লুৎফর রহমানের প্রবন্ধ ‘সাহিত্য, মানুষ ও সমাজ’

প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০২৩

সাহিত্যের কথা বলতে গেলে জানতে হবে শিল্প কী? বস্তুজগতে মানুষ যা দেখে তা প্রাকৃতিক। কেউ যদি এর ছবি তোলে তো সেটা আলোকচিত্র। কেউ যদি প্রাকৃতিক কিছুকে নিজের মনের মধ্যে নিয়ে বিমূর্ত করে আপন হৃদয়ের রঙ মিশিয়ে বাইরে এনে প্রকাশ করে সেই মূর্ত বিষয়টি তার নিজস্ব হয়ে যায়। এমন ব্যক্তিগত বিষয় যখন মানুষের কাছে ‘আমাদের‘ বলে অনুভূত হয় তখনই সেটা শিল্প হয়। শিল্পের লক্ষ্য সবসময় শুভ, কোনো সময় অশুভ না। শিল্প যারা সৃষ্টি করে তারা শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টিকেই বলে শিল্পকলা। সাহিত্য এমন একটি শিল্পকলা।

 

শিল্পী আমাদের জাতীয় সংসদের গৃহ নির্মাণ করে, সে স্থপতি। শিল্পী রেখা-রঙে মোনালিসাকে আঁকে, সে চিত্রশিল্পী। শিল্পী ভঙ্গি দিয়ে, অঙ্গ সঞ্চালন করে আঙ্গুলের মুদ্রার মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করে, তার নাম নট-নটী। শিল্পী কণ্ঠের মাধ্যমে তাল-লয়ের ভেতর দিয়ে সুর সৃষ্টি করে, সে সুরকার। আর শব্দ ও পদবিন্যাসের মাধ্যমে মানুষকে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকাশ করে যে শিল্পী তাকে বলা হয় কথাশিল্পী। সাহিত্য হচ্ছে শব্দ ও পদবিন্যাসের শিল্পকলা। স্তরে স্তরে সাজানো কথার পর কথা, যেমন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, আলাওল, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, বিহারীলাল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ, রোমাঁ রলাঁ, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, গোর্কি, মায়কভস্কি, এমন আরো বহুজনের সাজানো শিল্পময় কথাই সাহিত্য। সাহিত্যের সিদ্ধিযন্ত্র হচ্ছে কথা।

 

চিত্রশিল্প, সংগীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এগুলো শিল্পকলার আরো শাখা। দেখা যায় অনেক সময় সাহিত্য এসব শিল্পকলাকে নিজের মধ্যে অঙ্গিভূত করে নেয়। কোনো উপন্যাসের ভাষা এমনই হয় মন বলে যেনো সেখানে সুরের স্পর্শ আছে। এমনিভাবে অন্যান্য শিল্পকলারও মিশ্রণ ঘটে যায় সাহিত্যে। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে সাহিত্যিক মূলত শব্দশিল্পী। তাকে শব্দ সাজিয়েই সাহিত্যের উৎকর্ষ বাড়াতে হয়।

 

সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণে আরো একটি শব্দ এসে পড়ে, সেটা মানবতা। শব্দশিল্পীকে মানুষের মানবীয় প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে কারবার করতে হয়। শিল্পীর সৃষ্টির মাঝে মানবতার অনুপস্থিতি একে সাহিত্য পদবাচ্য করে না। তাহলে মানবতা কি সেটা আমাদের জানতে হয়। যেসব গুণাবলি পশুস্তর থেকে মানুষকে আলাদা করেছে সেসবই মনুষ্যত্ব, সদগুণ, মানবতা। মানবতা মানুষকে জীবনমুখী করে। মানুষের শ্রম-ভাষা-চিন্তা এই সদগুণগুলোকে সামনের দিকে পরিচালিত করে তাকে সংগঠিত করে এবং প্রেমের শক্তি ছড়িয়ে সৃষ্টিতে মাতিয়ে তোলে। মানবতার মাধ্যমেই মানুষ তার সকল আদিম প্রবৃত্তিকে শাসন করতে শিখেছে, জীবনের বিকাশের জন্য যা অপরিহার্য।

