শঙ্খচিলের প্রবন্ধ ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রত্যয়’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০২০
কেন সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী? আমরা আগেই আলোচনা করেছি, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির শ্রম বিক্রি করা ছাড়া বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই। তাই তারা নিজেদের এইরকম দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণিগত বিকাশ চাইতে পারে না। তারা চায় তাদের এই যন্ত্রণাদায়ক শ্রেণিগত অবস্থার অবলুপ্তি। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থার অনিবার্য অংশ হিসেবে তারা দেখতে পায় তাদের মেহনতে তৈরি সমস্ত সম্পদ, অথচ তা থেকে তারাই বঞ্চিত। কারণ উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকতা সত্ত্বেও তাদের এই শ্রেণিগত দুর্দশার জন্য দায়ী উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তি মালিকানা। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারায় সর্বহারা শ্রমিক তৈরির যন্ত্র প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বজায় রেখে তাদের শ্রেণি অবলুপ্তি বা মুক্তি সম্ভব নয়। অতএব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাসহ সমস্ত শ্রেণি অস্তিত্ব ধ্বংস করে সাম্যবাদী সমাজ তৈরির পথই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির একমাত্র পথ। এই বিপ্লবী দায়িত্ব নিয়েই শ্রমিক শ্রেণি রঙ্গমঞ্চে হাজির হয়েছে বিপ্লবী সর্বহারা হিসেবে। আর মার্কসবাদ যেহেতু শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির এই মতাদর্শ হাজির করেছে, তাই তাহলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণিসহ সমগ্র মানব জাতির শোষণ মুক্তির মতবাদ। স্তালিন বলেছেন, মার্কসবাদ হলো শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তি।
শ্রমিক শ্রেণির এই বিপ্লবী মতাদর্শ নিয়ে এত কথার কারণ কি? কি বলে লেনিনবাদ? দেখা গেল, মার্কসবাদকে শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব বললে তার বিপ্লবী শিক্ষাকেই হেয় করা হয়। বুর্জোয়ারা এমনটাই চায়। তাই কমরেড লেনিন বলেছেন, ‘সেই শুধু মার্কসবাদী যে শ্রেণি সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা একনায়কত্ব পর্যন্ত প্রসারিত করে।’ আর দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে তার এক উপযোগী বিপ্লবী পার্টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন লেনিন। তাকে মার্কসবাদের সফল প্রয়োগের জন্য তত্ত্বে ও প্রয়োগে মার্কসবাদের বিকাশ সাধন করতে হয়। তিনি শ্রমিক শ্রেণির প্রধান সংগঠন হিসেবে পার্টির ভূমিকা ও নীতি-পদ্ধতি তুলে ধরেন তার বিখ্যাত ‘এক পা আগে, দু’পা পিছে’ নামক বইয়ে। একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হলে শ্রমিক শ্রেণির কী ধরনের পার্টি গঠন করতে হবে লেনিন তার নীতিমালাগুলো গড়ে তুলতে থাকেন।
লেনিনিয় এই শিক্ষা আকাশ থেকে পরেনি বা এ লেনিনের ব্যক্তি প্রতিভারও ফল নয়। শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মতবাদ মার্কসবাদের শুরু থেকেই তার বিকাশ ও শ্রমিক বিপ্লবে তার সফল প্রোয়োগের ঐতিহাসিক ধারায় গড়ে ওঠে লেনিনবাদ। যা মার্কসবাদের শুরুর থেকেই মার্কস, এঙ্গেলসের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ফলাফল থেকে উঠে এসেছে। মার্কস নিজে প্রথমে ‘জার্মান শ্রমিক সমিতি’ গঠন করেন এবং পরে ‘কমিউনিস্ট লীগ’ নামে এক গোপন প্রচার সমিতিতে যুক্ত হন। ১৮৪৮ সালে এই সংগঠনের দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকেই মার্কস-এঙ্গেলস সুবিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ প্রকাশ করেছিলেন। এর বিলুপ্তির পর তারা ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ গড়ে তোলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর বার্নস্টাইন-কাউটস্কির মতো নেতারা মার্কসবাদকে সময়পযোগী সংশোধনের নামে তার বিপ্লবী