শাকিল রিয়াজ
শাকিল রিয়াজের দুটি কবিতা
প্রকাশিত : মে ০১, ২০২৪
লুমিনিতা
এই গলিতে কোনো কবির বসবাস নেই
এই মহল্লায় কোনোদিন কেউ এক পঙক্তি স্বপ্ন লেখেনি
কিছু মানুষ অযথাই বসে থাকে নিঃসাড় বারান্দায়
কিছু মানুষ কখনো তাকায় না গৃহে, ভালোবাসায়
কিংবা সামনের জানালায়
যেখানে কার্নিশে ঝুলে আছে এখনো কিছু বরফ
পাখির তায়ের মতো ঝিরঝিরে রেশমি রোদ এসে বরফ গলালে
চুয়ে পড়া পানির ফোঁটায় যে বসন্ত উঁকি দেয়
কেউ খেয়াল করে না এই মহল্লায়।
এই সরু গলি গিয়ে মিশেছে গাড়ির রাস্তায়
ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে কিছু লোক যেদিকে যাচ্ছে
সেখানে শহরমুখি রেল জড়ো হয় যথারীতি
তার পাশের দোতলা স্নিগ্ধ বাড়িটি
ভেঙেচুরে কেমন এক বাইশ তলা হলো।
উন্নয়নের এই চূড়ায় তাকালে আমাদের মাথার টুপি পড়ে যায়, ঘাড় মটকে যায়, চক্কর লাগে চোখে।
মিষ্টি এক স্বৈরাচারীর মতো আমাদের জীবনে
আবহমান হয়ে যায় এই অযাচিত উচ্চতা।
এখানের রাতজাগা টোবাক শপে কোনো কবি এসে জ্বালাতে চায়নি কিছু আকাঙ্ক্ষা
ঝড়ো বাতাসের ফুঁয়ে শূন্যে স্কেচ করতে করতে
কী সব আঁকছে দূর্বাঘাসগণ
এ পাড়ার কেউ মোহিত হয় না এমন অঙ্কনে
এ পাড়ায় কেউ কবি নন।
না আমি না তুমি না সতেরো নাম্বার বাড়ির হেলেনা
যে দোলনায় দুলে দুলে তার ট্যাটুখচিত ফর্সা পা নাড়ায় বিকেল হলে,
না নিচতলার রিকার্ড যার অনিশ্চিত জীবন
নৈরাশ্যের ব্যাকপ্যাকে ভরা থাকে ছয় মাস।
এই মহল্লায় যারা ঘুমোতে আসে রাতে
তারা অর্ধেক হৃদয় রেখে আসে কোথাও
এই মহল্লায় যারা জেগে ওঠে ভোরে
অর্ধেক হৃদয়ের খোঁজে তারা উধাও হয়ে যায় কোথাও।
এই বিপন্নতাকে কেউ ছুঁতে পারে না বলে
আমাদের গলিতে কোনো কবি নেই।
বাইশ তলার নিচে এক রুমানিয়ান ভিখারিনী
তার দুস্থ পরিবারের ছবি দেখিয়ে পয়সা চায় প্রতিদিন
ঝনঝন করে ওঠা কফির মগ এগিয়ে দিলে
আমার কন্যা তার জমানো আধুলিগুলো রেখে আসে মগে।
ভিখারিনী একদিন একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে
আমার কন্যাকে বললো,
—একটি নাম লেখো, ‘লুমিনিতা’। বড় বড় করে।
লুমিনিতা আমার মেয়ে। অনেকদিন দেখি না ছোট্টিকে।
ওর জন্য কেনা ফ্রকের বুকে সেলাই করে তুলবো নামটি।
শাদা কাগজে বড় বড় করে লেখা হলো, লুমিনিতা।
একটি সুঁচ আজ লিখে যেতে পারে
এই মহল্লার প্রথম কবিতাটি।
তুই কেন নাম বলিসনি তোর?
একটা কবিতা হতে পারতো তোর নামে
যদি সাবধানে নামটা শুধু বলে যেতি কানে
তোর দীঘল বাসনা আর বাষ্পরুদ্ধ প্রেম
বেঁচেবর্তে থাকতো কিছু চোখ মোছায়
কিছু পেলব বেদনায়
আমার জীবনকালে।
ইনিয়ে-বিনিয়ে জোর করে
কবিতাকে নিয়ে আসা হতো
তোর নামের ঘেরাটোপে, অর্থের আঙিনায়, বিমূর্তে।
তুই কেন নাম বলিসনি তোর?