 

এবার হয়তো আমি সাহিত্য কী বিষয়টা সহজ করে বলতে পেরেছি। কিন্তু আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বিষয়টা আসলে এতো সহজ নয়।

 

পাঁচ হাজার বছর হয় পৃথিবীতে কথাশিল্পীরা ছোট-বড় অনেক বই লিখেছেন। কিন্তু আমরা সবগুলোকে শিল্পকলার স্বীকৃতি দিতে পারি না, আমরা তাদের একই মূল্যে কদর করি না। কোনো বইয়ের লেখার সময়টাতে প্রচণ্ড আবেদন ছিল, একদিন তা অগণিত হৃদয়কে আন্দোলিত করেছিলো, কিন্তু সেটি আজ আমাদের রস বিচারের মানদণ্ডে টেকে না। শেক্সপিয়ারের কোনো গ্রন্থ, রবি ঠাকুরের কোনো কবিতা পড়ে এখন বলি এর সার্থকতা কি? অতি সাধারণ বিষয় নিয়ে শত শত পৃষ্ঠার বড় আকারের বই লেখা হয়েছে। এই বৃহৎ আকৃতি নিয়ে কোনো জ্ঞানী মানুষ পরিহাস করলেও পাঠকের এমন বলার প্রয়োজন পড়ে না। এখনো সব বই গ্রন্থাগারে পাশাপাশি আছে। বইটিকে যুগোত্তীর্ণ করতে হলে শিল্পীর সংযম, পরিমিতিবোধ থাকা প্রয়োজন। কথার মাধুর্য, আলোড়ন, বেগ, পরিচ্ছন্নতা এসব যে পরিবর্তনশীল এ ধারণাও তার থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ গতিশীলতা যে সাহিত্যের মূল বিষয় শিল্পীর বোধে তা থাকবে। গতিশীলতার জন্যই সাহিত্যের নানা রূপ হয়, বিবিধি ধরনের বিস্তার হয়।

 

সাহিত্যের উপকরণ সম্পূর্ণরূপে লৌকিক, এটা একটা মত। অন্য একটি মত, সাহিত্য নিজেই নিজের পরিচয়। কখনো সাহিত্যে নিরপেক্ষতার উপাদানটির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারো মতে মনস্তত্ত্ব হচ্ছে সাহিত্যের একটি স্থায়ী সূত্র। পরিধির কথায় বলা হয়েছে, সাহিত্যের বিষয় বিশ্ব জগতের মানুষ। এমন খণ্ড ধারণা এবং বিশ্ব জগতের মানুষ অর্থাৎ অংশ ও সমগ্র নিয়ে সাহিত্যের দ্বান্দ্বিকতা।

 

সাহিত্যের গতি পরিণতির কথা বলতে গিয়ে আমরা দেখি এর নাড়ির বন্ধন আছে অন্যান্য শিল্পকলার সাথে, সংস্কৃতির সাথে, মানবতার সাথে, সমগ্র মানব সমাজের গতি ও বিকাশের সাথে। তাই আমরা যদি সাহিত্যকে বোঝতে চাই তাহলে সমগ্র মানবসমাজের বিকাশকে বোঝতে হবে। জানতে হবে সংস্কৃতির সৃষ্টির পেছনে যে কাজ করেছে মানুষের শ্রম সে বিষয়ে, জানতে হবে মানবীয় প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতিকে, মানবদেহকে। আরো জানতে হবে চেতনার স্বরূপকে। তারপর জানতে হবে এ সবকিছুকে নিয়ে প্রকৃতিকে। এটাই সাহিত্যের সামগ্রিকতা।

 

সমাজ বদলে যাচ্ছে, নতুন সমাজের নতুন মানুষ, সবকিছুকে মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে জীবনকে গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসছে। আমরা তাই মানবসমাজ, সংস্কৃতি, চেতনা এবং মানবদেহকে নিয়ে পরিবেশের ইতিহাসসম্মত ও পরস্পরনির্ভর গতি প্রকৃতি যদি বোঝতে না পারি তাহলে সাহিত্যের জিজ্ঞাসার কোনো কিনারা করতে পারবো না। আমাদের সাহিত্য চিন্তায় একটা সামগ্রিক পটভূমি তাই আনতেই হবে।

