শহীদুল জহিরের গল্প ‘ভালোবাসা’
প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০২২
কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের আজ মৃত্যুদিন। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ তিনি মারা যান। ১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা গল্প ‘ভালোবাসা’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
বাবুপুরা বস্তির গলির মুখে আসতেই মওলার চোখে পড়ে গেল হাফিজদ্দি।
কি রে হাফিজদ্দি, এইডা কইথন আনলি? চিৎকার করল মওলা।
মওলা হাফিজুদ্দির প্রতিবেশী। কিঞ্চিত শীর্ণ আর লম্বাটে আদলের চেহারা। আঁকড়া দেবদারুর নিচে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে থাকে পান-সিগারেট সাজিয়ে। হাফিজদ্দি মওলার দিকে তাকায় না। কথার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না।
বস্তির ভেতর বারোয়ারি কলের কাছে হাফিজদ্দি আবেদাকে দেখল। আবেদা ঠিকা-ঝিয়ের কাজ সেরে কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। একটা কে যেন উপুড় হয়ে কলের কাছে মুখ নিয়ে মুখ ধুচ্ছে— পেছন থেকে শুধু একটা বিশেষ ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে। করম আলির কিশোরী মেয়েটা একটা ইটের উপর কী যেন একটা কাচছে। ওর কাছেই আবেদা দুটো জড়ো করা ইটের উপর বসে পিঠ উদোম করে ঝামা দিয়ে কালো গা মাজছে। এ ধরনের দৃশ্য হাফিজদ্দির গা-সওয়া হয়ে গেছে। কাছে না গিয়ে ও দূর থেকেই ডাকে, ওই আবেদা হুইনা যা।
আবেদা চকিতে চোখ ফিরিয়ে দেখল, হাফিজদ্দি ঝুপড়িতে ঢুকে গেল। মাত্র এক ঝলক, তার ভেতরেই ও দেখে ফেলল হাফিজদ্দির হাতের জিনিসটা। দেখে আবেদা অবাক হলো। খেপল নাকি লোকটা। নইলে দিনদুপুরে ফুল হাতে করে বাড়ি ফিরল যে মরদ! আর ওকেই বা ডাকল কেন? ঘরে ঢুকতেই সিনেমার নায়কদের মতো খোপায় পরিয়ে দেবে না তো আবার? তাড়াতাড়ি পানি ঢালা ভিজা চুলগুলো ও খোঁপায় গুছিয়ে ফেলল। আঁশের মতো পাতলা আর তেলহীন রুক্ষ চুলগুলোর কথা ভেবে ওর মন খারাপ হয়। যে ছিরি চুলের, এই চুলে কি ফুল মানায়!
ঘরে না বুতল আছিলো? আবেদা ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করে হাফিজদ্দি।
হ। কী করবা? আবেদা ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে একটা বোতল বের করে। বাম হাতে আলগোছে খোঁপাটা খুলে ফেলে।
এইডা রাখুম। যা পানি ভইরা আন।
আবেদা কল থেকে পানি ভরে আনে। হাফিজদ্দি ফুলের লম্বা ডাটা যত্নের সঙ্গে বোতলের গলা দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। ঘরের আধো-অন্ধকারে প্রকাণ্ড ডালিয়াটার হলুদ রং কেমন অনুজ্জ্বল দেখায়।
সুন্দর না? বলে হাফিজদ্দি।
হাফিজদ্দির মনের সুখ আবেদা বুঝতে পারে। বলে, হ। কই পাইলা?
কলেজের মাঠে। কালকা শহীদ দিবসের লাইগা ব্যাকেই ছিড়তাছে। আমিও একটা ছিড়া আনলাম।
ভালোই করছ। নিজের কণ্ঠের কোমলতায় নিজেই অবাক হয় আবেদা। বলে, আবার বাইরইবা?
হ। দুয়ারে রাখা ঝাকাটার দিকে এগোয় হাফিজদ্দি।
আইছই যহন কিছু খায়া যাও। বলে আবেদা।
হাফিজদ্দি দাঁড়ায়, কী খামু?
