শহর ফোর্টি নাইনার্স
শামীমা জামানপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০১৮
‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’ দেখেছেন? অভিনেতা মাইকেল জে ফক্স টাইম মেশিনে করে উড়ে যায় অতীতের শহরে? ওল্ড স্যাক্রামেন্টো যেদিন প্রথম আমি আসি, নিতান্ত নস্টালজিক হয়ে শৈশবে ফিরে গেছি। না, ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ তো আর আমাদের শৈশব নয়। কিন্তু ওই যে সেবা প্রকাশনী। ওয়েস্টার্ন। সরাইখানা, ঘোড়া, জিন, আউট ‘ল, বন্দুক, হ্যাট, ওভারকোট, আরও কত কী, যা এখানে এসে পেয়ে গেলাম। এই ওল্ড স্যাক্রামেন্টো। আমরা যে অঞ্চলে আছি, গত কয়েক মাস, সেই ন্যাটোমাস থেকে বেশি দূরে নয়। ন্যাটোমাস থেকে নদীতীরের হাইওয়েতে উঠে মিনিট পনেরোও লাগে না ডাউনটাউনে ঢুকতে। ডাউনটাউন সংলগ্ন স্যাক্রামেন্টো রিভার ঘেঁষে ২৮ একর জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৮৪৮ সালের ক্যালিফোর্নিয়া। অবিকল সেই রূপ! রেপ্লিকাগুলোর দিকে তাকালে সেই সময়কে খুব সহজেই ধরে ফেলা যায়। সেই পুরাতন দালানকোঠা দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। দোকানপাট। রেস্তোরাঁ। এমনকি সাইনবোর্ডগুলোতেও কোনও আধুনিকতা গ্রাস করেনি। সেই পুরনো চেহারা যত্ন করে ধরে রাখা হয়েছে। সন্ধে নামতেই চলে মদ আর আড্ডা। শীতল হিম হিম হাত পা কেটে নেয়া ঠাণ্ডায় একটু উষ্ণতার খোঁজে জমে ওঠে সেকালের চেহারায় একালের রেস্তোরাঁগুলো। দলবেঁধে তরুণদের আড্ডা। কোথাও বা ওয়াইন গ্লাস হাতে হো হো অট্রহাসিতে মেতে উঠছে অশীতিপর বৃদ্ধ প্রেমিক তার নতুন সঙ্গীর সাথে। যেন সেই সরাইখানা। সামনে ঘোড়াগুলোও দাঁড়িয়ে আছে। এখনই ঘোড়া থেকে নেমে সরাইখানায় ঢুকে ঠুসঠাস বন্দুকবাজি করবে বুঝি আউট ‘ল রা। মধ্য শতকের পোশাক পরা কোচোয়ান। আছে উন্মুক্ত শরীর সর্বস্ব নারী কোচোয়ান। আর ঘোড়াগুলো! কী সাঘাতিক বডি বিল্ডার লুক। সাদা কাঠের গাড়িগুলোতে সাদা ঘোড়াগুলো। আমি ওই ঘোড়ার পিঠে চড়ব বলতে না বলতেই ছেলে টেনে নিয়ে গেল স্যুভেনির শপে। চমৎকার সব আগ্রহ উদ্দীপক ইতিহাস জাগানিয়া জিনিশগুলোতে চোখ আটকে যায়। রেড ইন্ডিয়ানদের ব্যবহার্য সবকিছু। জাংক জুয়েলরি। পাখির পালকের মুকুটের ছড়াছড়ি। অসাধারণ সব মুখোশ। রেড ইন্ডিয়ানদের জাঁদরেল বন্য চেহারার ছোট ছোট ভাস্কর্য। ফোঁড়ানো নাকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া পাখির শক্ত পালক। কান, গলা, ভুরু, জিহ্বা, সবখানে জাংক জুয়েলরির ছড়াছড়ি। আহা! ওদের চেয়ে স্টাইলিশ জাতি আর কারা গো! কেমন আছে ওরা? পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দেশের আদিবাসী বন্দিরা?
কাঠ বিছানো সেই পুরোনো পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে পথ গায়কের। গায়ে ওভারকোট, মাথায় হ্যাট, রঙিন সানগ্লাসে চোখ ঢাকা, গলায় হাতে একগাদা হাবিজাবি এক্সেসরিজ। সাউন্ড সিস্টেম ফিট করে অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে কান্ট্রি সং। বুড়োটাকে বেশ চেনা চেনা লাগে। মনে পড়ে একে ইউটিউবেই দেখেছি। আর একটু জোয়ান চেহারায়। ঠিক এইখানে এই দোকানপাটের সামনে বসেই সে গান গাইছিল। মায়া লাগে। এদের এই ভিখারিপনাটা ঠিক নিতে পারি না। চাইম-এর ’ভিক্ষা কেমনে চাই রে’ গানটি এই ভাবনা থেকেই করা। একে ঠিক সর্বনিম্ন কত দিলে এর অসম্মান হয় না, ভাবছিলাম। ডাইন, সেন্ট নাকি ডলার?