 

দ্বন্দ্ব ও ঐক্য: মানুষ একটা সময় পর্যন্ত প্রকৃতির অন্যান্য জীবের সাথে মিশে ছিল। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির ক্রমবিকাশের অংশ হিসেবে এক সময় অন্যান্য জীব থেকে আলাদা হয়ে গেল। এই আলাদা হতে কিছু উপাদান কাজ করেছে, এর একটি হচ্ছে, জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার। দ্বিতীয়টি হচ্ছে চেতনা। হাতিয়ার ও চেতনাকে ব্যবহার করে মানুষ পশুস্তর থেকে আলাদা হয়ে দল বেঁধেছিল আদিম কালেই। এই দলই ছিল মানুষের আদিম সংগঠিত সমাজ, তৃতীয় উপাদান যা তাদেরকে পশুদল থেকে আলাদা করেছিল। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের ক্রমবিকাশের পথে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে হাতিয়ার, চেতনা ও সমাজ এই তিন উপাদানের। এই তিনের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব আবার বিকাশের পথে সমগ্র ধারায় রয়েছে ঐক্য। এই দ্বন্দ্ব ও ঐক্যই মানুষের বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে।

 

শ্রম: মানুষের, মানুষ হওয়ার পেছনে যে উপাদানটি মূলগতভাবে কাজ করেছে সেটি তার শ্রম। শ্রম হচ্ছে মানুষের সচেতন ও উদ্দেশ্যপূর্ণ মানবিক কাজের একটি প্রক্রিয়া। শ্রমের সাহায্যে মানুষ প্রাকৃতিক বস্তুগুলোকে পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনই মানুষের বিকাশে সহায়ক শক্তি। মানুষের শ্রমকে অধিকতর সহায়ক করেছে হাতিয়ার। হাতিয়ার আয়ত্বে আসার পর মানব সমাজ অন্যান্য জীবকে সরাসরি ছাড়িয়ে গেছে। সে তার ক্রম অগ্রগতিকে নিশ্চিত করে চলেছে। প্রকৃতির নিকট থেকে চলার ও খাওয়ার উপকরণ সংগ্রহের জন্য মানুষ প্রকৃতির নিকট থেকেই হাতিয়ার বের করে নিয়ে এসেছে। হাতিয়ারের উন্নতি করতেও শিখেছে; যেমন, শিকারের জন্য পাথরের অস্ত্র, ভারি জিনিস সামলানোর যন্ত্র, গলানোর জন্য আগুন, তারপর চাষের জন্য লাঙ্গল। এ সব হাতিয়ার বানানো ও ব্যবহার করার শ্রমকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে দলবাঁধা মানুষের পরস্পর সম্পর্ক এবং সংগঠন, অর্থনৈতিক সমাজ। হাতিয়ার উন্নত হওয়ার সাথে সাথে নতুন হাতিয়ার এলে দেখা গেছে মানুষের অর্থনৈতিক সমাজের রূপান্তর হয়ে যায়। এখানে যে কথাটা জোর দিয়ে বলতে হয়, মেহনত বা শ্রম ছাড়া সকল হাতিয়ার ব্যর্থ তা সে যতো উন্নতই হোক। মানুষের আদি সমাজে মানুষের গতরের জোরই ছিল প্রধান যার উপর নির্ভর করতে হতো। বর্তমান সমাজ যন্ত্রপ্রধান হয়ে গেছে। তবু শ্রম অপরিহার্য কারণ মানুষের শ্রমে যন্ত্রের জন্ম এবং শ্রমই যন্ত্রকে সচল করে।

 

