শহরে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮
সাতসকালে মোবাইলের টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙলো নোরার। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটা টেনে নিল, বিড়বিড় করে বললো, ছুটির দিনে কে যে এত সকালে ফোন দেয়! মিসড কল লিস্টে রননের নামটা চোখে পড়তেই, চিন্তায় পরে গেল নোরা। রনন জানে আজ ওর ছুটির দিন, কোন ঝামেলা না হলে এত সকালে ফোন!
এবার বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো, স্লিপিং গাউনের ওপরে কোনমতে কোটিটা চাপিয়ে নোরা দৌড়ে গেল বারান্দায়। নিচে রনন দাড়িয়ে, কি ক্লান্ত আর বিষন্ন দেখাচ্ছে ওকে! দরজা খুলতে খুলতে নোরা বললো, কি হয়েছে? ঠিক আছ? বউয়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছ নাকি? রনন একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে, আরে নাহ, তুমি যেমন, চিন্তাও কর তেমন, ছুটির দিন, ভাবলাম, তোমাকে নিয়ে ঘুরি। নাও রেডি হও ঝটপট, আমরা বেরোবো এখনি।
এখনি? এই সকাল ৭টায়? নোরা বিরক্তি দেখালেও মনে মনে ভীষণ চিন্তায় পরে যায়, এটা রননের স্বাভাবিক ব্যবহার না, কিছু একটা ঝামেলা না হলে, এই সাতসকালে ও সেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে আসতো না, কোনদিনও না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নোরা বলে, সে যাব, আগে তুমি একটু বিশ্রাম নাও।
সকালের নাস্তা, মুহিতের অফিস, বাচ্চাদের খাবার দাবার, সব ম্যানেজ করে ওদের বার হতে হতে প্রায় ১১টা বেজে গেল, এর মধ্যে রনন কিছুটা ঘুমাতেও পেরেছে, এখন ওকে অনেকটায় স্বাভাবিক লাগছে, মনে হচ্ছে, বেশ ক`রাত না ঘুমানোর ধকলটা আপাতত গেছে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে, শপিং করে, ওরা যখন ফিরছিল, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
তুমি বাসায় নামার আগে আমাকে চট্টগ্রামের বাস টার্মিনালে নামিয়ে দিয়ে যেও, রননের কথায় ভীষণ রাগ হয় নোরার। সকালের চেয়ে সারাদিন অনেকটায় স্বাভাবিক ছিল রনন, তবে কোথায় যেন একটা ঝামেলা ছিলই, সেটা নোরা হাজার কথা বলেও বার করতে পারে নি। খুব ঝাঁজ নিয়ে বললো, কি তুমি কি আমার সাথে মাঝে মাঝে ইয়ার্কি করতে আস?
রনন আহত ভঙ্গিতে তাকাল, দেখ, আসলে মনটা অস্থির লাগছে, ভাবলাম তোমার কাছে আসলে ভাল লাগবে, আমার এখন বেশ ভাল লাগছে, তাই ফিরে যাচ্ছি। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে, জাহানের কথা জান?
জাহানের কথা উঠতেই নোরার মুখটা কাল হয়ে গেল, বিরক্তিটা এখন চরমে। জাহান নোরার ছোটবেলার বান্ধবী, শুধু বান্ধবী বললে ভুল, অনেকটা বোনের মতো বড় হয়েছে ওরা। জাহানের মা আর নোরার মা ছোটবেলার বন্ধু, তাই ওদের সম্পর্কটাও অনেক গাঢ়।
ভালবাসা ছিল অনেক, একসাথে খাওয়া, বেড়ানো, এমনকি রাতে একই বিছানায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেড়ে উঠছিল ওরা। কিন্তু, একটা সময় জাহানের স্বার্থপর আচরনে নোরা বিরক্ত হয়ে উঠে। কোনদিন টিফিনের বেশিভাগটা খেয়ে ফেলা, ভাঙ্গা জ্যামিতি বক্স পাল্টে নতুনটা নিয়ে নেয়া, স্কুল শেষে ব্যাগটা নোরার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া, এমনকি হোমওয়ার্কটাও নোরাকে দিয়ে করানো।
কিন্ত, ছোট্ট নোরার ম্ন ভেঙ্গে যায়, যেদিন ক্লাস ইলেকশনে জাহান অন্য একটা ছেলেকে ভোট দেয়। নোরা দূরত্ব বাড়িয়ে নেয় নিজেই। তারপর জাহানের বাবার ট্রান্সফার, ওদের স্কুলও আলাদা হয়ে যায়, একসময় যোগাযোগই বন্ধ হয়ে যায়। শহরে মাঝে মাঝে দেখা হলেও, আলাপ হতোনা তেমন একটা।
