লতিফ জোয়ার্দার
লতিফ জোয়ার্দারের গদ্য ‘কিছুই হইনি আমি, হতে পারিনি’
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৩, ২০২৩
এমন একটা পরিবারে জন্ম আমার যে পরিবারে উচ্চশিক্ষিত কেউ ছিল না। অল্প বয়সেই বাবাকে মৃত্যু ভয় পেয়ে বসেছিল বলে, সে ধর্মকর্মের দিকে ধাবিত হয়েছিল। সংসারে তার কোনো মন ছিল না। দেশ-বিদেশ তাবলিক জামাত করে বেড়াতো। সেই বাবাকে হারালাম মাত্র দুই বছর বয়সে।
আমার বড় আরও অনেকগুলো ভাইবোন ছিল। সেই বাবার কোনো স্মৃতি নেই আমার কাছে। মা ছিল বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তার বাবার ছিল ৯০০ বিঘা জমি। কিন্তু সেই মা আমার ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর সাথে সাথে প্রায় সব জমি হারায়ে ফেলেছিল। এরপর আমাদের ভাইবোনদের বেশ কষ্ট সহকারেই মানুষ করেছিল।
মনে পড়ে, আমার কোনো ভাই আমাকে কোনোদিন একটা চকলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেনি কোনো বিলাসী ভাবনার গল্প। আমার চারপাশে আমার বয়সি যারা ছিল, তারা কত সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে স্কুল যেত। আর আমি চেয়ে দেখতাম। তাদের কেউ কেউ ১০ পয়সায় লাল আইসক্রীম কিনে খেত।
আমার তখন বড্ড দুধমালাই খেতে ইচ্ছে করতো। চোখের সামনেই দেখতাম মণ্ডল বাড়ির ছেলেমেয়েরা আইসক্রীম খেতে খেতে শার্টের বুক পকেট ভিজিয়ে ফেলেতো। আমি শুধুই সব চেয়ে দেখলাম। আর আমার জীবনের ভুল অংকগুলো হিসেব করতাম। কোনোদিন আমায় দাড়িয়াবান্ধা মাঠ ডাকেনি। কোনোদিন আমায় ফুটবল মাঠ ডাকেনি। কেন জানি না, কেউ আমায় খেলার মাঠে ডাকেনি। কেউ আমায় খেলার জন্য ডাকেনি।
মনে পড়ে আর মা আমায় খেলার মাঠে যেতে দিতো না। পুকুরঘাটে যেতে দিতো না। আমার বড় এক ভাই জলে ডুবে মরেছিল বলে, আমার মা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতো। আশপাশের সব বাড়িতে যাওয়া ছিল আমার জন্য বারণ। কেন কী কারণে মা আমার কারো বাড়িতে যেতে দিতো না! আর কিছুই জানতে পারিনি আমি।
কত কত অভাবের পথ পাড়ি দিয়ে বড় হয়েছি আমি। কত কত স্বপ্ন মাড়িয়ে বড় হয়েছি আমি। রাখালবালকের সাথে গরু চড়াতে চড়াতে ফিরে এসেছি আমি। মাঠে-ঘাটে তেপান্তর থেকে ফিরে এসেছি আমি। এক স্বপ্নবালক হবার অভিলাষ নিয়ে ফিরে এসেছি আমি। একমাত্র কবিতার কারণে আবার ঘুমহীন রাত্রি শেষে ফিরে এসেছি আমি।
অথচ সেই ছোটবেলা থেকে আমার বড় ইচ্ছে ছিল হাটের দোকানদার হবো আমি। সে কারণে বাড়িতে ছোট্ট একটা দোকানও দিয়েছিলাম সে সময়। কিন্তু মা চাইতো আমি লেখাপড়া করে চাকুরি করি। লেখাপড়া করে বড় মানুষ হই আমি কিন্তু আমার লেখাপড়া ভাল লাগতো না। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইচ্ছে হলো পেপার বিক্রেতা হবো আমি। সেই সময়ই মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করতো আমার। মনে পড়ে এর আগেই দুই-একটা ছড়া কবিতা লিখে ছিলাম আমি। সে কবিতা একদিন স্থানীয় কাগজে ছাপাও হয়েছিলো।
এরপর আমার একদিন কবিতার খাতা হয়েছিল। সেই সময় স্কুলের পয়সা বাঁচিয়ে আমি রবীন্দ্র আর নজরুলের কবিতার বই কিনেছিলাম। সে সময় প্রতিমাসেই কবিতার বই কিনতাম আমি। ঈশ্বরদী রেল জংসনের বইয়ের দোকান থেকে বই কিনতাম আমি। বইকেনার জন্য পাবনা শহরে যেতাম আমি। আল-মাহমুদ, শামসুর রাহমান, জীবনান্দ দাসের কবিতার বই ছিলো আমার। বাড়িতে একটা গৃহ লাইব্রেরি করেছিলাম আমি। সেখান থেকে বন্ধুরা বই নিয়ে পড়তো তখন। সেই বইগুলো আর কখনো ফিরিয়ে দিতো না। বিশেষ করে মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো বেশি পড়তো তারা।
টেনেটুনে এসএসসি পাশ করে নজরুলের মহরম কবিতা আবৃতি করে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিছুদিন যেতেই আমি এক অন্য জগৎ পেলাম। তখন কলেজে আমার অনেক কবিবন্ধু। সেই সময়ই সাহিত্য পত্রিকা করেছিলাম আমি। যার নাম ছিল, কমলা। কমলা একটা নদীর নাম। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে এক সময় বয়ে যেত। এখন বর্ষায় কিছু জল দেখা গেলোও অন্য সময় ডোবা-নালা। সেই কমলার নামে আমার সাহিত্য পত্রিকার নাম। সেই পত্রিকায় অনেকেই লিখতো তখন। প্রতিমাসে আমরা দেওয়াল পত্রিকা করতাম তখন।
সেই এসএসসি পড়ার সময়ই আমার লেখা কবিতা দৈনিক বার্তার ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। সেই সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ছুটি পত্রিকা আমার কবিতা ছেপেছিলো। তখন কলেজে সবাই আমাকে কবি বলে ডাকতো। আমার কেন জানি না বড্ড লজ্জা লাগতো তখন। দুই-চারটা কবিতা লিখলেই কী কেউ কবি হয়ে যায়। আমার মনে হতো আমি কোনো কবি নই। সারা রাত জেগে কখনো একটিও কবিতা লিখতে পারিনি আমি। কত কত দিন চলে গেছে। কত কত রাত চলে গেছে। এরপর একদিন আমার লেখা সব কবিতা, সব বই আমি আগুনে পুড়িয়ে লেখার জগৎ থেকে দূরে চলে গেলাম।
এরপর পনের বছর আর কিছুই লিখিনি আমি। এরপর কবিতার আগুনে আর জ্বলে পুড়ে মরিনি আমি। তখন আমি এক অন্যমানুষ। অথচ পনের বছর পর আবার ফিরে এলাম। এখন আমি প্রতিদিন পড়ি। এখন আমি প্রতিদিন লিখি। এখন আমার বইয়ের সংখ্যা তেত্রিশ। এখন আমি শুধু কবিতা নয়। কখনো আমি গল্প লিখি। এখন আমি উপন্যাস লিখি। তারপরও মনে হয় কিছুই লিখতে পারিনি আমি। কিছুই হতে পারিনি আমি। সেই হাটুরে দোকানদার। সেই পেপার বিক্রেতা। কিছুই হইনি আমি! কিছুই হতে পারিনি আমি।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক