শামীমা জামানের গল্প ‘রুমাল’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০২১

মেয়েটিকে তুমি বলবে না আপনি বলবে, বুঝে উঠতে সময় নেয় জুনায়েদ। দৃশ্যত সে আঠারো-উনিশ। এই বয়সের একটি মেয়েকে তুমি করে বলাটাই স্বাভাবিক। আর বলবেই বা কি। কি কথা এর সঙ্গে? তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাবার মতো জ্ঞান-গরিমা নিশ্চয় এই মেয়ের নেই। পডশোনা কতদূর তা-ই বা কে জানে। আজকাল অবশ্য বোঝাও মুশকিল। সবাই সুন্দর করে কথা বলে। সব মেয়েদের গেটআপও অতি আধুনিক। কে যে সুন্দর আর কে যে সাধারণ, তা সাজসজ্জা ধুয়েমুছে না গেলে বোঝার উপায় নেই।

তোমার নাম কি? ঢোঁক গিলে জানতে চাইলো জুনায়েদ।
সানি লিওন। কানের ওপর থেকে চুলের গোছা সরানোর মিথ্যে ভঙ্গিতে বলল মেয়েটি। তার মুখে মৃদু হাসি। রহস্যময়তায় নিজেকে আড়াল করে রাখবার মহান কৃতিত্বের হাসি।
যাহ্। সানি লিওন কারো নাম হয় নাকি? একটু যেন অবাক হওয়ার ভান করে জুনায়েদ। তার নাম জানতে চাওয়ার কি দরকার ছিল। এরা কি আসল নাম বলে?
আপনার নাম কি? পা দোলাতে দোলাতে প্রশ্ন ছোড়ে মেয়েটি। যেন সে আহ্লাদে খুকি।

এখন কী বলবে জুনায়েদ। সেও কি আজকের এই মধ্যাহ্নের জন্য নিজের একটা নতুন নাম রাখবে? এ লাইনে পুরুষরাও কি নিজের আসল নাম বলে? সেই অর্থে জুনায়েদ ধুন্দুমার মাগিবাজ নয়। তবে এই মেয়েটিও তার প্রথম ব্যবহার্য নয়। এর আগে সে দু’একবার এসব মেয়ে চেখে দেখেছে। সেটাও আবার বিয়ের আগে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। তাই আজ এত বছর পর দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে নিজেকে আনাড়িই মনে হচ্ছে। মেয়েটি কিশোরীদের মতো পা দুলিয়েই যাচ্ছে। সেও কি এ লাইনে নতুন নাকি? এরপর তার কি করণীয়, তা কি সে জানে না। এত তার স্ত্রী সুরাইয়া নয় যে তাকে স্বামীগিরি দেখাতে হবে। এ হচ্ছে সেবিকা। তার কাজ সেবা করা। সুরাইয়ার হালকা মেদবহুল কুমড়ো সাইজের মুখটা মনে হতেই জুনায়েদের এখানে এই সাধারণ মানের হোটেলে আসার উদ্দেশ্য পূরণের ইচ্ছায় ভাটা পড়ল, যেমনটা বিশেষ মুহূর্তে দেয়ালে টানানো মুরব্বি কারো ছবি দর্শনে হয়। বিরক্তিকর দজ্জাল মহিলা একটা। সারাদিন খেটেখুটে বাড়ি ফেরে। একটু আয়েশ করবে কি, তার প্যাচালের ঠ্যালায় ঘরের আলো বাতাসও পালিয়ে যেতে চায়ে। আর সে তো কোন্ ছার!

বেতন পাবা কবে তুমি?
এই তো এই সপ্তাহ পেয়ে যাব।
কেন, এত দেরি লাগে কিভাবে? বলদ বোঝাও নাকি আমাকে তুমি? প্রত্যেক মাসে তোমাকেই শুধু বেতন দিতে দেরি করে। নাকি ওই দিক দিয়ে আসো চৌদ্দ গুষ্ঠিকে। তোমার টাকা ছাড়া তো ওই রাবনের সংসারের হা বোজে না।

সুরাইয়োর সত্যি কথাগুলোর প্রতিবাদ জুনায়েদ কখনোই করে না। সে করে যায়ে তার কাজ। তার মা, ভাইবোনের সংসারে টাকা-পয়সার যোগান না দিলে চলবে কেন। এত অকৃতজ্ঞ ছেলে সে না। এই বেহুদা মেয়েমানুষের কথা তার গায়ে তুললে চলবে না। সুরাইয়োকে এই রকম পরিস্থতিতে তার এড়িয়েই চলতে হয়ে। একমাত্র মেয়ে অবনীকে সে এ সময়ে পড়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়ে। তাতে ধীরে ধীরে সুরাইয়োর মেজাজ শান্ত হয়ে যায়ে।

আমার কথা তুমি ঠাণ্ডা মাথায় একবার চিন্তা করে দ্যাখো। ব্যাংকে চাকরি করে মানুষ বাড়ি-গাড়ি অনেক কিছু করে ফেলে। তুমি কিন্তু কিছুই করতে পারলে না। এর কারণ তোমার ওই পিছুটান। কোনোরকমে টেনেটুনে আমি সংসার চালাই। একটা ভালো শাড়ি বলো, গয়েনা বলো, কি পরি আমি! মেয়ের স্কুলের ভাবিদের সামনে লজ্জায় মরে যাই। সব ভাবিরা কত দামি দামি জামা-কাপড় পরে আর আমার দিকে আড় চোখে অবজ্ঞা নিয়ে তাকায়।

আচ্ছা, স্কুল কি ফ্যাশন শোর জায়গা? জুনায়েদ খানিক বাদেই বুঝতে পারে কী বেফাঁস কথা সে বলে ফেলেছে। সুরাইয়ার অকথ্য চিৎকারে কানটা তার ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। ডান হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে জুনায়েদ।

কী হলো আপনার, মাথা ব্যথা করছে? সানি লিওনের কৃত্রিম রিনরিনে কণ্ঠে সম্বিৎ ফেরে জুনায়েদের, হ্যাঁ একটু।
মাথা টিপে দেব আমি? মিথ্যে মমতা নিয়ে সানি লিওন তার কাছে এলো।
জুনায়েদ চোখ মেলে দেখে সানি লিওনকে। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। বোঁচা নাকের নিচে টসটসে ঠোঁট দুটিতে লাল রঙের লিপস্টিক বোলানো। মুখে হালকা মেকআপ। ভদ্রঘরের মেয়েদের মতোই। ঠিক যাত্রাপালার নারীশিল্পীর মতো উৎকট মেকআপে ঢাকা নয়, যা দেখলে মানুষ এর পেশা চিনে ফেলতে পারে। দৈহিক গঙন চিকন-চাকন। পুরুষের ভেতরের কুকুরকে বের করে আনার জন্য যথেষ্ট। জুনায়েদ এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় মেয়েটিকে। কি তার পরিচয়ে। কিংবা তার নিজের সামান্য সামাজিক পরিচয়টুকুও। দু`হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয় মেয়েটিকে।

