লাইলাতুল বরাত

রহমান হেনরী

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২০

ফার্সি ‘শবে বরাত’ শব্দটির আরবি সমার্থক শব্দ ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ (মধ্য-শাবান)। হিজরীপঞ্জিতে শাবান চাঁদের ১৪ ও ১৫তম তারিখের মধ্যবর্তী সময়কে শবে বরাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ রাতটির মোট চারটি নাম। যথা: লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুছ্ ছাক ও লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।

শবে বরাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হা-মিম! শপথ উজ্জ্বল কিতাবের। নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী।” (সুরা দুখান, আয়াত: ১-৩)

এ আয়াতের তাফসির সম্পর্কে বরেণ্য মুফাসসির আল্লামা শেখ আহমদ ছাভী (রহ.) বলেন, “ওই বরকতময় রজনী হচ্ছে অর্ধ-শাবানের রাত।” বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রা.) এবং অন্যান্য তাফসিরকারকদের মতও এটাই যে, সেই বরকতময় রাত হলো মধ্য শাবান তথা শবে বরাত। (তাফসিরে ছাভী, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪০)

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, “বরকতময় রাত হলো, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব কোরআন শরিফ সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে তথা প্রথম আসমানে নাযিল হয়।” (তাফসিরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০)

ইমাম আবু জাফর আত-তাবারি (রহ.) বলেন, “তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরবর্তীতে একজনও কমবেশি হয় না।” (তাফসিরে তাবারী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ২২)

ইমাম বাগাভি (রহ.) লেখেন, “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবে ক্বদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন।” (তাফসিরে বাগাভি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২২৮)

হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, “একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি ওফাত পেয়েছেন। আমি তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা, তোমার কী আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (দ.), আপনার দীর্ঘ সেজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, না জানি আপনি ওফাত পেয়েছেন! নবীজি (দ.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (দ.) বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)

একদিন প্রিয়নবি (দ.) আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “হে আয়েশা, শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে তুমি কি জান? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ.) শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা কী? আল্লাহর হাবিব (দ.) উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ট হবে এবং কতজন আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল মহান আল্লাহ দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়। (ফাজায়েলুল আওকাত, হাদিস নম্বর ২৬)

যরত আবূ মূসা আশয়ারী (রা.) রাসূলে কারীম (দ.) হতে বর্ণনা করেন। রাসূলে পাক (দ.) এরশাদ ফরমান, “মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ পাক রহমত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শক্রতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৩৮৯)

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (দ.) বলেছেন, “১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে রহমত নিয়ে অবতরণ করেন এবং আহবান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহবান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৪)

তবে, মুশরিক, হিংসা-পোষনকারী, সর্বদা ব্যভিচারকারী, পিতামাতার অবাধ্য, মদপানকারী, হারাম মাল ভক্ষণকারী, ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারী ক্ষমা পাবে না। তাদের তাওবা করতে হবে।

লেখক: কবি