লুনা রাহনুমার দুইটি অণুগল্প
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৫, ২০২০
সংবাদ
দৈনিক হকার পত্রিকার বিক্রি কমে যাচ্ছে দিন কে দিন। চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা নিত্য নতুন পত্রিকার সাথে তাল মিলিয়ে হকার পত্রিকাটি কিছুতেই পাঠকের মনের মতন খবর জোগাতে পারছে না যেন আর। অথচ কিছুদিন আগেও ঢাকা শহরের নাম্বার ওয়ান দৈনিক ছিল এই হকার।
সোমবার বিকেলে দৈনিক হকারের প্রধান সম্পাদক ফজলুল খান জরুরি মিটিং ডেকেছেন পত্রিকার সকল বিভাগীয় সম্পাদকদের নিয়ে। সহকারী সম্পাদকের মুখ ভার। একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপনদাতা ব্যবসায়িক প্রতিষ্টানগুলো ইদানিং টাকা দিতে গাইগুই করছে। তাদের বিজ্ঞাপন এখন অন্য দৈনিকের পাতায় দেখা যায় নিয়মিত। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর সব রকম প্রচেষ্টাই জলে যাচ্ছে একেবারে। কিছুতেই দৈনিক হকারের বিক্রি সংখ্যা টেনে উপরে উঠানো যাচ্ছে না।
মিটিংয়ে সম্পাদক সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনারা লেটেস্ট নিউজ আনুন আমাদের পত্রিকার জন্য। চতুর্দিকে চোখ রাখুন। এমন কোন সংবাদ আনুন যেটি আর কারো আগে আমরাই প্রথম পাই। মানুষজন সব হামলে পড়ে কিনবে আমাদের পত্রিকা। আপনাদের যার সংবাদে আমার দৈনিক হকার আবার সেই আগের এক নাম্বার পজিশনে যেতে পারবে তাকে আমি নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা উপহার দিবো।"
পাঁচ লক্ষ টাকা ক্যাশ উপহারের লোভ সবারই হয়েছে। কিন্তু এমন সংবাদ কোথায় পাবে সাংবাদিকেরা! তাদের মতো অন্য পত্রিকার সাংবাদিকেরাও তো সবখানে পৌঁছে যায় চিলের মত। ছো মেরে ছিনিয়ে নেয় প্রতিটি সংবাদ। তারপর মোটামোটি সব সংবাদ একই সাথে ছাপা হয় সবগুলো পত্রিকাতে একই দিনে।
কাকতালীয়ভাবে দৈনিক হকারের এই বিশেষ মিটিংটির মাত্র তিনদিন পর বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার আগেই দৈনিক হকার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেলো। সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। কারণ প্রথম পাতায় এক নাম্বার হেডিংয়ে ছাপা হওয়া একটি খবর সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়েছে। পাঠকেরা মারামারি করে কিনেছে হকারের সবগুলো কপি। খুশি মনে কয়েক ঘন্টার ভেতর দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপাতে হয়েছে হকার সম্পাদককে।
বাংলাদেশের এক নম্বর নায়িকা শাকিরা বিনতে করিম বুধবার রাতে আত্মহত্যা করেছে। উত্তরা চার নাম্বারে তার নিজের ফ্ল্যাটে নিজের হাতে বুকে ছুরি বসিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শাকিরা। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই দুর্ঘটনার ছবিসহ সংবাদ রাতারাতি হকার পত্রিকার প্রেসে জমা পড়লো কিভাবে সে বিষয়ে এখনো মুখ খুলছেন না হকারের বিনোদন সম্পাদক। বলছেন, "এটা সিক্রেট।" গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তিনি শাকিরার মৃত্যর পরমুহূর্তের ছবিগুলো জোগাড় করেছেন।