ভাত আছে।
ভাত? পাইলি কই? তুই খাস নাই?
না। আমি বিবিসাবের অইহান থন খায়া আছি। মিথ্যে বলে আবেদা। স্বামীর কাছে মিথ্যে বলা এ তার নতুন নয়। হাফিজদ্দি রাজি হয়ে যায়। বলে, তউরা কই গেছে, দেহি না যে?
কী জানি, বয়া খেলতাছে বুদঅয় কুনোখানে।
খেয়াল রাখিস, আবার না হারায়!
হারাইব কই, বলে আবেদা। আমি যাই তুমি যাওনের সময় ঝাঁপ লাগায়া যাইয়াে।
সামান্য কটা ভাত। হুপুস-হাপুস করে খায় হাফিজদি। আবেদা আবার ফিরে আসে, হাতে ভাঙা সিলভারের একটা ডেকচি। বলে, গােসল করা আর হইল না। পানি গ্যাছে গা!
আধভেজা শাড়ি খুলে একটা শুকননা শাড়ি পরে আবেদা। ভেজা শাড়ি দিয়ে চুল মােছে। ধনুকের ছিলার মতাে করে নিয়ে চুল ঝাড়ে চটাস চটাস শব্দ করে। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। হাফিজদ্দি বিরক্ত হয়।
কী মুখের উপরে চুল ঝাড়বার লাগাইছস!
আবেদা উত্তর করে না । ভেজা চুল বিলি কেটে কাঁধময় ছড়িয়ে দেয়। বেড়ার ধারে রাখা ফুলটা নজরে পড়ে। বলে, এইডা দিয়া কী করবা?
কী? কোনডা? হাফিজদ্দি হাত ধােয়। থুতনিসহ লেপ্টে মুখ মােছে ভেজা হাত দিয়ে।
এই। ফুল।
কী করুম!
হেইডাই তাে জিগাইতাছি, কী করবা! বােতলের কাছে বসে ফুলটির নরম মুখে আঙুল বােলায় আবেদা।
কিছুই করুম না। অমনেই থাকব। হাফিজদ্দি লুঙ্গিতে মুখ মুছে উঠে যায়।
শুকায়া যাইব। বলে আবেদা।
হাফিজদ্দি কিছু বলে না। বিরাট মুটে আঁকাটা উঠিয়ে নেয়। যেতে যেতে বলে, দেখিস কেউ যেন চুরি না করে।
হ। মাইনষের ঠ্যাকা পড়ছে তুমার ফুল চুরি করনের লাইগা। বলে হাসে আবেদা।
হাফিজদ্দি চলে গেলে বােতল থেকে ও ফুলটা উঠিয়ে নেয়। আঙুল বােলায় অনেকক্ষণ। চুল খোপা করে তাতে গুঁজতে চেষ্টা করে। ভারী ফুল বারে বারে খসে পড়ে। শেষে হাত দিয়ে খোপার পাশে চেপে ধরে ও ছােট আয়নায় নিজেকে দেখে। ঘরের অন্ধকারে দেখে ওর তৃপ্তি মেটে না। বাইরে আলােয় যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাইরে যাওয়া যাবে না, চারিদিকে লােক, জানে ও।
এমন সময় তহুরা ধূলিধূসরিত অবস্থায় ঘরে ঢােকে।
কী মা? ক্যাডা আনছে?