মানুষের অন্তর্লোক ও সমাজ সংগঠন: আমরা যদি মানুষের সমাজের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করি দেখা যাবে, মানবসমাজ সক্রিয় হয় বিভিন্ন ব্যক্তির ঐক্যবদ্ধ কাজের মাধ্যমে অর্থাৎ সামাজিক শ্রমের মাধ্যমে। মানুষ অন্যান্য জীব থেকে আলাদা হলেও মানবদেহ একইভাবে গঠিত, বিভিন্ন ব্যক্তির শারীরিক ধরন একই। রঙ সাদা-কালো যা-ই হোক, খুলি-চোয়ালের আকৃতি যেমনই হোক, মানুষের সাধারণ মানবিক উপাদানগুলো সবার মাঝে বিদ্যমান। এই ঐক্যের কারণে কোনো কাজে নানা লোক তাই এক ধরনের প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করে। এ বিষয়টি সামাজিক। অন্যান্য জীবের এই প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতি দেহগত। রক্ত মাংসের দেহের দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, মানুষ অন্যান্য জীব থেকে খুব বেশি আলাদা না। তবে আদিম কালেই মানুষের দৈহিক স্বভাবে পরিবর্তন এসেছিল। অন্যান্য জীবের মতো মানুষের পাঁচ ইন্দ্রিয় চালু থাকলেও পরিবর্তনের ধারায় শুধু তার দেহ বদলায়নি, অন্তর্লোকও বদলেছিল। এই অন্তর্লোক বদলের পেছনে কাজ করেছিল সক্রিয় মানুষের বিশেষ সমাজ সংগঠন।

 

প্রকৃতি-মানুষ-সংগঠন: প্রকৃতির সাথে অন্যান্য জীব যেমন সরাসরি সংযোগে সক্রিয় হয়, প্রকৃতি ও মানুষের বেলায় সেরকমটা হয় না। প্রকৃতির ডাকে মানুষ সরাসরি সাড়া দেয় না। কিন্তু পশু-পাখি দেয়, সে অপেক্ষা করে না কারো সম্মতির জন্য। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না, প্রকৃতির সাথে মানুষের যোগাযোগ হয় সমাজ মারফত, অন্যান্য জীবের মতো খালি চোখে প্রকৃতিকে দেখে না মানুষ, দেখে সমাজের চোখে। সুদূর অতীত থেকে মানুষ এভাবে একসাথে দেখে আসছে কারণ মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এখানে অর্থনীতি একটা বড় ফ্যাক্টার। প্রকৃতির সাথে মানুষের যোগাযোগ চলে অর্থনৈতিক সমাজ মারফত। সে জন্য মানবীয় প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতিতে আসে একটা যোগসূত্র, সংগঠন।

 

অন্যান্য জীবের প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় প্রকৃতির দ্বারা, এরা প্রকৃতির অধীন। মানুষ কিন্তু আদিম যুগেই এখান থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা আত্মনিয়ন্ত্রণ লাভ করে। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে জয় করে চলেছে। মানবদেহ নিজস্বতা অর্জন করেছে। সেটা সে করতে পেরেছে অর্থনৈতিক সমাজ সংগঠিত করে। সুতরাং মানবদেহ নিয়ন্ত্রণের ধারাটি পশু-পাখির মতো না, সেটি তার নিজস্ব এবং অভিনব।

 

চেতনা, শিল্পকলা, বিজ্ঞান এবং ভাবাদর্শ: আলাদা আলাদা মানুষের পৃথক দেহগত প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভূতিকে সমাজ একসাথে গাঁথে মানুষের জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার আর চেতনা দিয়ে। চেতনা ইন্দ্রিয়গত। শ্রমের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক এক উন্নত পর্যায়ে সেজেছে। এই উচ্চভাবে সাজানো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারাই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে যোগাযোগ হয়। সুতরাং মানবদেহ যে নির্দেশ মানে তা অলৌকিক নয়, তা প্রাকৃতিক, সামাজিক ও দৈহিক। প্রকৃতি, সমাজ ও দেহযন্ত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকেই চেতনার উদ্ভব যা পরিচালক। চেতনার তিনটি বিশেষত্ব, শিল্পকলা, বিজ্ঞান এবং ভাবাদর্শ।