মর্মবস্তু বাদ দিয়ে তাকে শত্রু শ্রেণির উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। বার্নস্টাইন মার্কসের পুঁজির কেন্দ্রীভবণ ও শ্রমিকের ক্রমাগত গরিব হয়ে পড়ার কথা মানতেন না। শ্রেণি সংগ্রাম, বল প্রোয়োগের তত্ত্ব ও তার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ত্ব তিনি অস্বীকার করতেন। পুঁজিবাদ ভেঙে পড়বে বলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, সংস্কারমূলক ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলে যাবে। শ্রমিকের কাজ সংস্কার সাধন, চূরান্ত লক্ষ্য বা বিপ্লব এবং সর্বহারা একনায়কত্ব ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন নেই। আন্দোলনই শেষ কথা। তিনি তার বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র বইয়ের মাধ্যমে এই মতবাদ তুলে ধরেন। মার্কসবাদীরা তাই বার্নস্টাইনকেই সংশোধনবাদের জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই মতবাদকে অর্থনীতিবাদী বা বিবর্তনবাদীও বলা হয়। এরপর বিভিন্ন রূপের সংশোধনবাদের সঙ্গে লড়াই করেই বিপ্লবী মার্কসবাদীদের পথ চলতে হয়েছে।
কমরেড লেনিন এই সমস্ত ভূল চিন্তা ভাবনার বিরুদ্ধেই ‘কী করিতে হইবে’ শীর্ষক পুস্তকের মাধ্যমে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণ শ্রমিকশ্রেণি থেকে পার্টির পার্থক্য আছে। পার্টি হলো শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামীদের বাহিনী। শ্রেণি চেতনায় সজ্জিত মার্কসবাদী বাহিনী। কেউ শ্রমিক হলে বা ধর্মঘটে যোগ দিলেই সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারে না। আবার তথাকথিত মার্কসবাদী পণ্ডিত হলেও চলবে না। বিপ্লবী রীতি-নীতিসহ অনুশীলনে পরিক্ষীত সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠবে বিপ্লবী পার্টি। যাতে সাধারণ শ্রমিক ও পার্টি সদস্যর পার্থক্য গুলিয়ে না যায়। সুতরাং পার্টি হলো শ্রমিক শ্রেণির অগ্রসর অংশ। যারা মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় সজ্জিত।’ পার্টি গঠন ও কাঠামো সম্পর্কে লেনিনের মত ছিল, ‘পার্টির দুটো অংশ থাকবে। ক. নেতৃস্থানীয় নিয়মিত কর্মীদের নিয়ে একটি ঘনবদ্ধ চক্র। যারা মূলত সেই পেশাদার বিপ্লবী, দৃঢ় সুশৃংখল, অর্থাৎ যারা পার্টির কাজ ছাড়া আর কিছু করেন না এবং যতটা দরকার ততটা মার্কসবাদী জ্ঞান, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও শত্রুর পুলিশকে পাল্লা দেওয়া ও এড়িয়ে চলার জন্য গোপনে পার্টি কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। এবং খ. স্থানীয় পার্টি সংগঠনগুলির বিস্তৃত জাল এবং অসংখ্য এমন পার্টি সভ্য যারা লক্ষ লক্ষ মেহনতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন প্রাপ্ত। যাদের মাধ্যমে সমগ্র নিপীড়িত জনগণ পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তিনি বলেন, ‘পার্টির সভ্য সে-ই হতে পারবে যে ব্যক্তি পার্টির কোনো না কোনো সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকবে, পার্টিকে চাঁদা দেবে। পার্টির কোনো সংগঠনের সাথে যুক্ত না হয়ে পার্টি সদস্য হওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পার্টিকে হতে হবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনী, সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের সমন্বয় সাধনে ও পরিচালনায় ব্রতী, পুঁজিতন্ত্রের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই হলো পার্টির চরম লক্ষ্য।’ এই লক্ষ্যে একটি সঠিক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার জন্য লেনিন প্রথমে রাশিয়ায় ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’, পরে ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি’ গঠন করেন। কিন্তু বার্নস্তাইনপন্থী অন্যান্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যারটদের থেকে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আলাদা করতে তিনি তার বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ দলিলে সুনির্দিষ্টভাবে সোশ্যাল ডেমোক্রাট নাম পরিবর্তন করে কমিউনিস্ট পার্টি রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়া (বলশেভিক)। সেই থেকে সোশ্যাল ডেমাক্র্যাটদের থেকে কমিউনিস্টদের সুস্পষ্ট বিভাজন হয়ে যায়। যাবতীয় ভুল ও সুবিধাবাদি শক্তির সঙ্গে জটিল ও বহুমাত্রিক সংগ্রাম চালনার বৈজ্ঞানিক উপায় হিসেবে ১৯১৬ সালে অনুষ্ঠিত রাশিয়ান পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে পার্টির প্রতি সদস্য, প্রতি ইউনিট এবং প্রতি সংস্থার জন্য অবশ্য পালনীয় ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সাংগঠনিক নীতিমালা গৃহীত হয়। যে নীতিমালা ছাড়া মতপার্থক্যসহ পার্টি পরিচালনা অসম্ভব। এটাই হলো লেনিনবাদী পার্টি-নীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই হলো বিপ্লবী পার্টি পরিচলনায় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ঐতিহাসিক তাৎপর্য।
এর থেকে কি শিক্ষা উঠে আসে? এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী মতাদর্শকে প্রথম দিন থেকেই শ্রেণি সমঝোতার মতবাদ বা সংশোধনবাদের বিপদের সঙ্গে লড়াই করেই এগোতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, তা হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব শিবির থেকেই। শ্রমিক দরদী, তার সংগঠন ও তার নেতাদের মুখোশের আড়ালেই। শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শ ও তার সংগঠনকে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন শ্রেণির যুতসই, আহ্লাদের বিষয় করে গড়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রামে। তাই কমরেড মাও সে তুং শিখিয়েছেন, সংশোধনবাদের এই বিপদ শ্রেণি বিভক্ত সমাজের প্রতিফলন রূপে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরের একটি সংগ্রাম হিসেবে সম্পূর্ণ সাম্য ব্যবস্থা অর্জিত হওয়া অবধি থাকবে। যার বিরুদ্ধে সঠিক বিপ্লবী লাইনের অব্যাহত সংগ্রামই মার্কসবাদীদের লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র পথ। যাকে মাও বলেছেন দুই লাইনের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম চলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার বৈজ্ঞানিক নিয়মে। আমরা দেখলাম সংশোধনবাদের সঙ্গে সংগ্রাম করেই এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার লেনিনবাদী নীতি গড়ে উঠেছে। সুতরাং এর বিরোধীতা মানে মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিরোধীতা ও সংশোধনবাদকে মজবুত করার সামিল।
এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার বিপক্ষে ঝুঁকিটা কি? আমরা জানি, শ্রেণি আধিপত্য ও সেই জন্য অল্প লোকের কর্তৃত্বের ধারণা তো শোষণমূলক ব্যবস্থারই অবদান। যা হাজার হাজার বছরের অভ্যেসে পুরো সমজটাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যা আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বে পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি পুরো সমাজটারই ঘনীভূত রূপ তাই পার্টিতেও সমাজের বাস্তব দোষ গুণের প্রতিফলন হিসেবে আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সংক্রমণ দেখা দেয়। যা আসলে একটি বুর্জোয়া মতাদর্শ। সঠিক বোঝাপড়ার অভাবে অনেকেই একে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। যার সুযোগে ঝানু সুবিধাবাদীরা খোদ একেকটা আমলাতান্ত্রিক কর্তা হয়ে উগ্র গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া স্বাতন্ত্রবাদের আখড়া বানাতে চায় পার্টিকে। আর আমলাতান্ত্রিক কর্মপ্রক্রিয়ার বারংবার পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে হতাশার প্রকাশ হিসেবে দেখা দেয় মতান্ধতাবাদী হঠকারিতা। যা আসলে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অজুহাতে তাকেই শক্তিশালী করে। তাই কমরেড মাও আমলাতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, একদিকে আমলাতান্ত্রিক শ্রেণি আর অন্যদিকে গরীব ও মাঝারি কৃষকসহ শ্রমিকশ্রেণি হচ্ছে পরস্পর যুযুধান দুটি শ্রেণি। চলবে