তর বাপে। খবরদার ধরবি না, মাইরা ফালাইব।
সাহেবের বাসায় বৈকালিক ঘষামাজা সেরে আবেদার ফিরতে ফিরতে দিনের আলাে প্রায় ম্লান হয়ে আসে। আবেদা ফিরে দেখে হাফিজদ্দি দেবদারু গাছতলায় বসে মওলার সঙ্গে গল্প করছে। তহুরা রাস্তার গাড়ি দেখছে বাপের কাছে বসে। মাকে ফিরতে দেখে ও ছুটে চলে আসে।
আবেদা তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করে। পেটের ভেতর খিদে তােলপাড় করছে ওর। রাতের খাবার ডাল আর রুটি। ডাল নামিয়ে রুটি সেকতে সেকতে আঁধার নামে।
কুপি জ্বেলেই আবেদা তহুরাকে পাঠাল হাফিজদ্দিকে ডাকতে। হাফিজদ্দি এলে আবেদা একটা টিনের থালায় ডাল বাড়ল। তহুরাকে দিল একটা বাটিতে। ওরা দুজন কুলাের উপর রাখা রুটি নিয়ে খেতে শুরু করে। আবেদা নিজেও খেতে শুরু করে রুটি ছিড়ে ডেকচির মধ্যে চুবিয়ে চুবিয়ে।
হাফিজদ্দি পায়ের গােড়ালির নিচে এক টুকরাে কাঠ দিয়ে বসে মাথা নিচু করে খায়। তহুরা খেতে বসে ভয়ানক জিনিস নষ্ট করে। আবেদা ধমক লাগায়, অত বড় মাইয়া হইলাে অহনতরি খাওন হিকলাে না!
হাফিজদ্দি মুখ তুলে মেয়ের খাওয়া দেখে । বলে, তুই ফুলে হাত দিছিলি কিয়ের লাইগা?
আবেদা বুঝতে পারে না কাকে বলছে হাফিজদ্দি। বলে, ক্যাডা, আমি?
হ। তয় আর ক্যাডা!
আমি ফুলে হাত দিমু কিয়ের লাইগা! উষ্ণ হয়ে ওঠে আবেদা, যে আমার ঘোড়ার আন্ডার ফুল!
মিছা কথা কইস না। তুই চুলে ফুল গোঁজস নাই?
আবেদা ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বলে, তোমারে এ কথা কইছে ক্যাডা হুনি?
যেই কউক। আমি নিজে ফুলের মইদ্দে চুল পাইছি!
আবেদা বোঝে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু স্বীকার করে নিতেও ওর কেমন অস্বস্তি লাগে। বলে, দুপরে চুল ঝাড়নের সময় হয়তো চুল পড়ছিল ফুলের উপরে।
আবেদা হাসে। হাফিজদ্দি নত মুখে থাকায় ওর চটুল অভিব্যক্তি দেখতে পায় না। তাই খেঁকিয়ে ওঠে, বুড়া মাগি হোয়া মিছা কথা কইস না। মেজাজ খারাপ লাগে।
আবেদা জ্বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে। তহুরাটাকে পেটাতে ইচ্ছে করে ওর। হারামজাদি, একটা কথা প্যাটে থাকে না!
হঠাৎ হাফিজদ্দি বলে, ফুলটা তরে দিয়া দিলাম, যা।
কথাটা এত আকস্মিকভাবে আসে যে, আবেদা চমকাবারও সময় পায় না। বলে, কী করুম আমি অইডা দিয়া?
তর যা মনে লয়।
হাফিজদ্দির গলায় কোনো বাহুল্য কোমলতা ছিল না। আবেদারও সময় ছিল না। তক্ষুনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসার। তবু আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠা-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।
খেয়েদেয়ে আবার একটু ঘুরে আসার জন্য হাফিজদ্দি বেরিয়ে যায়। তহুরা প্রথমে ভয় পায়, একলা পেয়ে মা পেটাবে না তো! তহুরা তো জানে না, বাবা মাকে কী জাদু করে রেখে ঘরের বাইরে গেছে। আবেদা চুপচাপ সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে। তহুরাকে বলে, যা বিছনা পাইড়া হুইয়া পড়।
তহুরা এখনো ঠিকমতো বিছানা করতে পারে না। আবেদা এসে চাটাইয়ের উপর কাঁথা পেতে তহুরাকে শুইয়ে দেয়। গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে গুটিসুটি মেরে শোয় তহুরা। বলে, মা ফুলডা আমি নিমু।
আবেদা হাতের কাজ সারে। দেখে তহুরা তাকিয়ে আছে, কুপির স্লান আলো তহুরার চোখে নরম হয়ে জ্বলছে। আবেদা কাজ শেষে তহুরার কাছে সরে আসে। ফুঁ দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয়। উবু হয়ে আসা আবেদার ঠোঁট তহুরায় কপাল ছোঁয়।