লতিফ জোয়ার্দারের গল্প ‘ফাউন্টেন পেনে লেখা চিঠি’
প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২০
চৌত্রিশ বছর পর তার চিঠি পেলাম। একটা ধূসর মলিন খামের উপর পত্রদাতা লিখেছে, চিঠিটা না পড়ে ছিঁড়ে ফেলবেন না কিন্তু!
কেমন যেন উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল আমার। নিশ্চয় এ বয়সে আমায় কেউ প্রেমপত্র দেবে না। তারপরও আমার বেশ ভয় হচ্ছিল। চিঠিটা পাওয়ার পরই লুকিয়ে ফেলেছি আমি। কারণ পত্রদাতা একজন মহিলা। আবার মেয়েও হতে পারে। বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম। যে লিখেছে তার নাম আমার কাছে বেশ অপরিচিত। অনেক খুঁজেছি আমি এই নামে হাইস্কুল জীবনে কেউ আমার সাথে পড়েছে কিনা! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না।
মনে হয়, কিছু সময়ের মধ্যে মাথার সবগুলো তার ছিঁড়ে যাবে। আর এমন তো হবারই কথা! একটা সামান্য নাম মনে করতে পারি না আমি! ইদানীং প্রায় রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখি। কেন একই স্বপ্ন আমি বারবার দেখি তার কারণ খুঁজে পাই না। আর সেই স্বপ্নের ভয়ে আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, সারারাত জেগে কাটিয়ে দেই। আমার বউয়ের বারবার ঘুম ভেঙে যায়। সে দ্যাখে, আমি সোফায় বসে দুই পা দোলাচ্ছি বারবার।
কী হলো, আজো আবার তোমার পা চাবাচ্ছে? একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে তো দেখতে পারো।
আমি ভয়ে ভয়ে বিছানায় যাই। রাতজাগার সমস্ত ক্লান্তি আমার চোখে ঘুম এনে দেয়। আর সেই সময়ই আমি আবার সেই স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করি। ঘুম থেকে জাগার পরও সেই স্বপ্নের ঘোর যায় না আমার। তবে এ এমন একটা স্বপ্ন! যে স্বপ্নের কথা আমি কাউকেই বলতে পারি না। এমন কী আমার বউকেও না!
স্বপ্নের কথায় পরে আসি। যে চিঠি বুকের মধ্যে গভীর বোঝা হয়ে আছে। তার কথায় ফিরে আসি এবার। চিঠিটা পাওয়ার চার দিনের মাথায় পড়ার সুযোগ হলো আমার। তাও এক সিগ্ধ সকাল বেলায় বাড়ি থেকে দূরে, এক মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়তে হলো আমাকে। কারণ বিষয়টা আমি কাউকে জানাতে চাই না। তবে সেই চিঠিটা আমাকে আমার স্বপ্নের সমাধান এনে দিয়েছিল। পত্রদাতার নাম পলি। আর পত্রটি লেখা হয়েছে চৌত্রিশ বছর আগে। যখন আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই। আর পত্রটি পোস্ট করা হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ আগে। এসব দেখে আমার সবকিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। ফাউন্টেন পেনে লেখাগুলো জায়গায় জায়গায় পড়তে বড় কষ্ট হচ্ছিল আমার। অযত্নে এতদিন ভাঁজ করে রাখা চিঠিটি!