হোটেল থেকে নেমে ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের কাছে আসতেই মোবাইল বেজে ওঠে শুভ্রার। নীরব। হোটেলে কাস্টমারকে সার্ভিস দেয়ার সময়ও দু’বার ফোন করে সে। শুভ্রা ধরেনি। মনোযোগ অন্যদিকে নেবার মতো সময় সেটি নয়। নীরবের সঙ্গে বিকেলে দেখা করার কথা তার। নীরব বলেছিল, শুভ্রা, আমি আসতাছি। কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের মধ্যে আছি। তুমি চলে আসো। মেজাজটা খারাপ হলো শুভ্রার। ওইখানে ওই মাঠের মধ্যে কেন! একটা ফাস্টফুডের দোকানে বসতে পারে না ছ্যামড়া। কলেজে পড়া কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে কি করতিস। ফাস্টফুডেই তো খাওয়াইতিস। পার্লারে কাম করি বইলা মানুষ মনে করো না। শুভ্রা রাগে গজগজ করতে থাকে আর হনহন করে পা ফেলে চলে গ্রিন রোডের আইল্যান্ডের ওপর দিয়ে। খানিক বাদে উপচে পড়া আবর্জনায় ছড়ানো খোলা ডাস্টবিনগুলো পেরিয়ে সে চলে আসে ক্রিসেন্ট রোডের উল্টো দিকে কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের গেটের কাছে। কয়েক পা এগোতেই নীরবকে পেয়ে যায়। টংয়ের দোকনটার সামনে দাঁড়িয়ে সে চা খাচ্ছিল। শুভ্রাকে দেখে কাপ রেখে কাছে আসে।

কি ব্যাপার, এতবার ফোন দিই ধরো না ক্যান? বিরক্ত কণ্ঠে জানতে চায় নীরব।
আমি কি তোমার মতো বেকার বসে থাকি নাকি দোকানে। বসে বসে মাছি মারি। আমার কাম থাকে। ঠোট বাঁকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শুভ্রা।
ওরে আমার কামের মেয়ে রে! কি এমন কাম তোমার তা তো জানা আছে। আমার। খালি তো মাইয়াগো সাজাও, আর কী!
একদম কথা বলবা না। ভুরু প্লাকের পরে চুল কাটা, চুল কাটার পরে চুলে কালার করতে না করতে ফেসিয়ালের মহিলারা বইসা থাকে। আমার এই দুইটা হাতের বিরাম আছে নাকি। টের তো পাও না। তুমি তো কাপড়ের দোকানে বইসা থাকো। সারাদিন গেলেও তোমার কাস্টমার নাই। বইসা বইসা মোবাইলে মাইয়াগো সঙ্গে প্রেম করো।

হাঁটতে হাঁটতে তারা এমন কথা চালাচালি কিংবা মিথ্যে গালাগালি চালিয়ে যায়। ভিতরের বেশ কটি রাস্তা মাড়িয়ে তারা এদিককার গেট দিয়ে মিরপুর রোডে বেরিয়ে পড়ে। শুভ্রার ক্লান্তিতে পা আর চলছে না। একটা টানা ঘুম ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। গোসলও সারতে হবে । কেমন ঘিনঘিন করছে গাটা।

চলো, ওদিকে যেয়ে মামা হালিম খাই। নীরব হাত ধরে টানে শুভ্রার।
অর কি খায়। ডাইলের মধ্যে খালি হাড্ডিগুড্ডি মিশাইয়া দেয়। আমি খামু না। ভালো। জিনিস ত খাইতে কও না। আহ্লাদি স্বরে বলে শুভ্রা।
কি খাইবা তুমি?
তুমার মাথাডা খামু।
সেইটা তো অনেক আগেই খাইয়াই ফালাইছ। তাইলে চলো ওই চটপটি খাই।
তা অবশ্যি খাওয়া যায়। সম্মতি জানিয়ে বলে শুভ্রা।