১৮৪৯ সালে গোল্ড রাশের মধ্য দিয়ে যে নগরীর বেড়ে ওঠা ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী হয়ে, আমেরিকার অর্থনীতিতে উজ্জ্বল অবদান রেখে আজ এই নতুন স্যাক্রামেন্টো ডাউনটাউনের কোণে জীবন্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওল্ড স্যাক্রামেন্টো। পাশাপাশি কতগুলো মিউজিয়াম। রেল রোড মিউজিয়ামে পুরনো সব দশকের ট্রেন ছাড়াও আছে ফিউচার ট্রেন। এক সাদা বুড়ো অবিরাম বকবক করে ইতিহাস বলে যাচ্ছে। হিস্ট্রি মিউজিয়ামেও এমন আরও কতক বুড়ো, সাথে আউট’ল বেশে কজন শক্তপোক্ত গড়নের মাঝবয়েসী লোক বসে জুয়া খেলায় মত্ত। পরনের পোশাক পুরাই ফোর্টি নাইনার্স। কজন মহিলা লম্বা গাউন আর লেসের কুচি দেয়া প্রিন্টেড কাপড়ের ক্যাপ পরে বসে উলবোনায় ব্যস্ত। কাছে যেতেই বকবক শুরু করলো। সেই সময়ের নারীরা উলবোনা ছাড়া আর কি কি করতো, এইসব। আমার এদেরকেও এত চেনা আর আপন লাগছিল! ফেইরি টেইল থিয়েটারের নারী চরিত্ররা। হিস্ট্রি মিউজিয়ামের নিচতলায় দেড়শো বছরের আগের দোকানপাট, কিচেন। কিচেনে তখনকার চিত্র, বাসনকোসন, আসবাব, পুরনো সিংক। দোকানের চেহারায় ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ফুটে রয়েছে। হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সামনের খোলা জায়গায় স্বর্ণ হুজুগের একটা মেলা বসানো। ফোর্টি নাইনার্সদের (স্বর্ণ হুজুগে ভাগ্য ফেরাতে দলে দলে এ অঞ্চলে ছুটে আসা মানুষ) মতোই স্বর্ণ খোঁজায় মত্ত ছোট ছোট বাচ্চারা লাইন দিয়ে চালুনি হাতে পানির মধ্যে বালি থেকে মনোযোগ সহকারে খুঁটে বেছে চলেছে। সত্যিই যেন স্বর্ণ বেছে তুলছে বালি থেকে তারা। আরিককে বললাম, এটা করবা? সে ঠোট উল্টিয়ে বলল, আমি কি বাচ্চা! আর এখন কি গোল্ড পাওয়া যাবে!
এখানেই রয়েছে বিখ্যাত ঈগল থিয়েটার। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম জনপ্রিয় থিয়েটার। বিকেলে ঘোরার জায়গা হিসেবে ওল্ড স্যাক্রামেন্টোর রেল স্টেশন, রেল লাইন ধরে নদীতীরে রেস্তোরাঁ কিম্বা বিখ্যাত ডেল্টা কিং এ ভিড় করে দর্শনার্থীরা। আনন্দ আর ইতিহাস দুটোই এখানে একসাথে মেলে। ডেল্টা কিং এর দু দিকে দুই ড্র ব্রিজ শান্ত নদীর বুকে। ভরপেট লাঞ্চ শেষে দু একটা শিশুর চিৎকারে ফিরে দেখি ড্র ব্রিজ খুলছে। এ দৃশ্য এখন বিরল। এ নদীতে এখন আর সেই দেড়শো বছর আগের মতো বণিকেরা যাতায়াত করে না। একটা সময় ছিল যখন পূর্ব উপকূলের মানুষদের সাথে এখানকার যাতায়াত স্থলপথে অসম্ভব ছিল। এই নদীপথই তখন ভরসা ছিল। আর এখন দু একটা প্রমোদতরী কখনো ভেসে গেলে ব্রিজ তখন বিভক্ত করে দেয় নিজেকে। আবার চলে গেলে মিশে যায়। সেই দৃশ্যই লোকজন এখন গ্রাম থেকে আসা মানুষের মতো অবাক চোখে দেখে। যে শিশুটি চিৎকার দিয়েছিল তার সোনালি চুলের বাবা তাকে কোলে নিয়ে হাত দিয়ে টা টা দেয়াচ্ছে দূরের সেই প্রমোদ তরীর অচেনা মানুষদের। এদেরও অচেনা মনে হয় না। মনে হয়, কোনও বাঙালি পিতা তার পুত্রকে নদীর তীরে এনে লঞ্চ দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস আর সংস্কৃতি আলাদা হলেও আবেগগুলো একই।