শঙ্কা

ফারুক ইমন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০১, ২০১৭

ছোট্ট ছেলেটি ঝুনঝুনি পায়ে ঘরময় ছুটে বেড়ায়। শহরের দমবন্ধ ঘরে সকালের তেড়ছা রোদের ফালি খণ্ড খণ্ড হয়ে মেঝেতে লুটোপুটি খায়। জহুরা উলের সোয়েটার বুনতে বুনতে ছেলেকে দ্যাখে। দ্যাখে আর ভাবে, সম্বিত পেয়ে আবার বোনায় মন দ্যায়।
দেড় বছর বয়সের তিলক দেখতে না মায়ের মতো, না বাবার মতো। তার আচরণের চপলতা জহুরা নিজের শৈশবে খুঁজে খুঁজে পায় না। জহুরার মনের খুব গহীনে একটা তীব্র শঙ্কা কাজ করে। কিন্ত সে কোনও মতেই সে শঙ্কাকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়। মনে ভাসতেই তা সরিয়ে দ্যায়।
তিলকের বাবা চাকুরে। বেকুব ধরনের মানুষের ভান ধরে স্বস্তি বোধ করে। চাকুরে স্বভাবের বাইরে সে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তিলকের বাবার ধারণা, চোখ আর কান দুটো হুবহু তার মতো হয়েছে। জহুরা এতে প্রতিবাদ করে না। জহুরার সাথে তিলকের বাবার সম্পর্ক অনেকটা যান্ত্রিক। তাদের পরস্পরের প্রত্যশা সীমিত। খুবই আপেক্ষিক। তাদেরকে দেখলে সুখি দম্পতিই মনে হয়। ছুটির দিনে তারা শহরের কোথাও নিয়ম করে বেড়াতে যায়। আইসক্রিম, ফুস্কা খায়। এই রুটিন তাদের বিয়ের পর থেকে হেরফের হয়নি। খুব দরকার না পরলে জহুরা বাসা থেকে বেরোয় না। তিলক হওয়ার পর থেকে তার বাইরে বেরোনো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আজকাল জহুরা খুব মুটিয়ে যাচ্ছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে খুব বিরক্ত হয়। নিজেকে চিনতে পারে না। নিজের চোখের প্রতিবিম্বের ভেতর ডুব দিয়ে খুঁজে চলে ধারালো সেই মুখখানি। ঘোলা স্মৃতির ভেতর থেকে ধারালো মুখটি দেখা দিয়েই ফের মিলিয়ে যায়। জহুরার খুব কষ্ট হয়, সে কাতর হয়ে ওঠে।
আয়না ছেড়ে উঠে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় জহুরা, চুমু খায়। কষ্টগুলো মুছে ক্ষণেই মা হয়ে উঠতে চায়। চিরায়ত এক সত্তার মতো মাতৃত্ব ছড়িয়ে দ্যায় স্মৃতির সকল ক্ষতজুড়ে। পাওয়া না-পাওয়ার সকল হিসেব শুধরে নিতে চায় মাতৃত্বের বিনিময়ে। কণ্ঠ ভিজে আসে তার। বন্ধ চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে। ছেলেকে খাবার খাইয়ে জহুরা বই নিয়ে বসে। গতরাতে একটা গল্পের অর্ধেকটা পড়েছে, আধপড়া গল্পে তার মন বসে না। আজ তার সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে হয়। আজ একজোড়া পুরোনো চোখ তার খুব মনে পড়ে। কোনোভাবেই সরাতে পারে না। নভেম্বরের দুপুর তার অন্তরাত্মায় মুখটি ঢুকে যায়। নিমেষেই খাঁ খাঁ এক প্রান্তর হয়ে ওঠে বুকের ভেতরটা। সেই প্রান্তরে থোকায় থোকায় ভরা একটা কাঠগোলাপের গাছের নিচে বিনাশী চাউনি নিয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে সে চেনে। দূরপরাহত সেই চোখ জহুরা সইতে পারে না। জানালা দিয়ে আসা এক ঝটকা বাতাসে সে চমকে ওঠে। গহীন শঙ্কায় জেগে ওঠে সে। ভয়ে ভয়ে তিলকের দিকে তাকায়। তিলক মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। তার গোলাপি মাড়িতে একজোড়া দুধসাদা মাণিক্যের আভাস টের পাওয়া যায়।