শাহরুখ পিকলুর একগুচ্ছ খুদে গপ্প
প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০১৯
পরগাছা
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করেই যেন মোহাম্মাদ বদিউজ্জামান ওরফে বদি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ঘরে নাশতার জোগাড় নেই, হবে না, তা সে জানে। টুম্পা, তার বউ, সে ব্যাপার জানে। তাই সে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাবে। কোনো সন্তান না থাকার এই এক সুবিধা।
বদি আজ তবে কেন বের হলো, সকালের নাশতাটাও না করে? কারণ সে আজ বনানী যাবে, বনানী গোরস্থানে। কাগজপত্র সব আছে– যদিবা বাপের কবরটা কারোর কাছে বেচা যায়।
ভালোবাসা
সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক ভোরেই রোজ উঠে পড়ে জরিনা। ছেলেমেয়ে দুটোকে কিছু খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয় ভোরেই, নিজে কিছু খেয়ে পড়িমরি করে ছুটতে হবে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। ‘এই যে লাটসা’ব, উঠো না ক্যান? কামে যাইবা না?’ আখলাস আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে একটা কী যেন বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ‘কাইল রাতে শুকনা মাল খাইয়া কত রাতে ফিরছো, মনে আছে? আমি পোলাপাইন লইয়া একলা ঘরে থাকি হেদিক কুনু খেয়াল আছে?’
‘হুঁ, তুই নাশতা বানাইয়া রাইখা যাইস। পরে খামু নে।’
‘আর, কামে যাইবো কে! আমি একলাই খালি সংসারটা টানুম নি!’
কাওরান বাজারের একটা ফার্নিচারের দোকানে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে আখলাস। দক্ষ হাত তার, মাঝে সাঝে কামাই মারলেও মালিক দু’চারটা গালমন্দ করে কিন্তু চাকরি কখনোই খায় না।
‘শইলডা আজ কেমুন জানি লাগে, জ্বর আইবো মনে কয়। দুপুরে যামু নে।’
‘আরে আমার ভাদাইম্যা ব্যাডা! তোমারে বিয়া কইরা আমার জীবনটাই শ্যাষ। খাটতে খাটতে আমার...আর উনি রাইত-বিরাইত সন্ন্যাসীগো লগে ফুঁকে আর গান গায়। গলায় দড়ি দিমু একদিন।’
আখলাস ঘুমজড়ানো চোখ খুলে জরিনার দিকে হাসিমুখ করে বলে, ‘পারবি না। তুই আমারে থুইয়া মরতে পারবি না।’ আবার চোখ বুজে গেল তার।
জরিনা ছটফট করল, আরো এক গাদা কথা শোনালো স্বামীকে। কিন্তু ঠিকই নাশতা বানিয়ে আখলাসের জন্য ঢাকা দিয়ে গেল। শয্যাপার্শ্বে এক গেলাস পানিও রেখে গেল, পিরিচ দিয়ে ঢেকে। নিজে কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল কাজে।
জরিনার এই রাগ চৈত্রের বৃষ্টির মতন, জমিন পাওয়ার আগেই সে জল শুকিয়ে যায়। বড্ড ভালোবাসে সে আখলাস নামের ওই পাগলটাকে।
গপ্পো নয়
রাহেলার কয়েকটা মেয়ের মধ্যে মাত্র চৌদ্দতে পা দেয়া বিবি আয়েশার শরীরটা এরই মধ্যে আশপাশের ছেলেদের মন টানে। যতই সে কুঁজো হয়ে হাঁটুক তার স্তন আর নিতম্ব জোয়ান-বুড়ো এমনকি যেন অন্ধেরও চোখ এড়ায় না। মনে মনে বড্ড রাগে আয়েশা, দোষটা যেন তার! কিন্তু সে রাগে আর কীইবা এসে যায়, ছেলেদের লোলুপ চোখ তার যৌবনের দিকে চেয়ে থাকে, মুখ থেকে যেন লালা ঝরে, হাতগুলো অজান্তে নয় পূর্ণ জ্ঞানেই বেড়ে আসে তার স্তনের দিকে, পাছার দিকে। যাদের হাত বাড়াতে লজ্জা নেই, আমার লিখতে লজ্জা লাগা একান্তই সূর্যের আলোকে অস্বীকার করার শামিল।
চিন্তায় ঘুম হয় না রাহেলার, তার রিকশাচালক স্বামী বাবুলের। মেয়েটাকে আপদ ভাবতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। কিন্তু ছেলেগুলো তো সব মৌমাছি, ফুলের মিষ্টি মধুটা খেয়েই ভাগবে, চালচুলোর খবরও নেই কারো। বিয়ের প্রস্তাব আর মেয়ের ভবিষ্যতে মিল খায় না। বস্তির হুজুর নিয়ে এলো ‘মুক্তির’ পথ। চল্লিশোর্ধ কাঠের ব্যবসায়ী রমজান মিঞাই সমাধান, হুজুর জানালেন। হোক আয়েশা তার তৃতীয় বউ কিন্তু খেতে পাবে, কেউ আর জ্বালাবে না বাবুল-রাহেলাকে।
মানুষের জীবনের, বিশেষত গরিবের, সুখের অনুভূতি প্রকাশিত হলেও যা কিনা কচিৎ কখনো ঘটে, দুখের গভীর খান্দার শুধুই অন্ধকার জমাতে থাকে, মাঝে মাঝে তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে সবার অজান্তে বেরিয়ে আসে। এমনই এক যৌথ দীর্ঘশ্বাসের ফলশ্রুতিতে একদিন জুম্মাবাদ কবুল বলে বিবি আয়েশা। তার চৌদ্দ বছরের বুকটা ফেটে যেতে চায় তবুও ‘কবুল’। সেদিন রাতেই কোনোক্রমে একান্ত স্থূলকায় রমজান হাঁপাতে হাঁপাতে দায়িত্বস্বরূপ বীজ ঢেলে দেয় আয়েশার গহীনে, ছেলের আশায় ওজু করে বিশেষ নামাজ পড়ে সে তার দায়িত্ব শেষে।
মেনে নেয় আয়েশা। শুধু চিরকালের জন্য যেন তার অচেনা রয়ে গেল প্রেমিক পুরুষের সান্নিধ্য, পুরুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তার যৌবনের পাগলামো, উন্মত্ত প্রেম, উদ্দাম প্রাণের অদম্য পৌরুষ। আর কোনোদিন সে সেই যৌবনের উন্মত্ততার স্বাদ পাবেও না। নারীর জীবনটা আজও অমনই, অনেক ক্ষেত্রেই।
খোলা ব্যাগ
সত্তর দশকের কথা, সারা বাংলাদেশে তখন এত মুড়ি-মুড়কির মতো বড়লোক ছিলো না। সুফিয়া বেগম ছিল তার ব্যতিক্রম। তার স্বামী শিল্পপতি আবুল খায়ের গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিতে তিন-তিনখানা বাড়ি রেখে এক সন্ধ্যায় হার্টঅ্যাটাক করে বিন্দুমাত্র দেরি না-করে দেহত্যাগ করেন। রেখে যান লক্ষ লক্ষ টাকা (তখনও কোটি শুধু সরকারের বাজেটেই থাকতো)। নিঃসন্তান সুফিয়া বেগম বাকি জীবন পায়ের উপর পা তুলে, স্বামীর মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে ঘুরে কাটিয়েও যেন পরজন্মে কিছু নিয়ে যেতে পারবেন- অবস্থাদৃষ্টে আমরা এমনটাই যেন ভাবতাম। আমাদের আর দোষ কী! ক’টাকাই আর চোখে দেখেছি আমরা- নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার চেয়েও বেহাল দশা, পান্তাও যে নেই, সত্তরের দশক যাদের মনে আছে।
সুফিয়া বেগম ঘুরতেন কিন্তু তার মধ্যে আমরা কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ব্যাগে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে বেরিয়ে রাজ্যের জিনিসপত্র কিনতেন। ঘরভরা জিনিসের পরেও কেন আরো দামি জিনিস নিয়ে এসে তা গ্যারেজে ফেলে রাখতেন, আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। বায়তুল মোকাররমের বিখ্যাত আমিন জুয়েলার্স, ভেনাস জুয়েলার্স ইত্যাদি দোকানে যেয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে কিনতেন সব জড়োয়া সেট। তখন সোনার ভরি হাজারের কম ছিল। কিন্তু তার ব্যাগটা থাকতো খোলা, সবসময়ে। দোকানি দেখতো হাজার টাকার জিনিস বিক্রির পরেও একটা সামান্য দামের কানের ঝুমকা গায়েব, তারা গা করতো না, আমরা বিস্মিত হতাম। খারাপ ব্যবসার দিনে দিলখোলা গাহেক!
