লতিফ জোয়ার্দারের গল্প ‘বিউটি ও তার প্রথম প্রেম’
প্রকাশিত : মে ০২, ২০২০
আজ রাতের বেলায় ঠিকমতো ঘুম হয়নি কামালের। ঘুম ভেঙে গেলেই বারবার হারিকেনের আলো বাড়িয়ে, বিছানা উলোট পালোট করে দেখেছে ট্রেসিংয়ে জাফরান কালিতে লেখা কাগজটা ঠিকঠাক আছে কিনা। কাগজটা দেখার পর একটু শান্তিমতো ঘুম আসে কামালের চোখে। সকাল বেলায় এ বাড়ির সবাই ঘুম থেকে জাগার আগেই কাজটা শেষ করতে হবে। একা একা কাজটা করতে একটু ভয় করবে বলে, বন্ধু সামছুল থাকবে সাথে। তারা দুজন একই সাথে এক কলেজে পড়ে। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ মানবিক বিভাগ। দুজনেই তৃতীয় বিভাগ পেয়ে পাশ করেছিলো। কামাল অবশ্য মাত্র চার নম্বরের জন্য দ্বিতীয় বিভাগ পায়নি। আর এ কারণেই আরেক কলেজে একসাথে বিউটির সাথে পড়া হলো না তার। তারপরও প্রতি বিকেলে বিউটির সাথে দেখা হয় তার। কথা হয় তার। কখনও খুনসুটি হয়। একে অপরের মাঝে বিবাদ লাগে। কখনও বিউটি চুলের দুই বেণী ঝুলিয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। ততক্ষণে এই শীতের বিকেলে কামালের শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে। বিউটি ততক্ষণে একগাল মিষ্টি হেসে কামালের খেলা থামিয়ে দিয়ে বলবে, কামাল তুমি তো অনেক খেলেছে! এবার ব্যাডটা আমার কাছে দাও দেখি। বিউটি ব্যাডমিন্টন খেলে আর কামাল একদৃষ্টিতে তার তাকিয়ে থাকে। মনে হয় এর আগে আর কোনোদিন দেখা হয়নি বিউটির সাথে। কথা হয়নি বিউটির সাথে।
বিউটি দেখতে অনেকটা শ্যামলা রঙের। তবে তার মুখের অবয়বটা দেখার মতো। অনেকটা শালিক পাখির মতো। ভাসা ভাসা চোখ দুটো। হাসিটা ঠিক যেন মোনালিসার মতো। ঠিক বোঝা যায় না। তবে কেন কী কারণে বিউটিকে কামালের ভালো লাগে! কামাল তা ঠিক জানে না এখনও। তবে অতি চমৎকার ভাবে গুছিয়ে কথা বলে বিউটি। ও কথা বললে মনে হয়, পাখি গান গাইছে। একবার ভেবেছিল তার কথায় পটেছে কামাল। আর একবার ভেবেছে, না তার শালিক চোখের জন্য! একবার শুধু দেখার জন্য অস্থির হয় কামাল। আসলে কামাল জানে না, বিউটির প্রতি তার এসব ভালোবাসা না ভালো লাগা। না! নিছক কাছে থাকার মায়া। কিন্তু এসব বিষয়ে আজও কোনো কথা হয়নি বিউটির সাথে। তবে মাঝে মাঝে বিউটির ছোট ভাই লিটনের সাথে বিউটিদের বাসায় যায় কামাল। বিউটির মায়ের সাথে গল্প করে। সামান্য সময়ের জন্য বিউটিকে একা পাবার ক্ষণ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বিউটি একা হয় না! বিউটিকে একা পায় না কখনও কামাল।
তবে ইচ্ছে করলেই কামাল যখন তখন বিউটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু কেন যে এই অকারণ দূরে থাকা। কামাল অনেকবার অনেকভাবে ভেবেছে! বিষয়টা কীভাবে বলবে বিউটিকে। আর ইচ্ছে করলেই বিউটি কামালকে ফেরাতে পারবে না। তবে সামছুল অবশ্য বলেছে, দ্যাখ কামাল, অযথাই তুই বিউটির পিছনে ঘুরিস না। বিউটি কিন্তু রানা ভাইকে ভালোবাসে। রানা এলাকার বড়ভাই। কামালদের দুই ক্লাস উপরে পড়ে। দেখতেও বেশ ম্যানলি হ্যান্ডসাম। বিউটির ভালো লাগারই কথা। কিন্তু বিষয়টা মেনে নিতে পারে না কামাল। একবার কামাল ভাবে সামছুল মিথ্যে