দেয়াল ঘেঁষে কোনার দিকে একটা বেঞ্চিতে বসে তারা। ধীরে ধীরে চারদিকে গেরুয়া অন্ধকার নেমে আসছে। তাদের দু`জোড়া পা ঘিরে জনাচল্লিশেক মশামাছি উচ্চাঙ্গ সংগীতে উৎসব শুরু করেছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দু’চারটেকে মেরে একা নায়কের পাঁচ পাঁচটা ভিলেন মেরে ফেলার বাহাদুরি হাসি ফুটে উঠছে নীরবের মুখে। চকিতে অন্ধকারে হাত দুটো তার শুভ্রার পিঠ বেয়ে ঘাড় অবধি এলোপাতাডি ঘোরে। মতলব বুঝে শুভ্রা যাওয়ার নাম করে। তার অনেক কাজ। এ বেলাটা তার পার্লারে ডিউটি আছে। আর ভর সন্ধেবেলায়ই ম্যাডাম আসেন পার্লারে। সকাল বেলাটা সে ছুটি নিয়েছে কেরানীগঞ্জে তার মা-বাপকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে। এ রকম ছুটি সে প্রায়ই নেয় কাস্টমার জুটে গেলে। কাস্টমারেরও কেন জানি আকাল পড়ছে ইদানীং। সব পুরুষ মানুষ চরিত্রবান হয়ে গেল কবে, কে জানে। সে চিন্তা করছে একটা ফেসবুক খুলবে।

মারিয়া আর এলিজার ফেসবুক আছে। সেখানে তারা পুরো কাপড় চোপড় খুলেই নানান ভঙ্গিমায় ছবি দিয়ে রেখেছে। মেসেজে কাস্টমাররা দরদাম জায়গা আলাপ করে কথা ফাইনাল করে। ওরাই তাকে দু একটা কাস্টমার জুটিয়ে দেয়। কেউ কেউ মেসেজেই শুরু করে দিতে চায়। কিন্তু সে চালাক মেয়ে টাকা-পয়সার হিসাব বুঝে কোনো কথা নাই। আজকের লোকটার কাছ থেকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকাই পাওয়া গেছে। কালই বিকাশ করে বাপকে পাঠাতে হবে। তার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে গতকাল। ঢাকায় এনে আরেকবার ডাক্তার দেখাতে হবে। অসুস্থ। বাপকে সে কথা দিয়েছে ঢাকায় সে ভালো রোজগার করতে পারবে। সেইমতো পার্লারের কোর্স করে পার্লারে সে চাকরিও নিয়েছে। কিন্তু এই সামান্য বেতনে তার খাওয়া খরচই ঠিকমতো হয় না। থাকার ব্যবস্থা যদিও পালারে আছে। তারা তিনটে মেয়ে এক সঙ্গে ঘুমায়। খুব বড় পার্লার নয়। তারা তিনজনই সামলে নিতে পারে। তবু কাস্টমারের আনাগোনা কম নয়। মারিয়া আর এলিজা আদিবাসী। শরীর বেঁচে উপার্জন সে তাদের কাছ থেকেই শিখেছে। প্রথমটা সে মেনে নিতে পারেনি কিন্তু কচকচে টাকার বান্ডিল হাতে আসতে আসতে আজকাল সব গা-সওয়া হয়ে গেছে।

বড় একটা ভাই নেই যে সংসারের হাল ধরে। আজ আর তার মা-বাপ আর ছোট ছোট ভাইবোনগুলো আধপেটা খেয়ে থাকে না। এ লাইনে আসার আগেই সে নীরবের চোখে চোখ রেখেছে। জামা কিনতে গিয়েছিল একটা দোকানে। ওখানেই এক কথায় দু কথায় নীরব তার মোবাইল নম্বর রেখে দেয়। সেলসম্যানের চাকরি করে সে। মানুষ দেখতে দেখতে বুঝে ফেলে, কার কি পরিচয়। আসলে তার সঙ্গে মারিয়া বা এলিজা থাকলে মানুষ কেন জানি তাদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ইয়ার্কি-ফাজলামি মারতে চায়। কই, ভদ্রঘরের মেয়েদের সঙ্গে তো এমনটা কেউ পারে না। তারা কেমন ভাবভঙ্গি নিয়েও থাকে। ব্যক্তিত্বের গাঁথুনি সম্পর্কে শুভ্রার ধারণা নেই, কিন্তু সে জানে সেও যদি ভদ্রঘরে জন্ম নিত অমন ভাবভঙ্গি বোধকরি সেও নিতে পারত। তবে তখন ওই বুনো জীবনের চটুল আনন্দ কোথায় পেত! জীবন এখানে শিক্ষাহীন, সভ্যভব্যহীন। অশ্লীল পুঁতিগন্ধময় বিনোদনে ভরপুর। শুধু দুঃখ-কষ্ট আর শত শত না পাওয়ার হতাশায় এরা ডুবে যায় না বরং প্রতিটি ক্ষণের অসভ্য রস তুলে নিয়ে জীবনকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, যে উপভোগের সন্ধান সভ্য মানুষেরা পায় না। শিক্ষার অদৃশ্য কাঁটাতারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এ জীবনের স্বাদ তারা নেয় না।

সুরাইয়ার পাশের চেয়ারে বসে ভুরু প্লাক করাচ্ছিল মেয়েটি। হঠাৎ দেয়ালজোড়া আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নাকিস্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। ইয়াল্লা। এইটা কি করছ তুমি?
শুভ্রা হাতের কাজ ফেলে দ্রুত এগিয়ে যায় তার দিকে। ভয়ার্ত গলায় বলে, কি হইছে ম্যাম?
তুমি তো আমার দুইটা দুই রকম করে ফেলেছ। হায় হায় এখন কি হবে। আমার হাজবেন্ড আমাকে আস্ত রাখবে না। ছি ছি। মানুষ দেখে কি বলবে।

শুভ্রা সুতা দাঁতে লাগিয়ে দু’হাত দিয়ে আবার সেটিকে ঠিক করতে ব্যস্ত হয়। সুরাইয়ার চুল কাটা হয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে। একটু কালার করাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ব্যাগে বাজার করার টাকা ক’টি ছাড়া আর কোনো টাকা নেই। পার্লারের এক কোনায় একটি সেলফে কিছু থ্রি-পিস রাখা আছে বিক্রির জন্য। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে জুনায়েদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে। এই ব্যাটার ভরসায় থাকলে তাকে সারাজীবন এমন ফকিরনী হয়েই থাকতে হবে। হাত দিয়ে সে দু চারটে কাপড় নাড়াচাড়া করে ট্যাগে লেখা দাম দেখে মেজাজ তার আরেক দফা বিগড়ে যায়। যেটি একটু ভালো লাগে সেটিই তিন থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। তার পাশের মেয়েটি এবার তাকে এক রকম ঠেলে জামা-কাপড়গুলোর দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুরাইয়াকে অবাক করে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের দুটি জামা সে কিনে ফেলে।

সুরাইয়া একটু আলাপ জমায় মেয়েটির সঙ্গে। এদিকেই থাকেন আপনি?
হ্যা, ভূতের গলি। মেয়েটি হেসে জবাব দেয়। তারপর ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় থাকেন?
এই তো গ্রিন রোডেই। আপনার হাজবেন্ড কি বরেন? একটু কৌতূহলে সুরাইয়া জানতে চায়। যদিও সে বুঝতে পারে নেহাত বড়লোকের বউ না হলে কি আর এত খরচ করে।
ড্রাইভার। ক্যাব চালায়। বলতে মেয়েটির একটুও কুণ্ঠা হলো না।
কিন্তু সুরাইয়া যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে না। সে তাকিয়ে থাকে গট গট করে চলে যাওয়া মেয়েটির পথের দিকে, অনেকটা থ হয়ে।

শুভ্রা এবার এলোমেলো কাপড়গুলো গোছাতে ব্যস্ত হয়। সুরাইয়ার গা ঘেঁষে এসে নিচু কণ্ঠে বলে, কি ভাবছেন আপু, ড্রাইভারের বউ হয়ে পাঁচ হাজার টাকা দামের জামা পরে কিভাবে? মহিলা আসলে দুই নাম্বার। আমি চিনি ওকে। ভাড়া খাটে। স্বামী অবশ্য ড্রাইভারই।

