লুনা রাহনুমার দুটি খুদে গল্প

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০২০

মডেল

“শিল্পীকে যে ভালোবাসে, সে নিজেও এক রকম শিল্পী”, তমালের মুখে কথাটা শুনে মন ভরে যায় কনার। যদিও সে কথাটির অর্থ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না।

কন্ঠে আহ্লাদ মাখিয়ে বলে, “বুঝিনি, বুঝিয়ে বলো!”

তমাল তার আঁকিয়ে হাতের আঙ্গুলে ঢেউ তুলে শব্দের মালা গাঁথে ঠোঁটে, “আমার তো সেই একটাই মাত্র চাওয়া তোমার কাছে, সোনা। কেন রাজি হচ্ছো না? একটা পোট্রেট, আর তো কিছু চাই নি।”

দুই বছরের প্রেম কনার সঙ্গে তমালের। প্রতিদিন একবার দেখা করা চাই যে করেই হোক।

তমাল ছবি আঁকে। ক্যানভাসে রঙের খেলায় নেশা ধরে গেছে ওর। বিচিত্র ছবিতে ঠাসা মনের দেয়াল। এখন শুধু বাকি আছে একটি নগ্ন নারী পোট্রেট আঁকা। তমাল চায় এই পোট্রেটটি সে আঁকবে তার ভালোবাসার মানুষের সত্যিকার শরীর দেখে। তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলবে চামড়ার নিচের রক্ত ধারাকে পর্যন্ত।

“বিশ্বাস করো কনা, তোমার শরীরের প্রতি আমার কোন লোভ হয় না। শুধু একটি পোট্রেট আঁকব তোমায় দেখে দেখে।”

রোজ রোজ তমালের এই ভিক্ষুকের মতো প্রার্থনা কনার ভেতর কোথায় গিয়ে যে আঘাত করে তা সে বলে বুঝতে পারবে না। জীবনের সব গল্পই বলা হয়েছে যে প্রানের মানুষটিকে, তার কাছেও কি সত্যি সব বলা যায় খুলে?

অনেক ভেবে কনা রাজী হয়। আবক্ষ নগ্ন ছবির মডেল হবে সে।

পরদিন সকালে কনা উপস্থিত হলো তমালের ফ্লাটে। ক্যানভাস, ইজেল, রং, তুলি আর মনের ভেতর দারুন উত্তেজনায় প্রস্তুত তমাল। স্বপ্নের ছবিটি আঁকা হবে আজ। সেট করে রাখা চেয়ারে নিয়ে বসায় তমাল কনাকে। উর্ধাঙ্গ ঢেকে রাখা চাদরটি ফেলে দিতেই আঁতকে উঠে তমাল। ডান দিকের স্তনের জায়গাটি সমান, চামড়ার সেলাই সামান্য কুচকে আছে।

ক্ষমা প্রার্থনার কন্ঠে কনা বলে, “অনেকদিন চেষ্টা করেও তোমাকে বলতে পারিনি জানো। কয়েক বছর আগে ব্রেস্ট-ক্যান্সারের কারণে এটাকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।"

 

জন্মদাত্রী মা

সুবর্ণরেখা নদীটির তীর ঘেঁষে একটি ছোট গ্রাম। গ্রামের নাম মহুয়া। ফুলের নামে গ্রামের নামটি কে দিয়েছিলো সেই কথা এখন আর কেউ বলতে পারে না। মহুয়ার অধিবাসীরা সবাই খুব সজ্জন। আদব কায়দায় বিনয়ী। আশেপাশের অনেক গ্রাম পর্যন্ত মহুয়াবাসীদের সুনাম সুখ্যাতি শোনা যায়। বিখ্যাত লেখক ফারুক হোসেন এই গ্রামেরই ছেলে। প্রাইমারি পর্যন্ত এখানে স্কুলে পড়েছেন। তার বাবার চাকরি ছিল বিদ্যুৎ বিভাগে, প্রধান প্রকৌশলী। বদলির চাকরি , তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে কেটেছে ছোটবেলার বেশিরভাগটা।


ফারুক হোসেন  অনেক বছর থেকে লন্ডনে থাকেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ। লন্ডনে থাকলেও তিনি বাংলায় সাহিত্য রচনা করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। ফারুক হোসেন জীবনে অর্থ আর সম্মান দুটোই অনেক পেয়েছেন। সাফল্যের শিখরে এসেও একটু অবসর পেলেই মনে করেন গ্রামের কথা। শৈশবের কথা। মহুয়া, ফুলের নামে নাম গ্রামের সেই নদীটির কথা।


দীর্ঘ বাইশ বছর পর তিনি এসেছেন নিজের জন্মস্থানে। মহুয়াবাসীরা গর্বের সাথে ফারুক হোসেনের নাম উচ্চারণ করে। গোটা গ্রামের গর্ব এই লোকটি। ফারুক গ্রামের পুরোটা চষে ফেলে প্রথম কয়েক ঘন্টাতেই। সবার সাথে কি অমায়িক ব্যবহার! গ্রামের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাড়ির উঠোনে ফারুক হোসেনকে দেখার জন্য। ভিড়ের ভেতর ফারুক হোসেন কাউকে যেন খোঁজে। কিন্তু জানে না কাকে। মুখ চেনা নাই। শুধু জানে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ফারুক হোসেনের বন্ধ্যা মায়ের কোল ভরে দিয়েছিলো এই মহুয়া গ্রামের সুবর্ণরেখা নদীর তীরের এক জেলের পাগলী মেয়ে। পাশের গ্রামের একটি লম্পট মেয়েটিকে একলা পেয়ে ক্ষেতের ভেতর টেনে নিয়ে সর্বনাশ করেছিল। সেই সর্বনাশের লভ্যাংশ হিসেবে ফারুককে বুকে পায় তাহমিনা। নিজের সন্তান হিসেবে বড় করেছেন তাকে। মাত্র দুই বছর আগে লন্ডনে তাহমিনা বেগম মারা যাবার সময় ফারুককে এই গোপন সত্যটি জানিয়ে যান।


ফারুক হোসেন তার উপন্যাসে কত কাল্পনিক সম্পর্কের জন্ম দিয়েছেন এতো দিন। গল্পে ঘটনার মোড় যেখানে খুশি সেখানে ঘুরিয়েছেন নিজের ইচ্ছে মতোই। অথচ তার নিজের জীবনেই যে এতো বড় নাটকীয়তার মোড়ক উন্মোচন হবে সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। তাহমিনার মৃত্যুর সময় মায়ের পাশে বসে থেকে ফারুক হোসেনের বার বার মনে হচ্ছিলো মহুয়া গ্রামের সেই পাগলী মেয়েটির কথা। ফারুক হোসেনের জন্মদাত্রী মা। সেকি এখনো বেঁচে আছে? এখনো কি তার মাথায় দোষ! নাকি সে তার নিজের ছেলেকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আরো বেশি উন্মাদিনী হয়ে গিয়েছে কষ্টে শোকে যন্ত্রনায়!


ফারুক হোসেন বিষন্ন চোখে গ্রামের সবাইকে দেখে। এই সবগুলো মুখের মানুষ তার খুব প্রিয়। এদের ভেতর কারোর রক্তই তো বইছে বিখ্যাত লেখক ফারুক হোসেনের শরীরে। ওরা না জানলেও ফারুক সাহেব নিজে জানেন। অস্ফুটে বলেন, "মমতার শীতল ভূমি তোমরা আমার জন্য মহুয়াবাসী।"