মাকসুদুল হক মাকসুদ

মাকসুদুল হক মাকসুদ

শরিয়ত বয়াতির মন্তব্য একটা ‘ক্রাইম’, শ্রেণিবৈষম্যের চরিত্র

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২০

শ্রেণি প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে চলা রাজনৈতিক আদর্শ শেষ পর্যন্ত সুবিধাবাদে গিয়েই শেষ হয়। একই রাষ্ট্রে কয়েক মাসের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ দুই শিল্পীকে গ্রেফতার করা হয় ভিন্ন দুই অভিযোগে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বাক-স্বাধীনতা সম্পর্কিত। প্রথমজন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং দ্বিতীয়জন বয়াতি শরিয়ত সরকার। অথচ এই রাষ্ট্রের সিভিল সোসাইটি/বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দুইক্ষেত্রে দুই ধরনের আচারণ করছে! আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের জন্য যতটা আলাপ-আলোচনা-আন্দোলন-আয়োজন হয়েছে, বয়াতি শরিয়ত সরকারের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে উল্টোটাই হচ্ছে।

‘বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই’ এমন বিখ্যাত লাইন গাওয়া শিল্পী ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের দলপ্রধান ও ভোকালিস্ট মাকসুদুল হক মাকসুদ সাক্ষাৎকারে রাইজিংবিডিকে বলেছেন, “শরিয়ত বয়াতি যে কথাগুলো বলেছেন, সে বিষয়ে একজন মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এসবের সঙ্গে বাউল গানের কোনো সম্পর্ক নেই। গান-বাজনা হারাম এটি পবিত্র কোরআনের কথা নয়। এটি কোনো গানেরও কথা নয়। এটি ব্যক্তিগত কথা। শরিয়ত বয়াতি ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন। এজন্য কেউ যদি মামলা করেন তবে আমাদের বলার কিছু নেই। তার এই কথাগুলো যদি বাউল গানে থাকত তবে অবশ্যই আমরা প্রতিবাদ করতাম।”

এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানান, নির্দিষ্ট অপরাধের ভিত্তিতে শরিয়ত বয়াতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাকসুদ বলেন, “আমার গুরু এ বিষয়ে একদম নীরব থাকতে বলেছেন। কারণ এটা বাউল গানের কোনো বিষয় না। এটা শরিয়ত বয়াতির ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তিগত কারণে এই মামলা হয়েছে। আমি সংগীতশিল্পী বলেই অন‌্যায় করে পার পেয়ে যাব, এটা হতে পারে না। এর সঙ্গে বাউল গানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ক্রাইম।”

মাকসুদুল হক যখন ‘এটা ক্রাইম’ এমন বক্তব্য পেশ করেন তখন শ্রেণির প্রশ্ন আরো বড় হয়ে দাঁড়ায়। আর ‘আমার গুরু’, এই গুরুরা কিভাবে গুরু হন সে প্রশ্নও জরুরি। আর কারা এই গুরুদের বন্ধু, সেটাও জটিল প্রশ্ন।

মাকসুদের এই বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশে এত এত নাম করা ব্যান্ড, জেমস, আর্টসেল, অনেক বিখ্যাত গিটারিস্ট আরো কত কী আছে, তারা সবাই চুপ। তাই মাকসুদের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। এরা বয়াতির অপরাধ দ্যাখে কিন্তু বয়াতির পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চুপ, তার আরেক কারণ শ্রেণি চরিত্র। সোজা কথা, বয়াতি গরিব এবং পপুলার নন। তাই তার বাক-স্বাধীনতার মূল্য নাই।

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, তার জন্য সারা দুনিয়ার শিল্পীরা কথা বলবেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তার জন্য দেশেও আন্দোলন হয়েছে, আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। বয়াতি শরিয়ত সরকার কোনো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব নন, ফলে তার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আশা করা যায় না। কিন্তু এই রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী তাকে শহিদুল আলমের মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না।

আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মুক্তির দাবিতে একাধিক ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ-আলোচনা সভা করেছিল, বয়াতির জন্য এমনটা দেখা যায়নি। কবে গ্রেফতার হয়েছেন, কবে মুক্তি পেলেন, মুক্তির পর আবার বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা সবি হয়েছে। বয়াতির জন্য তার এক অংশও হচ্ছে না, এমনকি যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপর, তারাও এই ইস্যুতে প্রায় চুপ।

বাউলশিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করা ১১ জানুয়ারি। আজ ২৮ তারিখ, প্রায় ১৭ দিন হলো। এরই মধ্যে বয়াতি শরিয়ত সরকারের পরিবারের সদস্যদের ‘একঘরে’ করে রেখেছেন তার নিজ গ্রামের মসজিদের ইমাম ফরিদ হোসেন ও কয়েকজন মাতব্বর। পুরো পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার স্ত্রী শিরিন বেগম, পুত্র অনিক (১২) ও যমজ দুই কন্যা অনিকা (৭) ও কনিকা (৭) ঘর থেকেও বের হতে ভয় পাচ্ছে। এসব শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রয়েছে।

বয়াতির ভাই মারফত আলী অভিযোগ করেন, গ্রাম্য কিছু মাতব্বর এবং মসজিদের ইমাম ফরিদ হোসেন তাদের জিম্মি করে রেখেছেন। এদিকে বয়াতি শরিয়ত সরকারকে মামলা থেকে অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে মানিকগঞ্জ, সিংগাইর, রাজবাড়ি, রাজশাহী ও রাজধানী ঢাকায় মানববন্ধন বন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে একাধিক সংগঠন। তবে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বাকিরা এখন শান্ত।

২ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু। এই সময় দেশে বাক-স্বাধীনতার বয়ান বেশি প্রচার হয়। এই সময় নতুন করে সকল মাধ্যমে শিল্পী শরিয়ত বয়াতির মুক্তির দাবি উঠুক। অন্তত আলাপ উঠুক। নামগুলো যেন হারিয়ে না যায়।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও কার্টুনিস্ট