নই। পুরুষের স্বভাবসুলভ হিংস্রতা আমার ভেতর থেকে হারিয়ে গেছে তরিকে হত্যা করার অপরাধ বোধে। হ্যাঁ, আমি একদিন লিখতে পারতাম। তীব্র ভালোবাসাও ছিল বুকে। যেমন আমি তরিকে ভালোবেসে ছিলাম। কত আদর আর স্বপ্ন নিয়ে আমি তরিকে উড়তে শিখিয়েছিলাম। এ গল্প আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। তরি আসলেই উড়তে শিখেছিল। আমি তরিকে সর্বশক্তি দিয়ে আকাশে ছুড়ে দিতাম আর তরি সাবলীলভাবে উড়তে উড়তে মাটিতে নেমে আসতো। এরপর আরো অভিনব কায়দায় তার উড়ে বেড়ানোকে অভ্যাসে পরিণত করতে পুকুরের দিকে ছুড়ে দিতে থাকলাম, যেন সে পুকুরের পানিতে ডুবে না গিয়ে টার্ন করে আমার কাছেই ফিরে আসে। সে তাই করতে থাকলো।

তরির এই অদ্ভুত সাফল্যে আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম। খুব গর্ববোধ করতাম। ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছিল আরো কয়েকগুণ। আমি সারাদিন তরিকে চোখে চোখে রাখতাম। তরি বড় হয়ে গেল। দেখতে সবার চেয়ে সুন্দর, আলাদা এবং সুগঠিত!

একদিন দেখলাম, তরি আমার জন্য তার ঘরে খাবার লুকিয়ে রেখেছে। সত্যি বলছি, আমি ওইদিনটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ হবার গৌরব বোধ করেছিলাম। আমার এই খুশি দেখেই হয়তো প্রতিদিন সে আমার জন্য একটি করে ডিম রাখা শুরু করলো। এত বড় ডিম কোনো মুরগীকে তখনো দিতে দেখিনি। আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম। সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে তরি ডিম দিতো। একদিন অপেক্ষায় আছি, তরি আর ডিম দেয় না। আমি কয়েকদফা তার ঘরে উঁকি দিলাম। ডিম নেই। ১টা বেজে গেল, তবুও ডিমের কোনো খবর নেই। আমার ততদিনে ডিম খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। তরিকে আড়ালে দেখে ধাওয়া করলাম। জাফরিনদের বাড়ির পেছনের আমগাছের আড়ালে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলাম। সেখানে গোলাপের ঝোপ। অনেক গোলাপ ফুটেছে। শতদল ঝরা মাটির বিছানায় তাকে ধরে বসে কোলে নিলাম।

আহা, আমি বুঝতেও পারিনি তরির কত বড় ক্ষতি আমি সেদিন ফেলেছি! ছোটো ছিলাম। নূরিন বলেছে, বড় মানুষ নাকি বিনয়ী হয় আর ছোটরা হিংস্র। আমি তরিকে ভালোবাসতাম। তরি যেহেতু কথা বলতে পারতো না সেহেতু আমি ধরেই নিতাম, তরিও আমাকে আমার মতোই ভালোবাসে। তাছাড়া তরি যেহেতু আমাকে প্রতিদিন ডিম খেতে দিতো সেহেতু ওইদিন অপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে আমি হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।

মানুষ হিসেবে আজো আমি হয়তো তরির অভিশাপ নিয়ে পামগাছের নিচে একা দাঁড়ায়ে আছি। প্রকৃত ভালোবাসার মুখ দেখিনি কোনোদিন। পৃথিবীতে সুস্থ সকলের জন্য ভালোবাসা বরাদ্দ আছে। কিন্তু আমার জন্য বরাদ্দ ভালোবাসাটা তরির সেদিনের যন্ত্রণায় কাটাকাটি হয়ে গেছে হয়তো। ওই ঘটনার তিনদিন পর তরি মারা যায়। সব ক’টা মুরগী ঘর থেকে বের হয়ে এলেও পৃথিবীর মুখ দেখতে তরি আর বের হয় না।

নূরিন বলে, আপনি পুরাই পাগল। মুনিয়া বলে, পাগল একটা! আর সূচনা চুপসে যাওয়া একটা বেলুনের মুখে ফুঁ দিয়ে ফুলাতে চায় বুকের আঘাতে আমাকে ফুটাবে বলে।