ফজলুল খান অবশ্য সংবাদের সূত্রটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। তার পত্রিকা আবার এক নাম্বারে উঠেছে তাতেই তিনি খুশি। বিনোদন সম্পাদক অভিজিৎ শর্মার ডেস্কে পৌঁছে গেছে নগদ পাঁচ লক্ষ টাকার প্যাকেট। অভিজিৎ পুরো এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। সামনে অনেকগুলো কাজ আছে। মাথা খুব ঠান্ডা রাখতে হবে। গত একবছর ধরে শাকিরার সাথে অভিজিতের প্রেমের ব্যাপারটি গোপন রাখায় যে এতো লাভ হবে সেটা বুঝতে পারেনি অভিজিৎ। পুলিশ আর গোয়েন্দারা গন্ধ শুকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাবার আগেই নিজের ফ্লাট থেকে শাকিরার সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। আর নিজেকে রাখতে হবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কেউ যেন সন্দেহ না করে কোনোভাবে।
নিজের ফ্ল্যাটের লিফটে উঠে নাম্বার ১১ চেপে মনে পড়লো উঠতি মডেল প্রিয়াঙ্কার কথা। মেয়েটা সারাদিনে না হলেও একশো বার ফোন করে। একটা সুযোগ চায়। অভিজিৎ যেহেতু বিনোদন সম্পাদক, তাই ইচ্ছে করলেই ওকে নিয়ে দারুন একটি ফিচার ছাপতে পারে। প্রিয়াঙ্কা বুঝিয়েছে, হকারে নিজের প্রচার করতে প্রয়োজনে সে হুকার হতেও রাজি আছে। নিজেকে প্রথম সারির মডেল হিসেবে দেখার খুব শখ মেয়েটির। অভিজিৎও বুঝে গেছে আজ, প্রিয়াঙ্কাকে হাতে রাখতে হবে। হয়তো দ্বিতীয় কিস্তির বাজিমাত হবে এই মেয়ের মাধ্যমেই!
বর
সুলেখা হাত তুলে মোনাজাত ধরে বললো, "হে প্রভু তুমি আমাকে কিছু বন্ধু দাও। একাকী এই নিঃসঙ্গ জীবন আর সহ্য হয় না।"
মহান প্রভু সুলেখার মোনাজাত কবুল করলেন। মনের মতো গোটা পাঁচেক বন্ধু জুটে গেলো সুলেখার জীবনে আশীর্বাদের মতো। সকালে নাস্তার পর্ব শেষ করে টেলিফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করার মানুষ হয়েছে। দুপুরে ভালো-মন্দ রান্না করে ডাক দিলে পাশে বসে খাবার মতো বন্ধু হয়েছে। ঝলমলে বিকেলে পার্কে হাঁটতে গেলে হৈ হৈ করে ছুটে আসে সকল বান্ধবীরা একত্রে। সীমাহীন আনন্দ সুলেখার মনে।
কিন্তু এই আনন্দ বেশি দিন রইলো না। চঞ্চলমতি সুলেখার প্রার্থনায় খুশি হয়ে মহান প্রভু ওর ইচ্ছে মাফিক বর দিয়েছেন সেদিন। ঘটনাক্রমে, প্রার্থনার সেই দিনটি ছিল শনিবার। শনিবারে একটির সাথে আরেকটি ফ্রি। বরদাতা তাই নিজের পছন্দমতো সুলেখাকে এমন আরেকটি জিনিস উপহার দিলেন যেটি ওর আগে ছিল না। তা হলো, বুদ্ধি।
এই বুদ্ধির কারণে সুলেখা কিছুদিনের ভেতর চারপাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মনের কথা পড়ে ফেলতে লাগলো সহজেই। তাদের চোখ টিপে হাসির অর্থ বুঝতেও কষ্ট হয় না আর। বোকা সুলেখা চালাক হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, সুলেখার নতুন বন্ধুরা বেশি সুবিধা করতে না পেরে সবাই দুধের মাছির নিদর্শন হয়ে উড়ে চলে গেলো দূরে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সব অল্প কদিনেই।
সব্বাইকে তাড়িয়ে দিয়ে সুলেখা আবার মোনাজাত ধরে, "হে প্রভু, তুমি আমারে একলা থাকার উপায় শিখিয়ে দাও। আমি যেন নিজেকে নিয়েই সুখী হতে পারি।"
দয়ার সাগর মহান প্রভু সুলেখার কথা শুনলেন। আগাছা ভর্তি একটা বাগান উপহার দিলেন সুলেখাকে। সারাদিন সুলেখা আগাছা পরিষ্কার করে, বাগান করে, ফসল ফলায় আর ফুল ফোটায়। তাতে সুলেখার শরীর ভালো হলো। মন ভালো হলো তারচেয়েও বেশি। নিজের গাছের ফুলের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে সুলেখা। এই হাসি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ।