লতিফ জোয়ার্দারের গল্প ‘চব্বিশ বছর বয়সে’
প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২০
বিয়ের পর তিনমাস গেছে মাত্র, আর এই তিন মাসে কাজলী তার স্বামীর বাড়ির অভাব বুঝতে না পারলেও পরর্বতীতে ঠিক বুঝেছিল তাকে ঠকানো হয়েছে। কাজলী এজন্য কাউকেই দায়ী করে না। শুধু কিছু সময় পরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একা একাই বলে, সবই আমার ভাগ্য। নইলে কী করে এই বাউণ্ডুলে মানুষটার ঘরে এসে পড়ি আমি। তবে এ বাড়ির ঠাটবাট দেখে মনে হয় এমন অবস্থা তাদের ছিল না। ছাদের পলেস্তারা খসে যাওয়া বিল্ডিং আর বাড়ির সামনে শানবাঁধানো পুকুর দেখে মনে হয়, এক সময় মজিদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। এখনো পুরনো দিনের আমগাছ জামগাছ লিচুগাছগুলো নিঃসঙ্গ বিকেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। এতদিন জায়গা জমি বিক্রি করেই চলতো মজিদেরা। তাও এখন শেষের পথে। শেষ সম্বল শানবাঁধানো পুকুরটিও বিক্রি হয়ে গেছে বছর দুই আগে। এখন শুধু বাড়ির আঙিনা ছাড়া আর কিছু নেই।
কাজলীর বয়স এখন চব্বিশ। মজিদের বয়সের হিসেব তার জানা নেই। পুরুষ মানুষের বয়স জানার বিধান নাকি স্ত্রীর নেই। সে কারণে মজিদের কাছে এসব বিষয়ে কোনোদিন কোনো কথা বলেনি কাজলী। তবে মাঝে মাঝে কাজলী ভাবে, মজিদকে বিয়ে না করেই বা আর কী করার ছিলো তার। কারণ তার এই বয়সে তো আর কম পুরুষকে চেনা হয়নি। প্রথম প্রথম ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা বলে তারা। মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। একদিন দেখা না হলে, একদিন কথা না হলে মনে হয় মরেই যাবে তারা। কিন্তু ধীরে ধীরে কাছে আসার পর, চুমু দিতে চাইবে। জড়িয়ে ধরতে চাইবে। কেউ কেউ আবার বিছানায় নেবার অভিলাষ ব্যক্ত করবে। হারামজাদা সব পুরুষকে আমার চেনা হয়ে গেছে। সেই তুলনায় মজিদ অভাবী হলেও চরিত্রবানই মনে হয়।
প্রথম যে মানুষটার সাথে কাজলীর সম্পর্ক হয়ছিল অথবা তা না বলে, বলা যেতে পারে সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছিল যে মানুষটা, কারণ এক তরফা প্রেম প্রস্তাবকে প্রেম বলা যায় না; অনেক ক্ষেত্রে ইভটিজিং বলা যেতে পারে, সে মানুষটি কাজলীর দূরসম্পর্কের চাচা হয়। সেই সম্পর্ক ধরে এ বাড়িতে আসা যাওয়া তার। প্রথম দিকে মানুষটার সাথে তেমন একটা কথা হতো না কাজলীর। কারণ একজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ের সাথে একজন যুবকের আর কী কথা থাকতে পারে। তবে মানুষটার ঘন ঘন আসা যাওয়া কাজলীর পছন্দ হতো না। কিন্তু কাজলীর দাদি বুড়ো মানুষ। সেই বলতো, দেখতো কাজলী আলমগীর একা একা বসে আছে। তুই গিয়ে একটু গল্প টল্প কর না কেন? আর সূত্রপাত এখান থেকেই। আলমগীর এলেই তার সাথে গিয়ে গল্প করতে হতো কাজলীর। এত বড় একজন লোকের সাথে আর কী গল্প করা যায়। কিছু সময় থেকে কাজলী চলে আসতে চাইলে, হঠাৎ করেই তার হাত ধরে ফেলতো। কাজলীর মনের মধ্যে ঘিনঘিন করতো। হাতটা কোনো মতো ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসতো কাজলী।
আলমগীরদের অনেক জায়গা জমি। কিছু জমি আবার কাজলীর বাবা বর্গা আবাদ করে খায়। সেজন্য হয়তো এ বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের জন্য কেউ কিছু বলতে পারে না আলমগীরকে। তবে সেদিন থেকে, সামনে কাজলীর ফাইনাল পরীক্ষা। এই কারণ দেখিয়ে কাজলী আর তেমন একটা আলমগীরের সামনে যেত না। দাদির ঘরে বই নিয়ে বসে থাকতো। একদিন সন্ধ্যার কিছু সময় আগে আলমগীর এলো। দাদি ঘরে নেই। এই সুযোগে সরাসরি কাজলীর সামনে এসে বসলো আলমগীর। তার হাতের খামে কয়েকটি ভিউকার্ড। সেই ভিউকার্ড দেবার নাম করে কাজলীর হাত ধরলো আলমগীর। অতঃপর একটানে বুকের মধ্যে নিলো তাকে। এমন একটা অবস্থার জন্য কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিল না কাজলীর বালিকা বেলা।