করে এসব বলে তাকে। সে কারণে তার মনে হয়, একবার সে বিষয়গুলো রানা ভাইকে জানাবে। কিন্তু বাদসাধে সামছুল। কামালের বিশ্বাস আরো প্রবল হয়। অথচ সামছুল বারবার বলে, দ্যাখ বন্ধু এভাবে তোর কাজ হবে না। আমি তোর এক প্রকার উপকারে আসতে পারি। তখন বিউটিকে তুই যা বলবি! সে তখন তাই করবে। আর রানা ভাইয়ের কথা কোনোদিন মনে করবে না বিউটি! বলিস কি? তবে তো আর আমার কোনো চিন্তাই নাই। নারে অতো সহজ নয়। তুই দুই তিন শত টাকা জোগাড় করতে পারবি? আমি তোকে ভালো এক করিরাজের কাছে নিয়ে যাব। সে দোয়া লেখে দিলে, বিউটি পাগলীর মন তোর কাছে ছুটে আসবে। কিন্ত! কিন্তু কি রে? একটু সমস্যা আছে।
কি আবার সমস্যা। পুরনো দিনের কালো গরুর ঘি আর জাফরান কালি জোগাড় করতে হবে। ততক্ষণে কামালের মুখে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। এসব তাকে দিয়ে হবে না। জাফরান কালি না হয় জোগাড় করা গেল কিন্তু পুরনো দিনের কালো গরুর ঘি! এসব কিছু কামালকে দিয়ে কিছুতেই হবে না। পরেরদিন ছিলো শনিবার। সামছুল কলেজে গিয়ে কামালের দেখা পায় না। তবে কী কামাল আজ কলেজে আসেনি। সামছুলও কোনো ক্লাস না করে বাড়ি ফিরে আসে। আসার পথে মনে হয়, সিএসডির কলোনিতে কামালকে পাওয়া যেতে পারে। যে কথা সেই কাজ! বিউটিরা সবাই কলেজে অথচ কামাল কলোনির পুকুরঘাটে একাকী বসে আছে। কি রে কামাল, তুই এখানে? সমস্ত কলেজে খুঁজে খুঁজে তোকে পেলাম না। বিউটিদের বাসার সামনে এসে বসে আছিস?
না রে মনটা ভালো নেই আজ। বারবার মনে হচ্ছে দূরে কোথাও চলে যাই। একজনকে আজো ভালো লাগার কথাটা পর্যন্ত বলতে পারলাম না। তার আগেই শুনি সে আরেক জনকে মন দিয়ে বসে আছে। বারবার জিততে জিততে হেরে যাই আমি। বসে আছি বিউটি ফিরলে কিছু কথা বলবো ওকে। তবে তুই এটা ভাবিস না। আমি তাকে প্রেম নিবেদন করবো। আমার ভালো লাগা না হয় অজানাই থেকে গেল বিউটির কাছে।
এর ঠিক দুই দিনের মাথায় রানা ভাইয়ের বাবা অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিবে রানা ভাইয়েরা। কী এক অজানা কারণে কামাল আর ওদিকে পা বাড়ালো না। ওদের কারো সাথে আর দেখা নেই তার। সামছুলও বেশ দূরে দূরে থাকে। রানা ভাইয়ের সাথে তার গলায় গলায় ভাব। হয়তো সে কারণ হতে পারে। অথবা এসব কিছুই নয়। হয়তো কোনো ব্যস্ততায় সামছুল আর এদিকে আসছে না। কামাল সামছুলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। মাঝ পথে দেখা হয় ওর সাথে।
কি রে তুই? দুইদিন কোথায় ছিলি।
একটু ব্যস্ত ছিলাম আর কি। তবে আজ শুধুই আমি তো তোর উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। জানিস কামাল, সব জোগাড় হয়ে গেছে। এখন শুধু তোর বাবা মা আর বিউটির বাবা-মার নাম লাগবে। তখন আর ঠ্যাকায় কে! বিউটি পাগলীর মতো ছুটে আসবে তোর কাছে।
কামালের আজ মনে হয়, তিনশো টাকা লাগলে কী হবে! এত সহজ ব্যবস্থায় বিউটিকে পাওয়া যাবে! এমনটা তো তার জানা ছিল না। অদ্ভুত চঞ্চলতা অনুভব করে সারাদিন কামাল। দিন যেন কিছুতেই যেতে চায় না। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত রাত আসে। ভোররাতে ঘুম থেকে জেগে ঘর থেকে বের হয় কামাল। সামছুলও আসে। কালো গরুর ঘি ছিল ওর কাছে। মাত্র তো তিনদিন, বিউটিদের বাসার পশ্চিমে বসে জাফরান কালি লেখা দোয়ার নক্সাটা কালো গরুর ঘি দিয়ে পোড়াতে হবে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে বসে, কাজ শুরু করে কামাল আর সামছুল। এক এক করে দুই দিন চলে যায়। সামছুলকে সাথে নিয়ে নক্সার দোয়া পোড়ায় কামালেরা। অতঃপর বিকেল বেলায় কলোনিতে ঘুরতে যায়। ততদিনে রানা ভাইয়েরা চলে গেছে। ওদের বাসার সামনের গোলাপি গোলাপের গাছটা ঠিক তেমনি আছে আজো। আমের গাছটায় মুকুল এসেছে এবার। কলোনির পুকুর পাড়ের নারিকেল গাছগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন। ওখানেই একাকী দাঁড়িয়ে আছে বিউটি। মনটা বড় বিষণ্ণ তার। কামালকে দেখে হেসে উঠলো বিউটি। আরে কামাল তুমি। মনে হচ্ছে, কতদিন তোমাকে দেখি না। তোমার সাথে না আমার একটু কথা ছিল।
বলো না কেন?
আজ নয় গো, আরেক দিন বলবো। রানা ভাইয়েরা চলে গেল তো! তাই মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে আমার।
তিনদিন চলে গেছে। কামালের টেনশনে আর চোখে ঘুম নেই। কখনবা বিউটি চলে আসে। সেদিন সে কি যেন বলতে চেয়ে বললো না। হয়তো তার ভালো লাগার কথা বলতে চেয়েছিল সে। ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বিউটি আসে না। এভাবেই কয়েক দিন চলে যায়। কিছুতেই কামালের অপেক্ষার সময় শেষ হয় না। রাস্তায় বারবার পায়চারী করে। কিন্তু বিউটির আসার নাম গন্ধ নেই। এভাবেই আরো বেশ ক`দিন চলে যায়। কামাল ভেবেই নিয়েছে বশিকরণ দোয়ায় কোনো কাজ হয়নি। কেমন যেন লজ্জায় পড়ে যায় কামাল। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়। বিউটিদের কলোনিতে আর যাওয়া হয়নি। আর বিউটির কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। মনে হয় সব মিথ্যে। আর কোনোদিন বিউটিকে ভাববে না আর সে।
একদিন সকাল বেলায় হঠাৎ করেই বিউটি এসে উপস্থিত কামালদের বাড়ি। আগে থেকেই বিউটি এ বাড়িতে আসা যাওয়া করে । সে জন্য কেউ কখনো কিছু মনে করে না। আর মনে করবেই বা কী। ওরা একসাথে পড়ে। ওকে দেখে কামাল ঘেমে অস্থির হয়। কামালদের বসার ঘরে মুখোমুখি কামাল আর বিউটি। বিউটির তার বড় সড় ব্যাগটি সামনে রেখেছে। কামাল বিউটি কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না আজ। দুজনেই স্তব্ধ। হঠাৎ করেই বিউটির মুখে কথা ফোটে। জানো কামাল? আমি একবারে চলে এসেছি আজ। আর কোনোদিন আমি আর ঘরে ফিরে যাব না। আমার জন্য তোমাকে একটা কিছু করতেই হবে।
আমি তো তোমার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত বিউটি। কিন্তু এ সময় কামাল কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে টেনশনে মরে যাবে আজ। দীর্ঘ সময় চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। এতিদন পরে আজ তার মনে হচ্ছে, দোয়ায় ঠিকই কাজ করেছে। মাত্র একবারের জন্য চোখ খুলে কামাল। অবাক দৃষ্টিতে বিউটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় বিউটি বলে, কামাল তুমি তৈরি হয়ে নাও। যত তারাতাড়ি সম্ভব আমাকে রানার কাছে পৌঁছে দাও!