হাসিখুশি মানুষটা আমাদের কারোর বাড়ি এলে এক গাদা উপহার, রাজ্যের খাবার নিয়ে আসতো কিন্তু ব্যাগটা থাকতো খোলা। তার প্রস্থানে দ্যাখা যেত হয় একটা লিপ্সটিক গায়েব বা একটা ফাউন্টেন পেন বা একটা পুরোনো ডায়েরি। আমরা তাতে কিছু মনে করতাম না কিন্তু ভাবতাম যে, যে মহিলা একটা আস্ত স্টেশনারি বা কসমেটিক্সের দোকান নিমেষে কিনতে পারে সে কেন একটা পার্কার বলপয়েন্ট বা প্রায় শেষ হয়ে আসা একটা প্যাট্রা সেন্টের শিশি অগোচরে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলতেন!
আমরা অনেকদিন এ নিয়ে ভেবেছি। একি সন্তান না থাকার হাহাকার, অকালে অকস্মাৎ স্বামী হারানোর বেদনা নাকি সমাজের মধ্যশ্রেণির কষ্টে যাপিত জীবনের সামান্যতম সুখের প্রতি তার ইর্ষা! আমরা বেশিদিন ভেবে ওঠার আগেই একদিন সে তার খোলা ব্যাগের অভ্যন্তর নিরীক্ষা করতে করতে ট্রেনে কাটা পড়েন মহাখালি রেলক্রসিং-এ। স্বেচ্ছায় কি? নাকি নিছক দুর্ঘটনা! এক/দু’দিন ভেবেই আমরা আবার আমাদের নিজেদের চাওয়া-পাওয়া, সামান্য সুখ আর অগাধ দুঃখের বোঝা টানতে গিয়ে আমরা সুফি্যা বেগমের খোলা ব্যাগ ভুলে গেছি, সঙ্গে তাকেও।
যে জীবনের অস্তিত্ব প্রতিদিনের সংগ্রাম, সেখানে যে যুদ্ধ করে না তার প্রতি অস্তিত্বের লড়াইয়ে মত্ত সৈনিকের কোনো সমবেদনা থাকে না।
বারবনিতার প্রেম
করবীর স্লিভলেস ব্লাউস, তার উন্মত্ত যৌবনে হারিয়ে অনিন্দ্য তাকে কাছে পেতে চায়, কাছে পেয়ে যা হয় তাই হ`লো- দেহের মিলন। লজ্জাটা কোত্থেকে এলো তা বোঝা কঠিন। যে মেয়ে প্রতি রাতে নিজের সব উজাড় ক`রে দেয় রাজ্যের অজানা পুরুষের কাছে, যা নিয়ে সকালে সে হাসে, সন্ধ্যায় নতুন `খদ্দের` আসার আগেই স্কটল্যান্ডের পানীয়ের আশ্রয় নেয়, কেন তার মনে আজ এতো দ্বিধা! তবুও দিদৃক্ষার তাড়নায় অনিন্দ্য বই কেউ তো নেই তারাভরা আকাশে, মদের ঘোরের সপ্তর্ষিমণ্ডলে। সেথায় নেই বেশ্যা পরিচয়, আছে একটা তারাই শুধু, নিন্দা করতে চেয়েও পারে না সে, অনিন্দ্য নাম যে তার। জীবনকে ছেলেখেলা মনে করে, মদকেই আশ্রয় মনে করে, টাকার দেবতাকেই প্রণাম করেই যে করবী জীবনকে জীবন মনে করেছিলো, আজ সে বুঝলো জীবনে প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, নিন্দার ঊর্ধ্বে মানুষ আছে। তার নাম অনিন্দ্য।