জাহানকে আবার নোরার মুখোমুখি দাঁড় করায় রনন। রনন আর নোরা হাইস্কুল থেকেই বন্ধু, একটা সময় সেই বন্ধুত্ব একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সবাই ওদের প্রেমিক-প্রেমিকা ভাবা শুরু করতে থাকলে, রনন কেবল পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। রননের ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল নোরা কষ্ট পায় অনেক, তবু নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
মুহিতের সাথে বিয়ের পরের দিন রনন প্রথম নোরাকে জানায়, সে জাহান নামে এক মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছে আর আজ বিকেলেই তাকে সে কথা বলবে। জাহানের সাথে রননের পরিচয় হয়, এক গ্রুপে সুন্দরবন বেড়াতে যেয়ে, সেখানেই রনন ওকে পছন্দ করে ফেলে। সবটা জানার পরে, নোরা রননকে অনেক বুঝতে চেষ্টা করে, এই সম্পর্কটা ভাল হবে না, শেষটায় রনন অনেক কষ্ট পেতে পারে।
সবাইকে নিজের মতো ভেব না নোরা, সব মেয়ে তোমার মতো অহংকারী না, কেউ কেউ ভালওবাসতে পারে, রনন কিসের রাগ উগড়ে দিচ্ছে নোরা বুঝতে পারে না একদম। তুমি কি জেনে বুঝে আমার বিয়েতে ঝামেলা করতে এসেছ নাকি, তোমার প্রেম নিবেদনের সময় কি পালিয়ে যাচ্ছে, আজই এসব নিয়ে কথা বলাটা কি জরুরী, নোরা যতদুর সম্ভব নিজের গলা স্বাভাবিক রাখে। কিন্ত, রননের পাগলামি বাড়তেই থাকে, হ্যা আজই বলতে হবে আমাকে, আমি বললে তোমার কি? তুমি একাই কেবল ভাল থাকবা, আর বাকিরা কষ্ট পাবে?
নোরা আর কথা বাড়ায় না, রননও এ নিয়ে আর কিছু বলে না।
জাহানের বিষয়ে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন আরেকটা ঘটনায় নোরা খুবই বিরক্ত হয়। খবরটা পেয়েই নোরা ছুটে যায় হাসপাতালে, রননের মা নোরাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে, আমাকে মাফ কর মা, তোমাদের ভাল চাইতাম বলে আমি রননকে বুঝাতাম, তাই বলে আমি কি চেয়েছি আমার ছেলে তোমাকে ফেলে জাহানকে ভালবাসুক, ওর এমন ক্ষতি হোক? রনন ফুঁসে উঠে, হ্যা তোমরা সবাই বলেছ, নোরা একটা পাগল মেয়ে...
রনন কথা শেষ করতে পারে না, নোরা ওর গালে জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। মানছি, আমরা সবাই খারাপ, সবাই ভুল করেছি, তাই বলে তোমাকে বিষ খেতে কে বলেছে? আমি নিজে তোমাকে বলেছিলাম, জাহান কোনদিন সিরিয়াস হবে না, ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি, বলিনি?
রননের স্পর্শে নোরা বর্তমানে ফিরে আসে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আবার কি নতুন করে শুরু করেছ নাকি? কি বিষ লাগবে আবার, এনে দিব?
রনন অসহায় ভঙ্গিতে তাকায় নোরার দিকে, আমার কথাটা একবার শোন।
কি শুনবো? এই দ্যাখ, নতুন কোন নাটক করোনা, বউ-বাচ্চা নিয়ে ভাল আছ, ভালই থাক।
রনন বিড়বিড় করে বলে, জাহানের হাজবেন্ড হাসপাতালে, খুব আহত, বাঁঁচবে কিনা বলা যাচ্ছে না, তুমি গিয়ে দেখে আস্তে পার।
নোরা একটু থেমে যায় খবরটায়, অবাক হয়ে বলে, এরজন্য তোমার এত মন খারাপ? এটা আমি বিশ্বাস করবো?
জাহানের ওপরে কোন রাগ থাকলে ভুলে যাও।
না, রাগ থাকবে কেন? সে কোন ছোটকালে কি হয়েছে! তবে ওর একটা সুবিধাবাদী স্বভাব আছে, সেটার জন্য আমি বিরক্ত।
রনন নোরার হাতটা আবার টেনে নেয়, নোরা একটু শান্ত হও, তোমার অনেক খারাপ লাগবে, আমারও লেগেছিল। তুমি আর বিরক্তিও পুষে রেখ না মনে, সব ভুলে যাও।
নোরা অবাক হয়ে তাকায় রননের দিকে, কিছুই বুঝতে পারে না। রনন বিড়বিড় করে বলে, রান্নার সময় কাপড়ে আগুন লেগেছিল।
ওর বর বাসাতেই ছিল, বেচারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নি কোন।
কথাগুলো নোরার কানে যেন দূর থেকে ভেসে আসে, শূন্য চোখে রননের দিকে তাকায়। রনন হাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে পরে। নোরার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠার আগেই রনন সন্ধ্যার অন্ধকার মিলিয়ে যায়।