সুরাইয়া অবাক চোখে শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিকবাদে তার চোখ বিস্ফারিত হতে থাকে যখন সে দেখতে পায় শুভ্রা তার কামিজ সরিয়ে কোমর থেকে রুমাল বের করে তার ঘর্মাক্ত মুখখানা মুছতে থাকে।

সন্ধেবেলা অবনীকে পড়াতে বসে তার দুই গালে ঠাস ঠাস শব্দে দুটো চড় মেরে বসে সুরাইয়া। একটা লেখাও ঠিকমতো লিখতে পারে না মেয়েটা। রাগে তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। কেন যেন পার্লারের ঘটনাটা সে মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। ওই রুমাল জুনায়েদের নাও হতে পারে। যদিও তার নিজের হাতে করা কাজ। চারপাশে চারটি লতা আর মাঝখানে জে প্লাস এস। সবই হুবহু একই রকম। জুনায়েদ ওটি ব্যবহার করে বলে কতবার সে ধুয়ে দিয়েছে। তার ভুলও হবার কথা নয় চিনতে। কিন্তু এই পার্লারের মেয়ের কাছে এই রুমাল কোথা থেকে আসবে। পার্লারের মেয়েরা নাকি দুই নাম্বার হয়। কিন্তু জুনায়েদ ওরকম ছেলে নয়। এমনিতে সে ভীষণ হাড়কিপটে। আরো হাজারটা দোষ তার আছে কিন্তু চরিত্র তার খারাপ নয়। নইলে এত বছরে কিছু না কিছু সুরাইয়ার চোখে ধরা পড়ত। কিছু একটা ভুল দেখেছে সুরাইয়া। দেখা যাবে অফিস থেকে আসলে জুনায়েদের পকেটেই পাওয়া যাবে রুমালটা। শুধু শুধু বাচ্চাটাকে মারল সে।

জুনায়েদ ঘরে ফিরলে সুরাইয়াকে অবশ্যি নিজে থেকে তুলতে হয় না। প্রসঙ্গটা। সুরাইয়ার বিশ্বাসে এক পশলা পানি ঢেলে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে জুনায়েদ বলে ওঠে, আমার রুমালটা দেখছ?

ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একটি বেঞ্চিতে বসে আছে শুভ্রা। তার হাতে একটি লাল গোলাপ। গোলাপটি সে সেই রুমালের ভেতরে গুঁজে রাখে। আচ্ছা সেদিন পার্লারের ঐ কাস্টমার মহিলা তার রুমাল নিয়ে হঠাৎ এত কৌতুহলী হয়ে উঠল কেন। পাগল নাকি মহিলা! ...এই রুমাল তুমি কোথায় পেয়েছ? মহিলা তোতলাতে তোতলাতে ওকে জেরা করেছিল। কেন, আমি সেলাই করেছি। মিথ্যে কথাটি বলতে সে মোটেই দ্বিধা করেনি। আর করবেই বা কেন। সে কি বলবে নাকি তার কাস্টমার বাথরুমে গেলে সে তার পকেট সাফাই করেছে। যে কাস্টমাররা একটু কম টাকায় ঠিক হয়, তাদের পকেট না কাটলে হবে কেন। দু’ হাজার টাকার সঙ্গে সে এই রুমালটাও নিয়ে নিয়েছিল। খানিক বাদে নীরব এসে পাশে বসতেই শুভ্রা হাতের গোলাপ আর রুমালটি তাকে দিয়ে বলে, তোমার জন্য অনেক দিন আগে একটা রুমাল সেলাই করেছিলাম। এই নাও এতে তোমার আর আমার ভালোবাসার নামের প্রথম অক্ষর লিখেছি।

নীরব মুগ্ধ হয়ে রুমালটি মেলে ধরে। সুনিপুণভাবে লেখা, জে প্লাস এস। মানে জীবন আর সাথী। এই নামেই তারা এসএমএসে ভালোবাসা চালাচালি করে।