লীলা মজুমদারে ‘হাতি আর দরজির গল্প’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদারের আজ জন্মদিন। ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রায় পরিবারে গড়পাড় রোগের বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবী তার পিতা-মাতা। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘হাতি আর দরজির গল্প’টি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
এক রাজার মোতি বলে চমৎকার এক হাতি ছিল। যেমনি তার বুদ্ধি, তেমনি তার খোসমেজাজ। সবাই তাকে ভালোবাসত। শহরের ধার দিয়ে কুলকুল করে সুন্দর এক নদী বয়ে যেত। সেই নদীতে দাউদ বলে এক মাহুত রোজ মোতিকে স্নান করতে নিয়ে যেত। হাঁটুজলে নেমে, শুড় দিয়ে জল ছিটিয়ে মহা আনন্দে মোতি স্নান করত। তারপর আবার ওই একই পথে রাজবাড়ির হাতিশালে তারা ফিরে যেত।
পথটি রাজবাড়ির সিংহদরজা থেকে একেবারে নদীর তীর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। মাঝখানে শহরের বড়ালোকেদের বাড়ি, বাগান, তারপর বাজার হয়ে তবে নদীতে পৌঁছোতে হত। ওই বাজারে একটা দরজির দোকান ছিল। দরজির সঙ্গে দাউদের বড়ো ভাব। রোজ ওইখান দিয়ে যাবার সময় দাউদ মোতিকে থামতে বলে, তার ঘাড়ের ওপর বসে বসেই দরজির সঙ্গে গল্প করত। দরজি মোতিকেও খুব ভালোবাসত।
মোতি মিষ্টি খেতে ভালোবাসে শুনে রোজ তার জন্যে দরজি কিছু না-কিছু রেখে দিত। মোতি এসে দাঁড়িয়েই মিষ্টির আশায় শুড় বাড়িয়ে দিত। আর দরজি অমনি তাকে হয় একটা মিষ্টি ফল, নয় একটা লাড়ু, কি বরফি, কি বাতাসা দিত। সেটাকে মুখে ফেলে, চোখ বুজে মোতি তারিয়ে-তারিয়ে খেত। তারপর দাউদের গল্প করা শেষ হলে, ওরা আবার নদীর দিকে চলত।
এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি, দরজির কাছে একটাও ফল, মিষ্টি বা কোন খাবার ছিল না, যা মোতিকে দেওয়া যায়। দরজির কেমন দুষ্টু বুদ্ধি জাগল। যেই মোতির শুড় বাড়িয়ে দিয়েছে, অমনি দরজি তার হাতের ছুঁচটি শুড়ের ডগায় ফুটিয়ে দিয়েছে। শুড়ের ডগাটি মানুষের ঠোঁটের মতো নরম। মোতির তাই খুব ব্যথা লাগল। তবু সে শুড়টি সরিয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর দাউদের গল্প শেষ হলে দুজনে রোজকার মতো নদীতে গেল। খুব জল ছিটিয়ে স্নান করল মোতি সেদিন। দাউদের মনে একটু ভাবনা ছিল, দরজি কাজটা ভালো করেনি। কী জানি, হাতির মেজাজ যদি বিগড়ে যায়। তাই জলে নেমে মোতির ফুর্তি করে স্নান করা দেখে দাউদও নিশ্চিন্ত হল। এবার ফেরার পালা। অন্যদিন ফেরার পথে কোথাও থামা হয় না। ওরা। সোজা বাড়ি ফেরে। আজ দরজির দোকানের সামনে পৌছে মোতি নিজের থেকেই থামল।
দাউদ ভাবল, কী ব্যাপার! এমন সময় শুড় তুলে এক শুড়-ভরতি কাদাজল মোতি দরজির গায়ে ও মাথায়; তার হাতের সাদা রেশমি কাপড়ের ওপর পিচকিরির মতো ছিটিয়ে দিয়ে ধীরেসুস্থে আবার পথ ধরল। হাতের সেলাই নষ্ট হল বলে দরজি হায়-হায় করতে লাগল, দাউদকে আর তার হাতিকে গালি দিতে লাগল। তখন সামনের দোকানের পানওয়ালা বলল, “ঠিক হয়েছে, যেমন কর্ম, তেমনি ফল। তুমি ভেবেছিলে বোবা জানোয়ার অন্যায় বোঝে না। তাই বেচারির শুড়ে ছুঁচ ফোটালে। হাতি যেমন-তেমন জানোয়ার নয়। ওরা সব বোঝে, সব মনে রাখে। অন্যায় করলে ওরা সাজা না দিয়ে ছাড়ে না। ভালো চাও তো কাল ওর জন্য একটা ভালো খাবার রেখো।
তাই রেখেছিল দরজি। মোতির সঙ্গে আবার তার ভাব হয়ে গেছিল।