কেন এতদিন পর পোস্ট করতে হলো! কেনইবা এতদিন চিঠিটা দিতে ইচ্ছে করেনি তার । বিষয়টা আমার বর্তমানগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল। আমি বারবার ভুলে যাচ্ছিলাম, আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি কিনা। আমি যে জমির আইলে বসে পত্র পড়ছি সেটা একটা ধনিয়ার খেত। সাদা ধনিয়া ফুলে মৌ মৌ করছে চারপাশ। এই সময় আমার বারবার মনে হচ্ছিল, পত্রদ্বারা পত্রদাতা আমার কাছে এক করুণ গল্পের অবতারণা করেছে মাত্র। এক রহস্যের জালে আমাকে নিয়ে খেলতে চাইছে সে। চিঠিটা পড়তে গিয়ে অনেকবার থামতে হয়েছে আমাকে। কারণ পত্রদাতা পলি তার আসল নাম নয়। প্রথমেই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে তার আসল নাম কি? সে লিখেছে, আর যদি আমার নাম বের করতে না পারো তুমি? দোহাই তোমার এই চিঠি তুমি পুরোপুরি পড়বে না। তবে সে বেশ কায়দা করে প্রথমেই লিখেছে, আমি পলি। পলি নামটার সাথে তোমার অবশ্য কোনো পরিচয় নেই। এই নামটি আমার নিজের দেয়া। মনে পড়ে, তুমি আমি একসাথে একস্কুলে পাঁচ বছর পড়েছি। স্কুল বদলানোর স্বভাব ছিল বলে মাঝে এক বছর তুমি আরেক স্কুলে পড়েছিলে। আর সেই সময় তোমাকে অবশ্য সেভাবে চিনতামও না আমি। কিন্তু পরর্বতীতে তোমার সাথে শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করতো আমার। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করতো আমার। সে কারণে আমি একদিনও স্কুল ফাঁকি দেইনি। মনে হতো শুক্রবারেও স্কুল খোলা থাকলে কী যে ভালো হতো। এবার একটু ভাবো? তবেই আসল আমাকে খুঁজে পাবো তুমি।
মনে পড়ে, শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল আমাদের। সেদিন ছিল মার্চ মাসের পনের তারিখ। ১৯৮৬ সাল। শেষ পরীক্ষা দিয়ে আমরা সবাই বাড়ি ফিরছি। মাঝে বনপাড়াতে গাড়ি বদল করতে হয় বলে। বাস থেকে নেমে দেখি, তোমারা কয়েক বন্ধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছো। তোমার কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিতে ইচ্ছে করছিল বলে, সবার মাঝে থেকে তোমাকে একটা পুরনো দোকানের পিছনে নিয়ে গেলাম আমি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, মাত্র একবারের জন্য তোমার হাত দুটি ছুঁয়ে দেই আমি। তুমি বেশ তাড়াহুড়ো করছিলে। তাই আমার মনের সব কথা তোমায় বলতে পারিনি সেদিন। শুধু এতটুকুই বলেছিলাম, তোমায় আমার খুব ভালো লাগে। তোমায় খুব ভালোবাসি আমি। বলা তো তোমার কথা ছিল। তুমি ছেলে মানুষ। অথচ আমি নির্লজ্জের মতো আমার মনের কথাগুলো তোমায় বলেছিলাম। আমি জানি, এজীবনে আর কোনোদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। তাই বোধহয় সাহস করে কথা বলতে পেরেছিলাম সেদিন। তুমি চুপচাপ সব কথাগুলো শুনছিলে। কোনো কথার উত্তর দাওনি তুমি। সে কারণে বাড়ি ফিরে, কয়েকদিন পরে এই চিঠিটি লিখেছিলাম তোমায়। কিন্তু সে চিঠি আর তোমাকে দেয়া হলো না আমার।
তার কথা এখানে রেখে এবার আমার সেই স্বপ্নের কথায় ফিরে আসি। যে কথা আমি কাউকেই বলতে পারিনি কোনোদিন। প্রতিরাতে একই স্বপ্ন দেখে বারবার ক্লান্ত হয়েছি আমি। সেই স্বপ্নে, এক অন্ধ ভিক্ষুক আমি। কেউ একজন এসে আমার হাত ধরে আছে বসে আছে। তবে তার সবকিছু আমার কাছে চেনা মনে হলেও। শুধুমাত্র তার মুখটা কেন জানি আমার কাছে বড় অচেনা লাগে। তার হাত ধরে ভিক্ষা করে বেড়াই আমি। স্বপ্ন এক মুহূর্তের হলেও স্বপ্নের সাথে থাকা যায় দীর্ঘ সময়। আর এ স্বপ্নের সাথে যতবার যতক্ষণ থেকেছি আমি। ততক্ষণ অস্থির হয়েছি। এসব কথা কল্পনা করে, কিছুতেই আমার ঘুম আসতো না। মনে হতে পারে, এই চিঠি কী করে এই স্বপ্নের সমাধান হতে পারে। পাঠকের কাছে কিছুটা দ্বন্দ্ব মনে হলেও আমার মনে হয়েছে, সেই অন্ধ ভিক্ষুক আমি হলেও আমার হাতের লাঠি ধরে থাকা মানুষটিই হলো পলি। সেই মানুষটিই হলো রওশনারা। পলি ছদ্মনাম হলেও পলির আসল নাম রওশনারা।
চৌত্রিশ বছর পরে এই চিঠি উদ্ধার করে পাঠিয়েছে পলির মেয়ে। পলির আরো অনেক কথা লিখতে পারতো সীমা। অথচ সে সংক্ষেপে লিখেছে, মাত্র মাস ছয়েক আগে ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেছে পলি। মরে যাওয়ার আগে তার এই ইচ্ছের কথা তার মেয়েকে বলেছিলো পলি। পলির চিঠির সাথে ছোট্ট চিরকুটে লেখা, এই তথ্য সংযোজন করে পাঠিয়েছে পলির মেয়ে সীমা।