উচ্ছ্বল বালিকার মতো বৃষ্টি নেমে আসা দিন
তোর আঙুলেই গুণে গুণে শেষ হয়ে যায়
খড়খড়ে বাতাসের রঙ লাল হয় তোর গাল থেকে ধার নিয়ে
কিছু নিচু দমে ঝড়ের সম্ভাবনা শ্বাস নেয় ভাটির অঞ্চলে।
তুই কেন পা বাড়াসনি তোর?
তোর শান্ত ছাতা উল্টে গিয়ে যেদিকে উড়লো
তুই সেদিকে গেলি না
তুই ছেড়ে আসলি একআধটু জীবন,
তুই উড়িয়ে দিলি একআধটু ঠাঁই, বৃষ্টিপথে।
তারপর কোথায় গেলি তুই?
তুই কেন গ্রাম বলিসনি তোর?
চোট পাওয়া বিকেল গোঙায় টলটলে চোখে
তোর চলে যাওয়া ঝাপসা হয়ে গেলে
সেখানে রঙধনু জাগে দুটি রঙ নিয়ে
তোর চিবুকের শিরশিরে রঙ
তোর ফিরে যাবার পাণ্ডুর রঙ
তুই তাকালি না বলে পাতাঝরা থেমে গেল
তুই তাকালি না বলে বাতাস লুকিয়ে নিলো
তার অবলোকনের চোট, না দেখার ক্ষয়ক্ষতি।
তুই কেন চোখ ফেরাসনি তোর?
তবু ভুল পথে হেঁটে গেলি তুই
জবুথবু রোদের বিলাপ ওঠে পথে পথে
এ পথ তীর্থগামী নয় বলে একবার
ফিরিয়েছিলি চোখ শীতের দিকে
বরফের গলায়মান ভাষা
তোর পা বেয়ে উঠে যায় পাজরের ঘরে
এভাবে একদিন তুই শীতলপাটি হয়ে
আমার উষ্ণ বসার ঘরে বিছিয়ে পড়বি
একদিন তাতে শুয়ে খুব প্রলাপ বকবো
ঠকঠক করে কেঁপে কেঁপে খুব করে মাকে চাইবো।
তুই কেন জ্বর বাধাসনি তোর?
তোর এই বাঁকা জীবন এমন গুল্মলতার মতো মন
সরলরেখাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে পাখি হয়ে যায়
একঝাঁক শীতপাখি, যারা সরলরেখায় উড়ে
আমাদের দৃষ্টিকে মোটা করে দিয়ে দিকভ্রান্ত হয়।
তুই উড়বি বলে আকাশ ফাঁকা রাখি পাহারায়
পতনশীল উল্কাপিণ্ডকে নিভিয়ে দেই ফুঁ দিয়ে
তুই কেন পাখা মেলিসনি তোর?
খুব ভোরে তোর অবিন্যস্ত ঋতু কি খুলেছিল ফিতা?
প্রকৃতির সাইকেলে চড়ে বসে
বেদনা বিলিয়েছিলি কালশিটে দৃষ্টির টর্চ জ্বেলে।
তুইই জানিস কেন একটি ঋতু চিরকাল একা
কোন নদী ভারাক্রান্ত, কোন পথ অশীতিপর
কে শুয়েছে একা একা এই ঘোরতর সন্ধ্যায়
পেঁয়াজবিহীন শাকে একমুঠো ভাত
কে সাজালো লোকমায়? কোন যুবক
বেঁচে যায় দ্বিধা দ্বন্দ্বে?
তুই কেন আত্মহত্যা হলি না তোর?
একটা ঝাপসা বিকেলে
নোনতা হাওয়ায় নাচা দুফোঁটা কুয়াশার মতো
একদিন মুছে যাবি তুই বোধ ও বোধন থেকে
আমার রুগ্ন খাতা থেকে
শিরোনামহীন একটি কবিতা থেকে।
তুই কেন নাম বলিসনি তোর?