সেই বয়সে কাজলী বুঝেছিল বড় হবার প্রতিবন্ধকতা। যদিও তারপর থেকে কখনো কোনো ভাবেই আলমগীরের সামনে যেত না সে। দাদি তার কিছু বললেই কাজলীর চোখ থেকে জলের বন্যা বইতো। সেদিন থেকেই আর কখনো কোনোদিন আলমগীরের সামনে যেতে বলেনি কেউ তাকে। ধীরে ধীরে আলমগীরও এ বাড়ি যাতায়াত কমিয়ে দিলো একদিন ।
দ্বিতীয়বার যে মানুষটা তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। ছেলেটার অনেকটা হিরোর মতো চেহারা। কাজলী অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়ে নবম শ্রেণিতে উঠবে তখন। তখনই এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয় তার সাথে। সেই ছেলেটির নাকি কাজলীকে ভালো লাগে। নাম মোর্শেদ। টেনে টুনে এসএসসি পাশ করে শহরের এক কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন ভালো লাগার কথা বললেও ক`দিন পরে হয়তো বলবে কাজলী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে মোর্শেদকে দেখার পর কাজলীরও তাকে ভালো লেগেছিল। ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল বললে ভুল বলা হবে। একদিন ভালোও বেসেছিলে।
সেই মোর্শেদ একদিন বললো, কাজলী, আমার আর তোমার একটা স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। কিভাবে? আমরা স্টুডিওতে গিয়ে ছবি উঠাবো আজ। তোমাকে এককপি দিবো আর আমার কাছে এককপি থাকবে। আমি তো সপ্তাহে একদিন শহর থেকে আসি। আর একদিন তোমায় দেখে মন ভরে না আমার। কাজলী কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল। বাস্তবিক তারও তো মোর্শেদকে প্রতিদিন দেখতে ইচ্ছে করে। দুই গ্রাম পরে হাটের উপর তখন নতুন স্টুডিও বসেছে। সেই স্টুডিওতে বান্ধবীর সাথে গেল কাজলী। মোর্শেদ আগেই পৌঁছে ছিল সেখানে। নানা রকম ছবি স্টুডিওর দেওয়ায় জুড়ে। তাদের কারো সাথে মোর্শেদকে মেলাতে চায় কাজলী। এর কিছু সময় পরে, মোর্শেদ কাজলীকে নিয়ে স্টুডিওর ভিতরে গেল। একটু স্নো পাওডার দিয়ে তৈরি হবার জন্য। আর ওর বান্ধবী তখন স্টুডিওলার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে আবার ।
কেবলি কাজলী আয়নার সামনে গিয়ে মাথায় চিরুনি দিয়েছে মাত্র, এমন সময় মোর্শেদ পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো। একবার কাজলীর মনে হলো মোর্শেদকে এক ধাক্কা হয়ে বের হয়ে যাবে। কিন্তু অজানা এক রহস্যে কিছুই বলতে পারলো না। এই প্রথম কোনো পুরুষ কাজলীর ঠোঁট স্পর্শ করেছিল। সেই মোর্শেদই পরের সপ্তাহে প্রস্তাব দিলো। আগামীকাল কাজলীর বান্ধবীদের বাড়িতে কেউ থাকবে না। সেখানে আড্ডা দিয়ে চাই আমি। আর সময় পেলে একটু আদরও করতে চাই। মোর্শেদের এ কথাশুনে কাজলী ঠিকই বুঝেছিল মোর্শেদ তার সাথে একবিছানায় শুতে চায়। এখানে তার প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু নেই!
পুরুষ মাত্রই প্রেমের নামে শরীর নিয়ে খেলতে চায়। একটা মেয়ে যখন বুঝে যায়! তার কাছে বিয়ে মানে প্রহসন। প্রেম যখন তার কাছে মাতাল হবার উপাদান। অনেকটা মদের মতো। কোনো মত খেয়ে একটু মাতাল হলেই হলো। সেই বোতলে মদই থাক আর জলই থাকুক। সেখানে ভালোবাসা নেই! এই চব্বিশ বছর বয়সে কাজলীর জীবনে বারোজন পুরুষ এসেছে। তারো কেউ শরীর বৃত্তান্তের বাইরে যেতে চাইনি। আর প্রায় পুরুষগুলোর কৌশল প্রায় একই রকম। তারে কামে বিশ্বাসী প্রেমে নয়। সেই তুলনায় মজিদ সবার থেকে ভিন্ন।